মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে ‘প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনা' প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ উদ্দেশ্য, প্রতিটি পরিবারকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা৷ দূর দুরান্তের দুর্গম এলাকার মানুষকেও ব্যাংক পরিষেবার আওতায় আনা৷
এই উচ্চাকাঙ্খামূলক ‘প্রধানমন্ত্রী জন-ধন যোজনা' প্রকল্প যাতে সফল হয়, তার জন্য রিজার্ভ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, মোবাইল ফোন পরিষেবা সংস্থাগুলিকেআগেই এই কাজে নামিয়ে কেওয়াইসি, অর্থাৎ ‘নো ইয়োর কাস্টমার' সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহের প্রাথমিক কাজ শেষ করা হয়৷ বৃহস্পতিবার ২৮শে আগস্ট নতুন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন৷
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reutersমোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: APদাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNIভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: APভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaনির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
প্রথম দিনেই এক কোটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়৷ এ জন্য খোলা হয় ৬০ হাজার ব্যাংক শিবির৷ প্রকল্পে যাতে অগ্রগতি হয়, তার জন্য রিজার্ভ ব্যাংক প্রকরণগত পরিচয়পত্র দাখিলের শর্তাদি শিথিল করে৷ যাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার নথিপত্র নেই, তাঁরাও অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবেন৷ তারপর ছয় মাসের মধ্যে নথিপত্র জমা দিলেই চলবে৷ পরিচয় সংক্রান্ত নথিপত্রের মধ্যে আছে, বায়োমেট্রিক আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ১০০ দিনের জব-কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পাশপোর্ট ইত্যাদি৷ যাঁদের নথিপত্র নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে নিজের ছবি ও আবেদনপত্র ব্যাংক অফিসারের সামনে সই করে দিলেই হবে৷ যাঁরা রুজি রোজগারের জন্য এক রাজ্য থেকে অন্য রাজে যান এবং নথিতে থাকা ঠিকানা এবং বর্তমান ঠিকানা আলাদা হলে নিজের সই করা হলফনামা দাখিল করলেই হবে৷
অন্যান্য যেসব সুবিধার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে আছে, অ্যাকাউন্ট ‘জিরো-ব্যালান্স' হলেও ক্ষতি নেই৷ গ্রামীণ উপভোক্তাদের দেয়া হবে বিনামূল্যে ডেবিট কার্ড, যার মধ্যে থাকবে এক লাখ টাকার দুর্ঘটনা বিমা৷ সেভিংস ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে তা জানা যাবে মোবাইল ফোনে৷ তার জন্য ইন্টারনেটের দরকার হবে না৷
উল্লেখ্য, ভারতে যত মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি লোকের আছে মোবাইল ফোন৷ সবথেকে বড় সুফল হবে ভারতের ১২৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই গরিব৷ তাঁদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ চাষি ও মজুর৷ তাঁরা বিপদকালে টাকা ধার করতে ছুটে যান মহাজনদের কাছে৷ সেই সুযোগে মহাজনরা ঋণ দেয় ব্যাংকের চেয়ে অনেক বেশি সুদে৷ পরে যখন তাঁরা ঋণ শোধ করতে পারেন না, তখন মহাজনদের কাছে সর্বস্ব বন্ধক রাখতে হয়৷ নাহলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয় তাঁদের৷ প্রায় ১০ কোটি পরিবার টাকা রাখে চিটফান্ডে অল্প সময়ে বেশি লাভের আশায়৷ পরে তাঁদের হা হুতাশ করতে হয়৷ তবে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো, গরিবি রেখার নীচে বসবাসকারীদের নিয়ে, যাঁদের ‘নুন আনতে পান্তা' ফুরায় অবস্থা৷ সঞ্চয় এঁদের কাছে বিলাস মাত্র৷ ব্যাংকও এঁদের মাইক্রো-ঋণ দিতে চাইবে না৷ অ্যাকাউন্টে টাকা জমা না পড়ে হাজার হাজার অ্যাকাউন্ট হয়ে থাকবে নিষ্ক্রিয়৷ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এঁদের সামিল করা কতটা সম্ভব হবে, তাই নিয়ে সংশয় আছে সমাজ বিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিক মহলে৷ তার জন্য দরকার গরিব ও নিরক্ষরদের এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল করে তোলা৷