শুল্ক নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এখন পাল্টাপাল্টি চাপ চলছে। ভারত এই পরিস্থিতিতে কী করবে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বললো ডিডাব্লিউ।
চ্রাম্পের শুল্ক ধাক্কার পর ভারত কি পথ বদলাবে? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?ছবি: Alex Brandon/AP Photo/picture alliance
বিজ্ঞাপন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ স্টিফেন মিলার বলেছেন, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে। সেই অর্থে রাশিয়া যুদ্ধের খরচ চালাচ্ছে। ভারত চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাশিয়ার তেল কিনছে জানতে পেরে মানুষ ধাক্কা খেয়েছে। এটা অবাক করার মতো ঘটনা।
মিলারের দাবি, ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অসম্ভব ভালো সম্পর্ক। কিন্তু যুদ্ধের খরচ জোগানোর জন্য অর্থ দেয়ার বিষয়টিও বাস্তব। তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর জন্য অনেক বিকল্প আছে।
আবার সূত্র উদ্ধার করে ব্লুমবার্গ জানাচ্ছে, সরকার কোনো তেল শোধনাগার সংস্থাকে রাশিয়া থেকে তেল কিনতে নিষেধ করেনি। সরকারি ও বেসরকারি তেল শোধনাগারগুলিকে বলা হয়েছে, তারা নিজেদের পছন্দমতো জায়গা থেকে তেল কিনতে পারবে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসও গত শনিবার জানিয়েছে, ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনবে। ট্রাম্পের সংরক্ষণ নিয়ে হুমকির পরেও তারা তেল কিনবে বলে ভারতের দুইজন প্রবীণ কর্মকর্তা তাদের জানিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকে রাশিয়া ভারতকে অস্ত্র বিক্রি করছে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্থির থেকেছে এবং এবং তা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সম্পর্ক অন্য কোনো দেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ঠিক হবে না। ভারত আশা করে, অ্যামেরিকার সঙ্গেও তাদের ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় থাকবে।
অগাস্টের শেষ দিকে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য অ্যামেরিকার বাণিজ্য প্রতিনিধিরা সম্ভবত দিল্লি আসবেন। কিন্তু ভারত অ্যামেরিকার দাবি মেনে দেশের কৃষি ও ডেয়ারি ক্ষেত্রকে খুলে দেবে না।
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত সপ্তাহান্তে বলেছেন, "দেশের মানুষের উচিত স্বদেশী জিনিস কেনা। বিশ্বের অর্থনীতি এখন অনেক ঝুঁকির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এখন একটা অস্থির পরিস্থিতি চলছে। এখন আপনারা কী কিনবেন তা গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা সেই জিনিস কিনুন যা একজন ভারতীয়দের পরিশ্রমে তৈরি হয়েছে।"
ট্রাম্পের শুল্কের চাপ বিশ্বব্যাপী যেমন প্রভাব ফেলতে পারে
ঘোষণার এক সপ্তাহ পর ৯০ দিনের জন্য পারস্পরিক শুল্ক স্থগিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ছবিঘরে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক কোথায় কী প্রভাব ফেলতে পারে তার বিস্তারিত...
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
শুল্কের ঘোষণা
২ এপ্রিল বিশ্বের সব দেশের পণ্য আমদানির উপর নানা হারে বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ঘোষণার এক সপ্তাহ পর অবশ্য চীন, ক্যানাডা ও মেক্সিকো ছাড়া বাকি রাষ্ট্রগুলোর উপর আরোপিত শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন ট্রাম্প৷ ৯০ দিন পর যদি এই শুল্ক তিনি আবার আরোপ করেন, তাহলে ভোক্তা পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি- সব জায়গাতেই এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের৷
ছবি: Jim Lo Scalzo/UPI Photo/Newscom/picture alliance
মার্কিন শুল্কের ইতিহিস
অ্যামেরিকার বাণিজ্যের শুরুর দিক থেকেই শুল্ক আরোপের ইতিহাস রয়েছে৷ দেশটি ১৮২০ সালে বিদেশি পণ্যের উপর ৩০ ভাগের মতো শুল্ক আরোপ করেছিল৷ ১৯৩০ সালে ফেডারেল ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর গঠনের পর থেকে শুল্ক কমাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র৷ ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে শুল্ক নিয়ে চীনের সাথে বাদানুবাদ শুরু হয়৷ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে, অর্থাৎ, ১৮২০ সালের দুইশ বছর পর মার্কিন শুল্কের হার আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে৷
ছবি: Liu Jie/Xinhua/IMAGO
শুরু হয় ‘শুল্ক-যুদ্ধ’
ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করে, যা আগে ছিল ৩৪ শতাংশ৷ পাল্টা জবাব দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷ চীনা পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ট্রাম্পের প্রাথমিক ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের উপর শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নও৷ যদিও ট্রাম্পের স্থগিতাদেশের ঘোষণায় পিছু হটে ইইউ৷
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
তেলের দাম, শেযার বাজার
ট্রাম্পের ঘোষণার সাথে সাথেই অস্থিরতা দেখা যায় তেল ও শেয়ারের বাজারে৷ তেলের দাম কমেছে প্রতি ব্যারেলে ৫০ ডলার পর্যন্ত৷ ভয়াবহ পরিস্থিত তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারে৷ মন্দার আশঙ্কায় ট্রাম্পের ঘোষাণার প্রথম দুই দিনে শুধুমাত্র মার্কিন শেয়ারবাজার ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার হারিয়েছে৷
ছবি: Mark Ralston/AFP
অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা
পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করা হলে চলতি বছরের শেষের দিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান জে পি মর্গ্যান জানায়, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পর চলতি বছরের শেষ নাগাদ মন্দার শঙ্কা ৬০ ভাগে দাঁড়িয়েছে৷ অর্থনৈতিক মন্দা চরম পর্যায়ে গেলে ভূগতে হবে বিশ্বের প্রায় সব মানুষকেই৷
ছবি: Gregor Fischer/Getty Images
প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কা
শুল্ক আরোপের প্রভাব পড়বে আমদানি-রপ্তানিতে৷ এর ফলে বিভিন্ন দেশের আশানুরূপ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে৷ ২ এপ্রিল ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর ইউরোপের দেশ ইটালি চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এক দশমিক দুই থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ছয়-এ নামিয়ে এনেছিল৷ অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ফলে চলতি বছর জার্মানির জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক এক ভাগে নেমে আসতে পারে৷
ছবি: natatravel/Depositphotos/IMAGO
ক্রেতাদের ভোগান্তি
শুল্ক আরোপের প্রভাব পণ্যের দামের উপর পড়বেই৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য প্রবেশে অধিক শুল্কের মাশুল সংশ্লিষ্ট দেশের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলবে৷ শুধু তাই নয়, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন শুল্ক বাড়ানোয় তার প্রভাবও ক্রেতাদের উপর পড়বে৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/IMAGO
ক্ষতিগ্রস্ত হবে উৎপাদন
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাণিজ্যে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এমনটাই মনে করেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনাভির্সিটির সহযোগী অধ্যাপক জান-ইন চোং৷ এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, এই শুল্ক বিশ্বব্যাপী পণ্যের চাহিদার উপর প্রভাব ফলেবে, যার প্রভার পড়বে উৎপাদনে৷
ছবি: CFOTO/NurPhoto/IMAGO Images
বাজারে অবস্থান হারাতে পারে অনেক দেশ
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, যাদের রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, সেই দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাজারে তাদের অবস্থান হারাতে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের৷ এর প্রভাব এমন দেশগুলোর অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে পড়তে পারে৷
ছবি: Joy Saha/ZUMA Press Wire/picture alliance
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্য জোটে প্রভাব
বাণিজ্য ক্ষত্রে অনিশ্চিয়তা ফলে অনেক দেশ নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগী খুঁজে পাওয়ার দিকে ধাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা অনেক বিশেষজ্ঞের৷ এরই মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণে চীনের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে অনেক দেশ- এমনটাই দাবি সিঙ্গাপুরের গবেষণা সংস্থা আইএসইএএস-ইউসোফ ইশাক ইনস্টিটিউটের এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টিনা ফং৷
ছবি: Ute Grabowsky/photothek/picture alliance
অসমান্তরাল বাণিজ্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে যেমন ক্ষতির মুখে ফেলবে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেও ঠিক ততটাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ এক নিবন্ধে বিজনেস হার্ভার্ড রিভিউ ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে ৩৬০ ডিগ্রির বাণিজ্য যুদ্ধ বলে মন্তব্য করে৷
ছবি: Anna Moneymaker/Getty Images
11 ছবি1 | 11
চাপে কতটা ফল হবে?
অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''ট্রাম্পের শুল্কের দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া থাকবে। স্বল্পমেয়াদী প্রভাব শেয়ার বাজারের উপর পড়ূবে।এই যে শুল্ক বসানো হলো, তার ফলে অনেক সংস্থায় লাভ কম হবে। তাদের শেয়ারের দাম পড়বে। এরকম ক্ষেত্রে এফআইআই খুব তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া জানানয। তারা শেয়ার বিক্রি করে চলে যায়। তারা মনে করে, অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগবে, টাকার অবমূল্যায়ণ হবে।''
তিনি বলেছেন, ''দীর্ঘমেয়দী বিষয় হলো, শুল্কের ধাক্কা ওষুধ, ইঞ্জিনিয়ারিং, বাসমতী, ইলেকট্রনিক এবং কিছুটা বস্ত্রশিল্পের উপর পড়বে। আমাদের দেশের জিনিস অ্যামেরিকায় সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়। আমাদের রপ্তানির ১৮ শতাংশ অ্যামেরিকায় হয়। এটা তো বেশ বড় অংশ। অ্যামেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে জিডিপি-র উপর প্রভাব পড়বে। ভবিষ্যতে দুই দেশ নতুন করে আলোচনায় বসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।''
অভিরূপ সরকার জানিয়েছেন, ''একটা কথা বলব, অ্যামেরিকা যদি যথেচ্ছভাবে শুল্ক বসায়, তাহলে অন্য দেশও অ্যামেরিকাকে বাদ দিয়ে বাণিজ্য করতে শিখে যাবে। ওদের উপরেও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ভালো হবে না।''
অধ্যাপক শুভনীল চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, বর্ধিত শুল্কের প্রভাব আমাদের উপর ফেলবে। ইলেকট্রনিক, বস্ত্রশিল্প, পরিষেবা ক্ষেত্রের উপর পড়বে। এর ফলে জিনিসের দাম বাড়বে। চাহিদা কমবে। ফলে শ্রমিকরা ধাক্কা খাবে। আমাদের ক্ষেত্রগুলি বিপন্ন হবে।
শুভ্রনীলের মতে, ''অ্যামেরিকা আমাদের জরিমানা কেন করবে, সেই অধিকার তাদের আছে কি?'' তিনি বলেছেন, ''ভারত কী করছে বোঝা যাচ্ছে না। আমরা বলছি, আমরা সমীক্ষা করছি। মোদী বলছেন, স্বদেশী করুন। শুল্ক মোকাবিলার কৌশল কী হবে তা স্পষ্ট নয়।''
তিনি মনে করেন, ''রাশিয়া আমাদের বহুদিনের অংশীদার। আমরা সেখান থেকে আমদানি, রপ্তানি বন্ধ করে দেব, এটা ঠিক নয়। রাশিয়া তেলের ক্ষেত্রে বড় প্লেয়ার। রাশিয়াকে ছাড়লে আমরা পুরোপুরি মধ্যপ্রাচ্যের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে যাব। ভ্যারিজ সোর্স থাকা উচিত। রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা উচিত। চীন ওদের সঙ্গে বাণিজ্য করছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধের কোনো যুক্তি নেই।''
দ্য টেলিগ্রাফের দিল্লির সাবেক বিজনেস এডিটর জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''যে সময়ে ট্রাম্প বাড়তি শুল্কের ঘোষণা করলেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদল এসে এবার দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করবে এবং তার ফলে ২০২৩ সালের মধ্যে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনায় ধাক্কা লাগলো।''