চীন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতাকে সমর্থন করে বলে জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং৷
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, এই বিরোধিতার মাধ্যমে দেশটি যাতে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখে উন্নয়ন ও প্রাণসঞ্চার করতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে গতকাল বুধবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
শি জিনপিং বলেন, 'চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব রয়েছে। উভয় পক্ষ ২০১৬ সালে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে উন্নীত করেছে। বিষয়টি ২ দেশের সহযোগিতাকে আরও গভীর করার বিষয়টিকে নির্দেশ করে।'
তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার দেশের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে যোগদানের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, 'চীন বাংলাদেশের সঙ্গে বহুপাক্ষিক বিষয়ে সমন্বয় ও সহযোগিতা জোরদার করতে এবং আন্তর্জাতিক সমতা ও ন্যায়বিচারের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে ইচ্ছুক।'
শেখ হাসিনা প্রশংসা করেন, বাংলাদেশের কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অমূল্য সহায়তা দিয়েছে চীন, যা বাংলাদেশের উন্নয়নে এবং মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতিতে সাহায্য করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, 'বাংলাদেশ-চীনের সুসম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।'
বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে এবং ব্রিকসের মতো বহুপাক্ষিক ব্যবস্থায় সহযোগিতা জোরদার করতে প্রস্তুত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে এক চীন নীতি মেনে চলে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করে।'
২২-২৪ আগস্ট চলমান ১৫তমে ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে ২২ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সোমবার (২১ আগস্ট) মধ্যরাতে দক্ষিণ আফ্রিকা পৌঁছান।
দুই রাস্ট্রপ্রধানের মধ্যকার এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে আরও উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা অটিজম অ্যান্ড নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন সায়মা ওয়াজেদ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
আজ বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ফ্রেন্ডস অফ ব্রিকস লিডারস ডায়ালগে (ব্রিকস-আফ্রিকা আউটরিচ এবং ব্রিকস প্লাস ডায়লগ) বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখবেন।
এসএইচ/কেএম (দ্যা ডেইলি স্টার)
বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণে ব্রিকস
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর বিশ্বের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মেরুকরণে নতুন আলোচনায় ‘ব্রিকস’৷ পাঁচ দেশের এই জোট এখন আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে৷ যার নতুন সদস্য হতে পারে বাংলাদেশও৷ ব্রিকসের আদ্যোপান্ত ছবিঘরে৷
ছবি: Fang Zhe/Xinhua/IMAGO
নামকরণের ইতিহাস
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন; বিশ্বের দ্রুত বেড়ে চলা অর্থনীতির চার দেশ৷ তাদের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে ২০০১ সালে প্রথম ‘ব্রিক’ শব্দটি ব্যবহার করেন মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাক্সের সেসময়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিল৷ ধারণাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় দেশগুলোও৷ ২০০৬ সালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সম্মেলন চলাকালীন পুটিনের উদ্যোগে চার দেশের মন্ত্রীরা জোটের কার্যক্রম নির্ধারণে আলোচনায় বসেন৷
ছবি: Pavel Golovkin/AP Photo/picture alliance
সাউথ আফ্রিকার অন্তর্ভূক্তি ও ব্রিকস
২০০৯ সালে রাশিয়ায় ব্রিকের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ ২০১০ সালের ডিসেম্বরে সাউথ আফ্রিকা জোটে যোগ দেয়ার ঘোষণা দেয়৷ এর মাধ্যমে ব্রিক পরিণত হয় ব্রিকস-এ৷ ব্রিকের তৃতীয় আর পাঁচ দেশ নিয়ে প্রথম সম্মেলনটি হয় ২০১১ সালে বেইজিং-এ৷ তার আগে ২০১০ সালে দ্বিতীয় সম্মেলনটি বসেছিল ব্রাসিলিয়াতে৷
২০০৯ সালে ব্রিক দেশগুলোর নেতাদের সম্মেলন শেষে একটি যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়৷ তাতে বলা হয়, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পাশাপাশি পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধি অর্জনে কাজ করবে তারা৷ তবে বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আধিপত্য বজায় রাখা উন্নত দেশগুলোর জোট জি-সেভেন এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই এই জোট নিয়ে মাঠে নামে চীন ও রাশিয়া৷
ছবি: Wu Hong/AP Images/picture alliance
কতোটা শক্তিশালী ব্রিকসের অর্থনীতি?
ব্রিকস বর্তমানে বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে অন্যতম বৃহৎ শক্তিশালী জোট৷ কিছু পরিসংখ্যানে সেই চিত্র পাওয়া যায়৷ জাতিসংঘের বিনিয়োগ বিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই পাঁচ দেশের সম্মিলিত জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ৷ বিশ্বের অর্থনৈতিক জিডিপির ৩১ শতাংশ বা এক তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রক তারা৷ বিশ্ব বাণিজ্যেরও ১৬ শতাংশ পাঁচটি দেশের দখলে৷
ছবি: AP
নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক
বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা এই পাঁচ দেশ ২০১৪ সালে বিশ্ব্যাংকের আদলে ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ গঠন করে৷ চীনের সাংহাইয়ে এর প্রধান কার্যালয়৷ ব্যাংকটি ৫০ বিলিয়ন ডলারের ‘সিড মানি’ বা প্রাথমিক মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে৷ তবে পাঁচ দেশের বাইরেও এর সদস্য হওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখা হয়৷ বিভিন্ন প্রকল্পে এখন পর্যন্ত তাদের অনুমোদিত অর্থায়নের পরিমাণ তিন হাজার ২৮০ কোটি ডলার৷
ছবি: Ji Haixin/MAXPPP/dpa/picture alliance
বাংলাদেশের সদস্যপদপ্রাপ্তি
ব্যাংকটির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ দেশের বাইরে ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রথম নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হয়৷ একই বছরের চার অক্টোবর সদস্য হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত৷ আর ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নতুন সদস্য হয়েছে মিশর৷ সম্ভাব্য সদস্য হিসেবে উরুগুয়ের নাম রয়েছে৷
ছবি: Wang Gang/Costfoto/picture alliance
ডলারকে হুমকি
আগস্টে ব্রিকসের ১৫ তম সম্মেলন বসবে সাউথ আফ্রিকায়৷ ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়টি এই বৈঠকের অন্যতম আলোচ্য হতে যাচ্ছে। ডলারের পরিবর্তে কিভাবে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন করা যায় তার একটি রূপরেখা তুলে ধরা হতে পারে এই বৈঠকে৷ কার্যকর বিকল্প চালু করতে পারলে তা বিশ্ব অর্থনীতির একচ্ছত্র মুদ্রা ডলারের আধিপত্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷
ছবি: Khaled Elfiqi/epa/dpa/picture alliance
বাংলাদেশের সদস্যপদ
আগস্টের এই বৈঠক থেকে ব্রিকসের নতুন সদস্যের ঘোষণা আসতে পারে৷ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি জেনেভায় শ্রম সম্মেলনে এসে সাংবাদিকদের বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন৷ তাছাড়া, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের আরো কয়েকটি বৃহৎ অর্থনীতির দেশও ব্রিকসের সদস্য হতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি৷ এর ফলে ব্রিকস হয়ে উঠতে পারে ‘ব্রিকস প্লাস’৷
ছবি: DW
জি -৭ এর প্রতিদ্বন্দী?
জিডিপির আকারের দিক থেকে ব্রিকস এরইমধ্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-সেভেনকে পেছনে ফেলেছে৷ জি -সেভেন যেখানে বিশ্বের উত্তরের দেশগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করছে, ব্রিকস সেখানে উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে একত্রিকে করে একটি প্লাটফর্ম করার চেষ্টা করছে৷ যে কারণে ব্রিকস বিশ্ব অর্থনীতিতে জি-সেভেন এর প্রভাব কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন অনেকে, যা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হতে পারে৷
ছবি: Susan Walsh/AP Photo/picture alliance
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মেরুকরণ
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক মেরুকরণের প্রভাব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ এমন বাস্তবতায় এক যুগেরও বেশি আগে যাত্রা করা ব্রিকসকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করেছেন অনেকে৷ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলো ক্রমেই ব্রিকস জোটে ভিড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷