বুলগেরিয়ার উপকূলে মাছ ধরার ভাসন্ত জালে জড়িয়ে প্রাণ হারাচ্ছে শত শত ডলফিন, বিশেষত বেবি ডলফিন৷ দৃশ্যত এই ড্রিফ্ট-নেট ফিশিং বন্ধ করার কোনো উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায় এই সরকারের নেই৷ এক অসহনীয় পরিস্থিতি৷
বিজ্ঞাপন
জারেভোর জেলেদের মতে কৃষ্ণসাগরে শুশুক, মানে ডলফিনদের সংখ্যা বড় বেশি৷ জেলেরা বলে, ডলফিনরা আছে মহাসুখে; প্রত্যেকে রোজ ২০ কিলো করে মাছ খায় – গিয়র্গি যা নিজে ধরতে পারলে খুশি হতেন৷ এ-বছর বুলগেরিয়ার উপকূলে যে শত শত মরা ডলফিন ভেসে উঠেছে, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই গিয়র্গির৷ ওদিক পরিবেশবাদীরা শুশুকের মৃত্যুর জন্য ব্যাপক ড্রিফ্ট-নেট ফিশিংকে দায়ী করছেন৷
‘সেভ কোরাল বিচ' পরিবেশ গোষ্ঠীর আতানাস রুসেভ বললেন, ‘‘ওটা একটা বিরাট ব্যবসা৷ তিন কিলোমিটার লম্বা একটা ভাসন্ত জাল দিয়ে ৮০০ কিলোগ্রাম টার্বট মাছ ধরা যায়৷ একশ' কিলোমিটার লম্বা জাল থাকলে দুই থেকে চার টন মাছ ওঠে৷ তুরস্কের বাজারে এক কিলো মাছের দর ওঠে ৪০ ইউরো অবধি৷ কাজেই কয়েকদিনের মধ্যেই লাখ পাঁচেক ইউরো রোজগার করা যায়৷ ঢেউয়ের সাথে যে সব মরা বাচ্চা শুশুকগুলো ভেসে ওঠে, সেগুলোকে স্রেফ জাল থেকে বার করে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে৷''
শুশুকের মৃত্যু আমাদের নাড়া দেয় কেন
জাপানের তাইজি-তে শুশুক মারা সারা বিশ্বে যারা জীবজন্তু ভালোবাসেন, তাঁদের মধ্যে প্রতিবাদের সৃষ্টি করেছে৷ এই অদ্ভুত জলচর জীবগুলোকে ভালো লাগে, সেটা কি তাদের ক্লিক আওয়াজ করা, তাদের ‘হাসিমুখ’ না তাদের অসাধারণ বুদ্ধির জন্য?
ছবি: picture-alliance/dpa
শুশুক প্রেম
সামুদ্রিক কচ্ছপ? তিমি মাছ? হাতি সীল? এদের দেখলে চমকে যেতে হয় বটে, কিন্তু শুশুকদের মতো এরা আমাদের মন কাড়তে পারে না৷ প্রাণিবিজ্ঞানীরা শুশুকদের অতীব বুদ্ধিমান জীব বলে মনে করেন, সেই জন্যে কি? নাকি তাদের দেখতে অতো বন্ধুসুলভ বলে?
ছবি: picture-alliance/dpa
মাতৃদুগ্ধ
হয়ত শুশুকরা আমাদের মতো উষ্ণ রক্তের স্তন্যপায়ী জীব বলেই আমাদের তাদের ভালো লাগে৷ শুশুকদেরও প্রতিবার একটি করে সন্তানেরই জন্ম হয়৷ আর সেই ক্ষুদে শুশুকদের দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শুশুক শিকার
এই সামুদ্রিক জীবগুলির প্রতি আমাদের ভালোবাসাই হয়ত তাদের বাঁচানোর জন্য আমাদের আকুলতার উৎস৷ তাইজি জাপানে ধীবরদের একটি শহর৷ সেখানে শুশুক শিকার একটা ঐতিহ্য, কিন্তু প্রতিবছরই সারা বিশ্বে প্রতিবাদের সৃষ্টি করে৷ শুশুকদের একটা খাড়িতে ঢুকিয়ে সেখানে তাদের মারা হয়৷
ছবি: Reuters
মরণের ডঙ্কা
শুশুকরা পানির মধ্যে শব্দ-সংকেত ব্যবহার করে৷ জাপানি ধীবররা জলের নীচে লোহার পাইপ পিটিয়ে আওয়াজ করে শুশুকদের বিভ্রান্ত করে খাড়িতে নিয়ে আসে৷ শুশুকরা যেহেতু দঙ্গলে থাকে, সেহেতু এভাবে একটা গোটা দঙ্গলকে ধরা চলে৷
ছবি: CC2.0/lowjumpingfrog
পানিতে রক্তকাণ্ড
শুশুকের রক্তে তাইজি-র খাড়ির জল লাল হয়ে যেতো৷ লোকের নজর এড়ানোর জন্য তাইজি-র শুশুক শিকারীরা তাই আজ শুশুকগুলোকে মাথায় লোহার শিক ঢুকয়ে মারে এবং সেই ক্ষত ছিপি দিয়ে আটকে রক্ত বের হওয়া বন্ধ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শৌখিন খাদ্য
অনেক শুশুককেই মারা হয় তাদের মাংসের জন্য৷ সারা বিশ্বে শুশুকের মাংসের গ্রাহক আছে৷ একটি বটলনোজ গোত্রীয় শুশুকের দাম দেড় লাখ ডলার, আবার একটি দুষ্প্রাপ্য শ্বেত শুশুক-শাবকের বিক্রয়মূল্য পাঁচ লাখ ডলারও হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বন্দি শুশুক
মেরিন এন্টারটেইনমেন্ট শো-গুলোতে বটলনোজ শুশুকগুলোর খুব চাহিদা৷ তারা খুব তাড়াতাড়ি নানা খেলা শেখে, দর্শকদের খুশি করতে পারে৷ কিন্তু এই শুশুকরাই আবার মানসিক বিষাদে ভোগে এবং বন্দি অবস্থায় অত্যন্ত কমবয়সে মারা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অতিশয় বুদ্ধিমান
শুশুকদের মস্তিষ্ক সুবৃহৎ এবং জটিল৷ তাদের চেনার এবং যোগাযোগ করার ক্ষমতা অসাধারণ৷ কিন্তু তাদের দুঃখকষ্টের খবর ক’জন রাখেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
সিনেমা-টেলিভিশনের তারকা
শুশুকরা ছবিতে অভিনয়ে ওস্তাদ, যেমন জার্মান হিট ছবি ‘দ্য ডলফিন মিরাকল’-এ৷ কিন্তু প্রখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ ‘ফ্লিপার’-এর এক শুশুক-অভিনেতা নাকি আত্মহত্যা করেছিল৷ তার ট্রেনার রিচার্ড ও’ব্যারি আজ শুশুকদের অধিকারের প্রবক্তা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গোপন অস্ত্র
মার্কিন মিলিটারি জলের নীচে মাইনবোমা নিষ্ক্রিয় করার জন্য – আবার শত্রুর জাহাজে মাইনবোমা লাগানোর জন্যও শুশুকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে৷ ভালোমানুষ এই জীবটিকে নিরাপত্তার বিপদ বলে আর কে মনে করবে!
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
পরিবেশবাদীরা ব্যাপারটা সরকারের কানে তুলেছেন; সরকারও ভাসন্ত জাল নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ কিন্তু এ পর্যন্ত কিছুই করা হয়নি৷ বুলগেরিয়ার পরিবেশ ও পানি মন্ত্রণালয়ের মিরোস্লাভ কালুগেরোভ বলেছেন, ‘‘আপাতত আমি শুশুক মৃত্যুর কোনো বিশেষ কারণ দর্শাতে চাই না, কেননা আমরা এ নিয়ে গবেষণা বা ময়নাতদন্ত করিনি৷ দুর্ভাগ্যবশত আমরা এখনও ময়নাতদন্ত করার মতো কোনো শুশুকের লাশ খুঁজে পাইনি৷''
শুশুকের জীবন-মরণ
রোমানিয়ার জীববিজ্ঞানী রাজভান পপেস্কু নিজের উদ্যোগে বুলগেরিয়ায় এসেছেন পরিবেশবাদীদের সাহায্য করতে৷ তিনি একটি শুশুকের লাশ কেটে মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করবেন৷ বুলগেরিয়ায় এ কাজের জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ কিংবা স্পেশাল ল্যাবরেটরি নেই, কাজেই তাঁকে ব্যবস্থা করে নিতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘শুশুকদের অধিকাংশই স্ট্রেসের মধ্যে রয়েছে, কেননা তারা যথেষ্ট খাবার খুঁজে পাচ্ছে না, জেলেদের জালে জড়িয়ে পড়ছে৷ যে সব পুরনো জাল কেটে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিংবা টার্বট ধরার জাল৷ এছাড়া আছে বেআইনি মাছ ধরা৷ কর্তৃপক্ষের তা বন্ধ করার জন্য আরো সচেষ্ট হওয়া দরকার৷''
জেলেদের আইনি বা বেআইনি জালে বহু শুশুক প্রাণ হারায়৷ যে সব ড্রিফ্ট-নেট কেটে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হয়ে দাঁড়ায় গোস্ট নেট বা ভুতুড়ে জাল – ঠিক জলের তলায় ভেসে থাকে, যা শুশুকদের পক্ষে বিশেষভাবে বিপজ্জনক৷ কৃষ্ণসাগরে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার ভুতুড়ে জাল ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অনুমান করা হয়৷ জেলেরা কিন্তু কোনোরকম দায় নিতে রাজি নন৷ ধীবর গিয়র্গি পাইশেভ বলেন, ‘‘আমার মতে জেলেরা কৃষ্ণসাগরের ডলফিনদের সবচেয়ে বড় সমস্যা নয়৷ অন্তত তিন-তিনটি কর্তৃপক্ষ মাছ ধরার তদারকি করেন: সামুদ্রিক প্রশাসন, সীমান্তরক্ষী ও ফিশারিজ অথরিটি৷ সাগরে যা কিছু ঘটছে, সব তারা মনিটরে দেখতে পান৷''
বিশ্বের বিরলতম প্রাণী বাংলাদেশের শুশুক
ডলফিন সাধারণত লবণ পানিতে বাস করে৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশের শুশুক আর আমাজনের ‘বোতো’ এই দুই প্রজাতির ডলফিন সারা বছরই স্বাদু পানিতে থাকে৷ সেদিক দিয়ে শুশুক বিশ্বে খুবই বিরল একটা প্রাণী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খুবই বিরল
ডলফিন সাধারণত লবণ পানিতে বাস করে৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশের শুশুক আর আমাজনের ‘বোতো’ এই দুই প্রজাতির ডলফিন সারা বছরই স্বাদু পানিতে থাকে৷ সেদিক দিয়ে শুশুক বিশ্বে খুবই বিরল একটা প্রাণী৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
বিপন্ন প্রাণী
২৫-৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের নদীগুলোতে অনেক শুশুক বা ডলফিন দেখা যেত৷ কিন্তু এখন আর সেটা যাচ্ছে না৷ তাই ১৯৯৬ সাল থেকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম উঠে গেছে শুশুকের৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
মাছ ধরতে শুশুকের তেল
শুশুকের তেল মাছ ধরার জন্য বেশ কার্যকর৷ তাই জেলেরা গণহারে শুশুক ধরছে৷ এছাড়া জাটকা ধরার জন্য যে কারেন্ট জাল ব্যবহার করেন জেলেরা, তাতেও মারা পড়ছে শুশুকের দল৷ ছবিতে এমনই একটি মৃত শুশুক দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Ingrid Kvale
আবাস ও প্রজননস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে
নদীতে বাঁধ দেয়া, সেতু তৈরি ইত্যাদি কারণে নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শুশুকের আবাস ও প্রজননস্থল৷ এছাড়া যেখানে সেখানে ফেলে রাখা পলিথিন নদীর পানিতে মিশে গিয়েও নষ্ট করছে শুশুকের আবাস৷ শিল্প-কারখানা দূষিত বর্জ্যও শুশুকের শত্রু৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
অভয়ারণ্য ঘোষণা
শুশুক রক্ষায় সরকার দেড় বছর আগে সুন্দরবনের অন্তর্গত ৩১ কিলোমিটার জলজ এলাকায় অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে৷ তবে বাস্তবায়নের কাজ এখনো শুরু হয় নি৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
বিসিডিপি-র উদ্যোগ
বেসরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ সেটাসিয়ান ডাইভারসিটি প্রজেক্ট’ বা বিসিডিপি সরকারের বন বিভাগের সহায়তায় অভয়ারণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে৷
ছবি: shushuk.org
শুশুক মেলা
বিসিডিপি-র উদ্যোগে সুন্দরবন এলাকায় গত চার বছর ধরে শুশুক মেলা হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে শুশুক রক্ষায় জনসাধারণকে সচেতন করার চেষ্টা চলছে৷ গত ফেব্রুয়ারিতে মংলায় হয়ে গেলো মাসব্যাপী চতুর্থ শুশুক মেলা৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
শুশুকপ্রেমী রুবাইয়াত মনসুর
তিনি বিসিডিপি’র প্রধান গবেষক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, জুলাই মাস থেকে অভয়ারণ্য ঘোষিত এলাকার আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে৷ বিশেষ করে জেলেদের বলা হবে তারা যেন মাছ ধরতে এমন জাল ব্যবহার করেন যেটা শুশুকের জন্য ক্ষতিকর হবে না৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব
রুবাইয়াত মনসুর বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ডলফিনের খেলা দেখিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে৷ বাংলাদেশও চাইলে শুশুক দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
কেউ ব্যগ্র নন
আজ ফিশারি কর্তৃপক্ষের মনিটরে কোনো বেআইনি মৎস্যশিকারীকে দেখা যাচ্ছে না৷ তার কারণ: বেআইনি মৎসশিকারীরা তাদের জাল ফেলে উপকূল থেকে ৪০ কি ৫০ সামুদ্রিক মাইল দূরে – যেখানে সরকারের ছোট, ধীরগতির, সমুদ্রযাত্রার অনুপযোগী বোটগুলো পৌঁছাতে পারে না৷ কিন্তু সরকারও যে বেআইনি মাছধরা বন্ধ করতে খুব ব্যগ্র, এমন মনে হয় না৷ মাত্র কয়েকজন পোচার মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে৷ বুলগেরিয়ান ফিশারিজ অথরিটির ডব্রিন লেচেভ বলেন, ‘‘গতবছর আমরা সরকারি কৌঁসুলির হাতে চারটি মামলা তুলে দিয়েছি৷ কিছু কিছু মামলা এখনও চলেছে....আমরা যা দেখি, তার সব কিছু রিপোর্ট করি আর পোচিং পুরোপুরি থামানোর আশা করি৷''
বুলগেরিয়ায় এ যাবৎ একজন পোচারকেও জেলে পাঠানো হয়নি৷ পরিবেশবাদীরা ড্রিফ্ট-নেট ফিশিং নিষিদ্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ সেটাই যে শুশুক মৃত্যুর মূল কারণ, সে বিষয়ে তাঁদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই৷ ‘সেভ কোরাল বিচ' পরিবেশ গোষ্ঠীর আতানাস রুসেভ বলেন, ‘‘এ বছর যে সব শুশুকের লাশ পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, দেখা গেছে, তারা জলে ডুবে মরেছে৷ সেটা শুধু ঘটতে পারে যদি তারা জেলেদের বেআইনি জালে আটকা পড়ে আর বেরোতে না পারে৷''