মুক্তিযুদ্ধ তালিকার মতো, রাজাকার তালিকা নিয়েও এরই মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷ এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিভিন্ন পক্ষের বাকযুদ্ধও৷
ছবি: National Monument of Savar
বিজ্ঞাপন
সরকারের হাতে থাকা নথির তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সরকার একাত্তরের সেই স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের প্রথম তালিকা প্রকাশ করা হয় বুধবার৷ এরই মধ্যে এই তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা বাবার নাম থাকার অভিযোগ করেছেন বরিশালের বাসদ নেত্রী ডা. মনীষা চক্রবর্ত্তী৷
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশেও অনেক রাজাকার রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ভাষাসৈনিক আবদুল গাফফার চৌধুরী৷ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘‘এখনো রাজাকার আছে৷ অনেক রাজাকার আছে৷ এমনকি আমাদের জননেত্রী শেখ হাসিনার আশপাশেও আছে৷ তাদের নাম বললে আমার আর ঢাকায় আসা হবে না৷ তাই আমি নাম বলতে চাই না৷''
যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে না পারলে রাজাকারদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না বলেও মনে করেন গাফফার চৌধুরী।
তবে স্বাধীনতাবিরোধীদের বংশধরদের সঙ্গে কোনো আপস করা হবে না বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ওবায়দুল কাদের৷ ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে, দলে ‘অনুপ্রবেশকারীদের' আগামী সম্মেলনের মাধ্যমে 'বের করে দেওয়া হবে' বলেও মন্তব্য করেছেন ওবায়দুল কাদের৷ জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন৷
যেমন করে রাজাকার নামটি ঘৃণিত হলো
রাজাকার বাংলাদেশে এখন এক ঘৃণিত শব্দ৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে এই বাহিনী গঠন করেছিল পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক সরকার৷ পরবর্তীতে তারা হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িয়ে পড়ে৷
ছবি: DW/M. Mamun
শব্দটি যেভাবে এল
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী রাজাকার ফারসি শব্দ৷ যার অর্থ স্বেচ্ছাসেবী৷ ১৯৪০ এর দশকে ভারতের হায়দ্রাবাদের নিজাম ওসমান আলী খানের শাসনামলে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন কাসেম রিজভী৷ এই বাহিনীর নাম দেয়া হয়েছিল রাজাকার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Desfor
পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনী
হায়দ্রাবাদের সেই সশস্ত্র বাহিনীর অনুকরণেই ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার৷ মে মাসে খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন কর্মী নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলা হয়৷ ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান মো. ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়৷ শুরুতে ১০টি জেলায় ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাদের রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
শান্তি কমিটি থেকে সেনাবাহিনী
বাংলাপিডিয়া বলছে, ‘‘প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন৷ ১৯৭১ সালের ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন৷ এর নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তানপন্থী স্থানীয় নেতাদের হাতে৷ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত অধ্যাদেশে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনী সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়৷’’
ছবি: AP
প্রশিক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন৷ ১৯৭১ সালের ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় এই বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়৷ ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে সাভারে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন জেনারেল এ.কে নিয়াজি৷ পরবর্তী পর্যায়ে এই বাহিনীকে একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদা দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
রাজাকারের সংখ্যা
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস এর গবেষণা অনুযায়ী রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো৷ জেনারেল নিয়াজী তার বইতে এই সংখ্যা উল্লেখ করেছেন৷ স্বাধীনতার পর রাজাকারদের বিচারে ৩৭ হাজার জনের একটি তালিকা করা হয় বলে জানা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
‘দুষ্কৃতকারী’ নিধন
পাকিস্তানপন্থী পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হত ভারতীয় চর, দুষ্কৃতকারী হিসেবে৷ ‘রাজাকররা ৭০ জন দুষ্কৃতকারী হত্যা করেছে’, ‘ভারতীয় চরকে নির্মূল করেছে’, এমন শিরোনামে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ে বলা হয়েছে, ‘‘তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় গ্রামে-গঞ্জে অত্যাচার, নির্যাতন এবং সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী পথপ্রদর্শক৷’’
ছবি: Adnan Sadeque
আলবদরের সঙ্গে পার্থক্য
সেপ্টেম্বরে নিয়াজী গড়ে তোলেন আরেকটি আধা সামরিক বাহিনী আলবদর৷ বাংলাপিডিয়ায় মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘‘রাজাকারদের কার্যকলাপের সঙ্গে খানিকটা পার্থক্য ছিল আল-বদর বাহিনীর৷ রাজাকাররা সামগ্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরোধিতা করেছে৷ কিন্তু আল-বদর বাহিনীর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক হত্যার মাধ্যমে নিরীহ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা৷ পাকিস্তান বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করা ছিল তাদের অন্যতম লক্ষ্য৷’’
ছবি: Journey/A. Hoque
‘তুই রাজাকার’
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক বহুব্রীহি৷ সেখানে একটি টিয়া পাখিকে ‘তুই রাজাকার’ বলতে শোনা যায়৷ এই সংলাপ পরবর্তীতে রূপ নেয় রাজাকারদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের স্লোগানে৷ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতেও ব্যবহার হয়েছে এই শব্দগুচ্ছ৷
তবে এই তালিকা পুরোটাই ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে' বলে মনে করে বিএনপি৷ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, "বিএনপিকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এই সমস্ত তালিকা তারা প্রকাশ করেছে৷''
রাজাকারের তালিকায় নাম রয়েছে আবদুর রহমান বিশ্বাসের৷ ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে তাকে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিল বিএনপি৷ জিয়াউর রহমানের শাসনামলের প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের নামও রয়েছে রাজাকারের তালিকায়৷
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা নিজেরা কোনো তালিকা প্রস্তুত করিনি৷ এই তালিকা আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পেয়েছি৷ যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও তালিকাটি করেনি৷ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছিল, সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ছিল৷ আমরা শুধু তা প্রকাশ করেছি৷ সেখানে কার নাম আছে, আর কার নাম নেই সেটা আমরা বলতে পারব না৷''