শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৫৮৩
১২ নভেম্বর ২০২৫
এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে মোট ৫৮৩টি মামলা দায়ের হয়েছে৷ এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত দায়ের হওয়া ২৭টি মামলা আছে৷ সবকটিতে শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে৷
৫৮৩টি মামলার মধ্যে ৩২৪টি হত্যা মামলা৷ এছাড়া দুদকের করা মামলা আছে সাতটি৷
পুলিশ সদরদপ্তরের এক হিসাবে দেখা গেছে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন পরবর্তী সারা দেশে ১ হাজার ৬০২টি মামলা দায়ের হয়েছে৷ এসব মামলায় হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হামলা ভাঙচুর, মারধর, অগ্নিসংযোগ, ভয়ভীতি প্রদর্শন, লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ করা হয়েছে৷ এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৫৯৯টি আর অন্যান্য মামলা হয়েছে এক হাজার তিনটি৷ এর মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারা দেশের থানা ও নিম্ন আদালতে ৩২৪টি হত্যা মামলাসহ মোট ৫৭৬টি মামলা দায়ের হয়েছে৷
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলার শুনানি শেষ হয়েছে৷ সেটির রায়ের তারিখ জানা যাবে বৃহস্পতিবার৷ এর বাইরে গুম সংক্রান্ত একটি মামলায় চার্জশিট হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে৷ সেটির শুনানি এখনও শুরু হয়নি৷ এছাড়া বেশ কয়েকটি মামলার তদন্ত কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে৷ সেগুলোতে পর্যায়ক্রমে চার্জশিট দেওয়া হবে৷''
শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন আইনি লড়াই করেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমি আশা করি, যে তথ্য উপাত্ত দিয়েছি তাতে শেখ হাসিনা খালাস পাবেন৷''
শেখ হাসিনার পক্ষে কেউ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কী না জানতে চাইলে আমির হোসেন বলেন, ‘‘শেখ হাসিনা বা তার পক্ষে কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি৷ তারা কোনো তথ্য উপাত্তও আমাকে সরবরাহ করেনি৷ রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যা পেয়েছি সেটা এবং নিজের আইনজীবী জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি শেখ হাসিনার পক্ষে ডিফেন্স করেছি৷''
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ
বৃহস্পতিবার যে মামলার রায়ের তারিখ জানা যাবে সেই মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও অন্য দুইজন আসামি আছেন৷ তারা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন৷ এর মধ্যে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী হয়েছেন৷ চৌধুরী মামুন বর্তমানে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন৷ বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর অপর দুই সদস্য বিচারক হলেন মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী৷
জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে যৌথ দায় হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে৷ ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার৷ এক নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, গতবছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আসামি শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান এবং নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধসমূহ সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী৷ শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন৷ এই মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায় হিসেবে তার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে প্রসিকিউশন৷ এই মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিতে পারেন আদালত৷
চলতি বছরের ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়৷ এ মামলায় ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য এবং ৪ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করা হয়েছিল৷
বিচার প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ হচ্ছে?
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্বচ্ছ এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, এখন দেশে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দৃঢ়তার সঙ্গে এ ধরনের পদক্ষেপকে রুখে দেবে বলে তার বিশ্বাস৷ বুধবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন৷
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রসিকিউটর মিজানুল বলেন, তিনি নিঃসন্দেহে বলতে পারেন যে স্বচ্ছ এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে একটা প্রোপাগান্ডার অংশ হিসেবে তারা এটা বলছে৷
এখন বাইরে যেগুলো (বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরিত প্রভৃতি) হচ্ছে, এগুলো ‘থ্রেট টু জাস্টিস' (ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি) কী না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর মিজানুল বলেন, তিনি থ্রেট টু জাস্টিস মনে করেন না৷ তবে তারা এই বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য করছে, এটুকু বলতে পারেন৷
একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, বৃহস্পতিবার কি রায়ের তারিখ পাওয়া যাবে, নাকি আবার অপেক্ষায় থাকতে হবে, এ রকম একটা গুঞ্জন আছে? এর জবাবে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, রায় দেওয়া, রায়ের দিন নির্ধারণ করার এখতিয়ার পুরোপুরি ট্রাইব্যুনালের৷ তবে তারা বিশ্বাস করেন যে বৃহস্পতিবার রায়ের তারিখ পাওয়া যাবে৷
আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর মিজানুল বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল কোনোভাবেই কোনো বৈদেশিক ট্রাইব্যুনাল বা সংস্থা বা সরকার কারও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়৷ বিচারের ক্ষেত্রে বিচারকেরা স্বাধীন৷ এমনকি কোনো প্রসিকিউশনের কোনো বক্তব্য শুনতে বা প্রসিকিউশন যদি বলেন এটা করেন, তা করতে বিচারকেরা করতে বাধ্য নন৷
তবে প্রবীণ আইনজীবী জেড আই খান পান্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিচার প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ হচ্ছে সেটা দেশের মানুষের সঙ্গে আমিও দেখছি৷ এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না৷ তবে যদি কোনোদিন পট পরিবর্তন হয়, আওয়ামী লীগ ফিরে আসে তাহলে এই রায় টিকবে না৷ যেভাবে ড. ইউনূস আসার সঙ্গে সঙ্গে তার মামলা বাতিল হয়ে গেল৷ সেই কারণে কী সাজা হলো বা হলো না সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না৷ আমি এই বিচারকে গুরুত্ব দিচ্ছি না৷''
শেখ হাসিনার ছয় মাসের কারাদণ্ড
গত জুলাই মাসে আদালত অবমাননার একটি মামলায় শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আদেশ দেন৷ ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী৷ এই মামলার অপর আসামি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের শাকিল আকন্দ বুলবুল ওরফে মো. শাকিল আলমকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল৷ অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়৷ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই প্রথম কোনো মামলায় শেখ হাসিনার কারাদণ্ড হলো৷
কয়েক মাস আগে ‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি' -এমন একটি অডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে৷ অডিওর এ বক্তব্য শেখ হাসিনার উল্লেখ করে তিনি ও শাকিল আকন্দ বুলবুলের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার মামলা করে প্রসিকিউশন৷ সেই মামলায় চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করা হয়৷
রায়ের পর সাংবাদিকদের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, সাবমিশনে তারা বলেছিলেন, শেখ হাসিনার তর্কিত যে কনভারসেশন, সেটি পুলিশের সিআইডির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে৷ তারা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিয়েছে, এখানে যে দুজন ব্যক্তির কনভারসেশন, তার একজন শেখ হাসিনা ও অন্যজন শাকিল আকন্দ বুলবুল৷ কনভারসেশনটি এআই জেনারেটেড নয়৷ অর্থাৎ প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা হয়নি৷ এটি জেনুইন একটি কনভারসেশন৷
‘রাষ্ট্রদ্রোহ', বিচারের জন্য প্রস্তুত আরেকটি মামলা
শেখ হাসিনাসহ ২৮৬ জনের বিরুদ্ধে ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে' অংশ নেওয়ার অভিযোগে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়ায় তা বিচারিক আদালতে বদলি করা হয়েছে৷ মঙ্গলবার ঢাকার মহানগর হাকিম ইশরাত জেনিফার জেরিন এ আদেশ দেন৷ তিনি বিচারের পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলির আদেশ দেন৷ ‘জয় বাংলা ব্রিগেড' এর জুম মিটিংয়ে অংশ নিয়ে তারা সরকারকে ‘উৎখাতের' চেষ্টা করেন বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়৷
সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. সালাহউদ্দিন বলেন, মামলায় ভারতে অবস্থান করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৬১ জন পলাতক৷ তাদের আদালতে হাজিরের জন্য গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হওয়ার প্রতিবেদন এসেছে৷ এরপর মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়ায় তা বিচারিক আদালতে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে৷