১৪ বছর আগে বলতে গেলে শূন্য হাতেই শুরু করেছিলেন ফারহানা এ রহমান৷ সেদিনের সেই অচেনা গৃহিণী এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সফল, জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা৷ এক সাক্ষাৎকারে সফল হওয়ার গল্প শুনিয়েছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
ইউওয়াই সিস্টেম্স লিমিটেড এর সিইও ফারহানা এ রহমান৷ বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তিতে সফল কয়েকটি নামের প্রথম দিকেই আসে তাঁর নাম৷ আইটি খাতে বিশেষ অবদানের জন্য দেশসেরা নারী উদ্যোক্তার পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি৷
তাঁর প্রতিষ্ঠান ইউওয়াই-এর কাজ মূলত আউটর্সোসিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং ওয়েবসাইট তৈরি করা৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে ইউওয়াই-এর তৈরি করে দেয়া ই-কমার্স ওয়েবসাইট৷ ইউরোপের ৭ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইটকে রেসপন্সিভ করার কৃতিত্বও ইউওয়াই-এর৷ টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তাঁর এসব অর্জনের চেয়ে অবশ্য অর্জনের পথ রচনার সময় এবং পথ অতিক্রমণের চড়াই-উৎরাইয়ের কথাই বেশি জানতে চাওয়া হয়েছে৷ শত ব্যস্ততার মাঝেও একটু সময় বের করে ডয়চে ভেলেকে সেসব কথা সাবলীলভাবেই বলেছেন ফারহানা এ রহমান৷
গল্পের শুরুটা আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সেই একটা চাকরির পেছনে ছোটা এবং চাকরি জোটার পরই পরিবার এবং সমাজের চোখ রাঙানি সামলে এগিয়ে চলার চ্যালেঞ্জ৷ কিন্তু ফারহানার কাছে সেই চ্যালেঞ্জের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাফল্যের চূড়ায় ওঠার অভিলাষ৷
অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে যাত্রার জন্য দরকার ছিল যুৎসই সূচনা৷ ফারহানা বলছিলেন ১৪ বছর আগে দেশে তেমন কোনো অনুকরণীয় আইটি উদ্যোক্তা ছিল না বলে চ্যালেঞ্জটা অনেক বেশি কঠিন ছিল৷ কঠিন চ্যালেঞ্জটা জয় করলেন কীভাবে?
ডিজিটাল বাংলাদেশ ‘রূপকল্প ২০২১’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে বর্তমান সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করেছিল৷ ইতোমধ্যে জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে৷
ছবি: Munir Hasan
আওয়ামী লীগের ইশতেহার
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’-এর অংশ হিসেবে ‘২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর উদ্ভব৷ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর এ ঘোষণা দেয়া হয়৷
ছবি: dapd
কম পরিশ্রমে, স্বল্প ব্যয়ে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা
ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ যেখানে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সকল সুবিধা ব্যবহার করে অল্প সময়ে, কম পরিশ্রমে, স্বল্প ব্যয়ে, মানুষের দোরগোড়ায় তথ্য ও সেবা পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দান৷
ছবি: D.net/Amirul Rajiv
কৃষিক্ষেত্রে সুবিধা
কৃষিক্ষেত্রেও লেগেছে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া৷ সারাদেশে স্থাপিত প্রায় ২৪৫ কৃষি তথ্য যোগাযোগ কেন্দ্রে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কৃষি সেবা প্রদান করা হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
উন্নত স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র
দশ আঙুলের ছাপ ও চোখের কনীনিকার (আইরিশ) প্রতিচ্ছবি সংগ্রহ করে নিবন্ধিত নাগরিকদের ‘স্মার্ট’ জাতীয় পরিচয়পত্রের পরীক্ষামূলক বিতরণ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে৷ যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে বা যারা ভোটার হওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন, তারা এই ‘স্মার্ট’ এই পরিচয়পত্র পাবেন৷ (এখানে পুরানো পরিচয়পত্রের ছবি)
ছবি: DW/S. Kumar Day
মোবাইল ব্যাংকিং চালু
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সব ধরণের জরুরি সেবাই পাওয়া যায়৷ এ সবের মধ্যে রয়েছে – টাকা জমা, টাকা তোলা ও পাঠানো, বিভিন্ন ধরণের বিল প্রদান (বিদ্যুৎ বিল,গ্যাস বিল,পানি বিল ), কেনাকাটা করা, বেতন ভাতা প্রদান ও গ্রহণ, মোবাইল ফোন টপ আপ ইত্যাদি৷
ছবি: TAUSEEF MUSTAFA/AFP/Getty Images
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেবা
২০ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নির্মাণ ও ল্যাপটপসহ ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা হয়েছে৷ ডিজিটাল কন্টেন্ট শেয়ার করার জন্য ‘শিক্ষক বাতায়ন’ নামে একটি ওয়েবপোর্টাল চালু করেছে সরকার৷
ছবি: Munir Hasan
২২টি কর্মপন্থা
ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ২২ কর্মপস্থা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নে জোর দেয়া হচ্ছে৷ এগুলো হচ্ছে – সরকারি অফিস আদালতে ই-সেবা চালু করা, ই-গভর্নেন্স চালুর মাধ্যমে সরকারি কর্মকাণ্ডের গতি বাড়ানো, ভূমি রেকর্ড ডিজিটাইজেশন, সরকারি সেবাসমূহ ইউনিয়ন অফিস থেকেই প্রদানের ব্যবস্থা, তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়ন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি৷
ছবি: play.google.com
ঘরে বসে অর্থ উপার্জন
আইসিটি খাতে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে বসে অর্থ উপার্জনের ধারণা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে শুরু করেছে৷ বর্তমানে দেশে তরুণ ফ্রিল্যান্সার একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে৷ তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে৷ লাখো তরুণ বিভিন্ন পর্যায়ে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে নিজে সাবলম্বী হয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
ডট বাংলা ডোমেইন
ইন্টারনেট জগতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডোমেইন (ইন্টারন্যাশনালাইজড ডোমেইন নেম-আইডিএন) ডট বাংলা (.বাংলা) ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে বাংলাদেশ৷ ইন্টারনেটে একটি রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করে এই ডোমেইন৷
ছবি: Ministry of Women and Children Affairs
তথ্য আদান-প্রদান
দেশে বর্তমানে নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম রয়েছে৷ স্বল্প খরচে এ সব মাধ্যম ব্যবহার করে অনায়াসেই এক স্থান থেকে আরেক স্থানে তথ্য আদান প্রদান ও ভাবের বিনিময় হচ্ছে৷ ভিডিওতে কথা বলার জন্য রয়েছে একাধিক সফটওয়্যার৷ স্কাইপ, ইমো, ফেসবুক, গুগুল ছাড়াও যে কোনো মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে থ্রি জি প্রযুক্তির সংযোজনের ফলে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সব ধরনের তথ্য ও ভাবের আদান প্রদান করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন, ড্রাইভিং লাইসেন্স
এখন আয়কর রিটার্ন ফরম অনলাইনে পূরণ করা যায়৷ অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রেলওয়ে ও বাস টিকেট
অনলাইনে অনেক সহজে টিকেট কাটা ও সিট বুকিং করা যায়৷ এসএমএস-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক যাত্রীদের জন্য তথ্যসেবা প্রদান করা হয়৷ এছাড়া বাসের টিকেট কাটা যায় অনলাইনেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Warnecke
সব ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগ
২০২০ সালের মধ্যে দেশের সকল ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করার প্রচেষ্টা আছে সরকারের৷ এছাড়া ২০১৮ সালের মধ্যে ব্রডব্যান্ডের সম্প্রসারণ ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
13 ছবি1 | 13
ফারহানা বললেন, ‘‘আমি যখন মাস্টার্স কমপ্লিট করি, সেই সময় দেশে আইটি উদ্যোক্তা ছিল একেবারে হাতে গোনা৷ তো তখন আমিও আর দশজনের মতো চাকরি করার কথা মাথায় রেখেই পথ চলতে শুরু করি৷ কিন্তু নয়টা-পাঁচটা চাকরি সেই সময়ও ডিসকারেজ করা হতো৷ মানে, এতটা সময় বাসার বাইরে থাকা, বিশেষ করে ছোট বাচ্চা থাকলে, খুবই কঠিন৷ আামার সেই সময় ছোট বাচ্চাও ছিল৷ বাচ্চার বয়স তখন দেড় বছর৷আমি সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছিলাম৷ একটা প্রতিষ্ঠানে জয়েনও করেছিলাম৷''
কিন্তু বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সাবেক সভাপতি জানালেন, ছোটবেলা থেকেই নিজে থেকে কিছু করার আগ্রহটা ছিল প্রবল, সৃষ্টিশীল কাজ খুব টানতো তাঁকে৷ তাই নয়টা-পাঁচটার চাকরিটা ঠিক উপভোগ করতে পারছিলেন না৷ থেকে থেকেই মন যেন বলছিল, ‘হেথা নয় , হেথা নয়, অন্য কোথা , অন্য কোনখানে'৷ অল্পদিনেই জানলেন সেই ‘অন্য কোথা' হতে পারে আউটসোর্সিং৷
‘‘ভারতে তখন খুবই আলোচিত বিষয় ছিল ‘আউটসোর্সিং' এবং ‘ডটকম বিজনেস'৷ কিন্তু বাংলাদেশে এরকম কিছুই সেই সময় ছিল না৷''
ফারহানা এ রহমান
তাই বলে তো বসে থাকলে হবে না৷ খুব ছোট পরিসরে হলেও নিজেই কিছু একটা করবেন ভেবে শুরু করলেন তার প্রস্তুতি৷ আইটি-তে প্রশিক্ষণ নিলেন৷ তারপর একদম সময় নষ্ট না করে ঘরে বসেই শুরু করলেন কাজ৷ সম্বল শুধু একটা কম্পিউটার, নিজের সদ্য লাভ করা জ্ঞান আর আশৈশব লালন করে আসা অসীম আগ্রহ৷ তা দিয়েই একপা-দু'পা' করে এগোতে এগোতে ফারহানা এ রহমান আজ বাংলাদেশের আইটি জগতের খুব চেনা-জানা নাম৷ কর্মসূত্রে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত এবং জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত এক উদ্যোক্তা৷ অডিও সাক্ষাৎকারটি শুনে জেনে নিন তাঁর শূন্য থেকে দেশসেরা হওয়ার গল্প৷