1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শুভেন্দু মাইতি ও ৩৩ কোটি বাঙালির এক স্বপ্নজগতের কথা

শুভ সিংহ
১২ জানুয়ারি ২০২৪

তিনি সংগীত সেবক। গান বাঁধেন, গান করেন, গান সংগ্রহও করেন। সেই মানুষটি জীবনের শেষ পর্বে কঠিন পণ করেছেন— ৩৩ কোটি বাঙালিকে এক ছাতার নীচে আনবেন। শুভেন্দু মাইতির সেই স্বপ্নের নাম ‘পান্থপাদপ'।

৩৩ কোটি বাঙালিকে একসূত্রে গাঁথতে চান শুভেন্দু মাইতি।
৩৩ কোটি বাঙালিকে একসূত্রে গাঁথতে চান শুভেন্দু মাইতি।ছবি: Subho Singha

নির্মীয়মাণ প্রকল্প ও সংগীত নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপচারিতায় প্রবীণ শিল্পী।

ডয়চে ভেলে: সংগীতের জন্য আপনার জীবন নিবেদিত। বিশেষত লোকসংগীত নিয়ে গবেষণা, চর্চায় আপনি অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। জীবন সায়াহ্নে এসে এত বড় প্রকল্প হাতে নিলেন কেন? আমি ‘পান্থপাদপ'-এর কথা বলছি...

শুভেন্দু মাইতি: কমবেশি ৩৩ কোটি বাঙালি আছে সারা বিশ্বে। মেধা, সৃজনশীলতা, উদারতা, দেশপ্রেম, নানা গুণাবলীর বিচারে বাঙালি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ১৭ কোটি বাঙালি নিজের দেশ অর্জন করেছে লড়াই করে। কিন্তু বাকি ১৬ কোটি কচুরিপানার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। এই ৩৩ কোটিকে একসূত্রে বাঁধার লক্ষ্যে 'পান্থপাদপ' গঠনের পরিকল্পনা।

সেজন্য কি সংগঠন তৈরির দরকার ছিল? তা-ও আবার বোলপুরকে বাছলেন কেন?

ফাঁকাতে সংগঠন হয় না। সাইনবোর্ড লাগাতে হয়। রবীন্দ্রনাথও সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন শান্তিনিকেতনে। যাযাবরবৃত্তি করে প্রতিষ্ঠানের শিকড় প্রতিষ্ঠা করা যায় না। তাই বোলপুরকে বেছে নিলাম। বিশ্বের যে প্রান্তেই বাঙালি থাক না কেন, তারা ভারতে এলে একবার বোলপুরে আসে। এই বাঙালিরা যাতে একটা রাত 'পান্থপাদপে' কাটিয়ে যান।

পান্থপাদপ'-এর আকর্ষণ কী হবে?

এখানে এলে সবুজে ঘেরা গ্রামবাংলার ছোঁয়া পাওয়া যাবে। যেখানে সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙবে, রাতে দেখা যাবে জোনাকির আলো। বাঙালির হারিয়ে যাওয়া খাবারের আস্বাদ মিলবে কমিউনিটি কিচেনে। শোনা যাবে কলের গান— আশ্চর্যময়ী দাসী, রাইচাঁদ বড়াল। কটেজে কিন্তু কিচেন থাকবে না। খেতে বসার আগে গাছকে জল দিতে হবে, তা তিনি যত বড়ই মানুষ হোন।

প্রকল্প রূপায়ণের কাজ কতটা এগিয়েছে? অনেক টাকা জোগাড় করতে হচ্ছে আপনাদের।

এক কোটি ১৭ লক্ষ টাকা দিয়ে ১৬ বিঘা জমি আপাতত কিনেছি। কনভার্সন হয়ে গিয়েছে। জমি এখন নিষ্কন্টক। আটটা কটেজের ভিত তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রথম বছরে আমরা অন্তত ১০-১২টি কটেজ করবো। পৃথিবীর বাঙালিরা এগিয়ে আসছেন। তাদের বলেছি, কটেজ দেবো, বিনিময়ে টাকা চাই। আমি কিন্তু ফকির লোক। ব্যাংকে তিন হাজার টাকা থাকে!

বাংলাদেশই প্রমাণ করেছে, দ্বিজাতিতত্ত্বকে তারা অন্তর থেকে গ্রহণ করেনি: শুভেন্দু মাইতি

This browser does not support the audio element.

কয়েকটি আর্কাইভ গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন, বলছিলেন। সেগুলির রূপরেখা চূড়ান্ত করেছেন?

হ্যাঁ, চারটি আর্কাইভ হবে। দু'টি এই বছরের মধ্যেই গড়ার ভাবনা রয়েছে। আমার সংগ্রহে সাড়ে আট হাজার গ্রামোফোন রেকর্ড আছে, ছয়খানা কলের গান আছে। পাঁচ লক্ষ পিন আছে, যা পৃথিবীর আর কোথাও সম্ভবত নেই। শ্রবণ মাধ্যমের বিবর্তন তুলে ধরা হবে আর্কাইভে। দম দেয়া কলের গান থেকে ডিজিটাল রূপান্তর। আর একটি আর্কাইভের নাম হবে পুতুলবাড়ি। সারা পৃথিবীর মুখোশ ও পুতুল।

দু'টির কথা বললেন। অন্য দু'টি আর্কাইভ কী নিয়ে?

আমাদের নাগরিক নাটকের ইতিহাস দুশ' বছরের। কিন্তু লোকনাটকের ইতিহাস শতাব্দীপ্রাচীন। তার ইতিহাস লেখা হয়নি, রক্ষিত হয়নি। জেলাওয়াড়ি ইতিহাস সংগ্রহ করবো। পালাকারদের নাম, পরিচয়, পাণ্ডুলিপি, ব্যবহৃত তৈজসপত্র সংগ্রহশালায় থাকবে। যাত্রাশিল্পীরাও এর মধ্যে থাকবেন। চতুর্থ আর্কাইভে থাকবে আদিবাসীদের ব্যবহৃত প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র, শিকারের অস্ত্র, নারীদের অলঙ্কার ইত্যাদি।

এর অর্থ লোকসংস্কৃতির নানা দিককে এক ছাতার নীচে আনতে চাইছেন। শিশুদের জন্য কিছু ভাবনা আছে আলাদা করে?

শিশুদের কথা আমরা ভেবেছি। তাদের জন্য একটি বিনোদন পার্ক গড়ে তোলা হবে তৃতীয় পর্যায়ে। আমাদের দেশের পার্ক হলো ইউরোপের অক্ষম অনুকরণ। অথচ আমাদের ত্রৈলোক্যনাথ, উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার পরশুরাম, শিবরাম থেকে রাক্ষসখোক্কস আছে। এসব মিলিয়ে তৈরি হবে ‘আবোলতাবোলের দেশ'। মহাকাশের জার্নিতে ছেলে-মেয়েরা পৌঁছে যাবে সেই আজব দেশে। সেখানে থাকবে হাঁসজারু, ট্যাঁশগরু, বকচ্ছপ, হিপোপটেমাস।

শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর বিশ্বভারতী রয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি আছে এই প্রতিষ্ঠানের। আপনারা কি বিশ্বভারতীর পরিপূরক হয়ে উঠতে চাইছেন?

বিশ্বভারতীর সঙ্গে বিরোধ নেই। আমরা যে কাজ করবো, তারা সেই দায়িত্ব নিতে পারবে না। এটি একমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, একটি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি, লোকায়ত দর্শন, জীবনযাপনসহ নিজস্ব পরিচয়কে রক্ষা করার জন্য বিশ্বভারতী নয়। তাদের কর্মসূচিতে এগুলি নেই। আমাদের এখানে কেউ পড়াশোনা করতে আসবে না। সৃষ্টিশীল বাঙালির কাছে আমরা পৌঁছতে চাই, যারা বিশ্বভারতীতে পঠনপাঠন বা গবেষণার জন্য আসে।

আপনার সৃষ্টি ও যাপনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা খুবই বাঙময়। আপনি লিখেছিলেন ‘মঈনুদ্দিন কেমন আছো'। ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে আপনি সরব থেকেছেন আজীবন। আপনার প্রতিষ্ঠান সেই ধারায় নতুন কথা বলবে?

ধর্মকে দূরে সরিয়ে রেখে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তাকে আমরা উদযাপন করবো। এই জাতিসত্তা না থাকলে বাংলাদেশ লড়তে পারতো না। বাংলাদেশের সৃষ্টি তার মূল্যবান প্রমাণ। ৩০ লক্ষ মানু্ষ জীবন দিয়েছে ভাষার জন্য।

আপনার আর একটা শব্দবন্ধ আজো সমান প্রাসঙ্গিক—ধর্ম এখন মানুষ খাচ্ছে'। আমাদের বাঙালি জাতিসত্তা কি তার কাছে হেরে যাবে?

হারার প্রশ্ন নেই। ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হচ্ছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হল। বাংলাদেশই প্রমাণ করেছে, দ্বিজাতিতত্ত্বকে তারা অন্তর থেকে গ্রহণ করেনি। আমার স্বীকার-অস্বীকারে কিছু এসে যায় না। ব্রিটিশ শাসক বিভাজন চেয়েছে। রাষ্ট্রনায়করা এতে ইন্ধন দিয়েছেন। মানুষ কিন্তু চায়নি। চাইলে বাংলাদেশ তৈরি হতো না।

আবার  ‘পান্থপাদপ'-এর কথায় ফিরি। এই প্রতিষ্ঠান কীভাবে সংগীত, সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করবে বলে আপনি ভেবেছেন?

বীজের সংরক্ষণ করা হবে। সংগীতের একটা বীজ থাকে, যেটি থেকে চারা হয়। হাইব্রিড বীজ থেকে হয় না। মূল বীজটিকে রক্ষা করতে হবে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের তার ইতিহাস জানাতে হবে। এটাই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবে।

আপনি তো ঘন ঘন বাংলাদেশ যান। ওপার বাংলাকে কীভাবে এই উদ্যোগের সঙ্গে জুড়ছেন?

বার বার যাই। শরীর খারাপ হওয়ায় কিছুটা ছেদ পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে অনেক উপাদান সংগ্রহ করা হবে। সেখানে ছয়টি মোটিভেশন ক্যাম্পে দারুণ সাড়া পেয়েছি। আমাদের দেশেও ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হবে।

এই কাজের জন্য টাকাও লাগবে অনেক। প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহ কীভাবে করছেন?

কর্পোরেট সংস্থার সাহায্য নেবো না বলেই ভেবেছি। তবে বাণিজ্যিক সংস্থার সাহায্যও নিতে চাইছি। দুটি বাঙালি সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে। এ ছাড়া একটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলেছি। আর ৩৩ কোটি বাঙালি এক টাকা করে দিলেই তো হয়, কি হয় না? আমার তো এত টাকা লাগবে না!

সংগঠন করার অভিজ্ঞতা আপনার আগেও আছে। লালন আকাদেমির কথা বলছি। তার কাজ সম্পর্কে একটু বলুন।

লালন আকাদেমিতে সাড়ে নয় হাজার গান সংগ্রহ করেছি। এগুলি রেকর্ডের গান নয়, কোনো অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়েছে বা বাউল-ফকিরের মুখ থেকে সংগ্রহ করেছি। ক্যাসেট ও স্পুলে গান ধরা ছিল। এখন সেই গানের সম্ভার ডিজিটাইজেশনের কাজ চলছে।

শুভেন্দু মাইতি জানিয়েছেন- বাংলাদেশ থেকে অনেক উপাদান সংগ্রহ করা হবে। সেখানে ছয়টি মোটিভেশন ক্যাম্পে দারুণ সাড়া পেয়েছি।ছবি: Subho Singha

তার মানে আসল বা মূল গানটি সংগ্রহ করা হচ্ছে?

অরিজিনাল বা আসল বলে গানের কিছু হয় না। বীজের যতটা কাছাকাছি থাকা যায়, চেষ্টা করছি। গান বদলাতে থাকে। আঞ্চলিক গান মানে টুসু, ভাদু, ভাওয়াইয়া, চটকা, ঝুমুর, আলকাপ, গম্ভীরা প্রভৃতি একটি এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আর এক ধরনের গান উড়ান দেয়, তার পাখনা আছে। সে গানের বাণী ও সুরের শুদ্ধতা নিয়ে বিতর্ক তোলা উচিত নয়।

আপনি বীজের কথা বলছেন। কিন্তু মূল গান বদলে গাওয়া হচ্ছে। এ সম্পর্কে আপনার কী মত?

গান দু'ভাবে পাল্টায়। একটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে। একটা গান কুষ্টিয়া জন্ম নিয়ে ২০০ বছর ধরে বিভিন্ন পথ অতিক্রম করে। লালনের গান নদিয়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তরবঙ্গ দিয়ে আসছে। যে এলাকা দিয়ে পরিক্রমা করছে সেখানকার উচ্চারণ, সুর গানটি আত্মীকরণ করছে। নদিয়া দিয়ে আসার সময় কীর্তনের প্রভাব পড়ছে। একইভাবে মালদায় গম্ভীরা, মুর্শিদাবাদে আলকাপ, উত্তরবঙ্গের চ্যাংড়াবান্ধা দিয়ে আসার সময় ভাওয়াইয়ার প্রভাব পড়ছে। এ পরিবর্তন রোখা যায় না।

পরিক্রমার ফলে গানের পরিবর্তনের কথা বললেন। আমি বলছিলাম পরিচিত গান ভিন্ন সুরে গাওয়ার কথা।

বুঝেছি তুমি কী বলছো। এই ধরনের বদল আরোপিত। বিক্রি করার জন্য পাল্টে দেয়া হয়। গান স্বাভাবিক ভাবে পাল্টালে অসুবিধা নেই, কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে বিপণনের জন্য পরিবর্তনের আমরা বিরোধী। এই কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করে বৈদ্যুতিন টিভি চ্যানেলগুলি হয়ে উঠেছে লোক সংস্কৃতির পতিতালয়। রিয়েলিটি শো হয় না! লোকসঙ্গীত আমাদের মায়ের মতো, তাকে ওরা বেচে দিচ্ছে।

অনেক অচেনা গান কিন্তু নতুন শ্রোতা পাচ্ছে, অনেকের কাছে পৌঁছচ্ছে...

এভাবে গান পৌঁছে লাভ কী? কিছু মানুষের গাড়ি-বাড়ি হচ্ছে। কিন্তু গানের সর্বনাশ হচ্ছে। চারটে কিবোর্ড নিয়ে ধেইধেই করে নাচতে নাচতে লালনের গান করবে, এটা মানা যায় না।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ