বাংলাদেশে সর্বশেষ ‘নৈতিক বিবেচনায় দুর্বল' নির্বাচনে জয়ের পর উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাহস হারিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এমনটাই মনে করেন হত্যার হুমকিতে থাকা এক মুক্তমনা ব্লগার৷
বিজ্ঞাপন
ব্লগার ইব্রাহিম খলিল ব্লগে লেখালেখি করেন সবাক নামে৷ এই নামেই পরিচিত তিনি৷ ২০০৮ সালে ইন্টারনেটে লেখালেখি শুরু করা এই ব্লগার একাধিকবার হত্যার হুমকি পেয়েছেন৷ বাংলাদেশে নাস্তিকতার পক্ষে এবং মৌলবাদ, ধর্মীয় রাজনীতি ও ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধে লেখালেখি করা ব্লগারদের মধ্যে অন্যতম তিনি৷
৩১ বছর বয়সি এই ব্লগার ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন বাংলাদেশে সাম্প্রতিক যেসব ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্টদের হত্যা করা হয়েছে, সেসব হত্যাকাণ্ডের পেছনের সম্ভাব্য কারণ৷ পাশাপাশি এ সব হত্যাকাণ্ড রুখতে ব্যর্থ হওয়ায় করেছেন সরকারের সমালোচনা৷
ডয়চে ভেলে: উগ্র মৌলবাদীদের একাধিক কথিত ‘হিটলিস্টে' আপনার নাম প্রকাশ হয়েছে৷ এবং সেসব লিস্টের কয়েকজনকে ইতোমধ্যে হত্যাও করা হয়েছে৷ এ রকম একটি পরিস্থিতিতে আপনার জীবন কেমন কাটছে?
নিরাপত্তা নিয়ে যা ভাবছে দেশের মানুষ
বাংলাদেশে একের পর এক মুক্তমনা, ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও ভিন্ন ধর্মের মানুষ খুন হচ্ছে৷ পুলিশ এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললেও, দেশের মানুষ খুব উদ্বিগ্ন৷ ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে রিকশা চালক – আজ কতটা নিরাপদ আমরা?
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
আব্দুল্লাহ রিফাত, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ রিফাত৷ তার মতে, বাড়ি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় – কোথাও তেমন নিরাপদ না কেউই৷ তবে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে তিনি ভাবছেন না এই মুহূর্তে৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
নাফিউল হাসান, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিউল হাসান মনে করেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউই নিরাপদ নয়৷ আমরা একরকম ভয়ের মধ্যেই বসবাস করছি৷ যতক্ষণ বাইরে থাকি, বাসায় অভিভাবকরা চিন্তায় থাকেন৷ অনেক সময় তো স্বাভাবিক ঘোরাফেরাও বন্ধ করতে হচ্ছে৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
প্যারিস তালুকদার, তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া প্যারিস তালুকদার মনে করেন, গত দুই বছরের আগ পর্যন্ত নিজের নিরাপত্তা নিয়ে কখনো ভাবিনি, গভীর রাত পর্যন্তও ঘুরে বেড়াতাম বিভিন্ন জায়গায়৷ তবে গত দিনগুলোর নানান ঘটনায় আমার নিজেরই খুব ভয় হয়৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
ফারিয়া রিফাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী
বেশ নির্ভিক টাইপের মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ফারিয়া রিফাত৷ কিন্তু দেশের বর্তামান পরিস্থিতিটা তার কাছে খুবই ঘোলাটে মনে হচ্ছে৷ প্রত্যেক দিনই বড় কোনো অঘটন ঘটছে৷ পত্রিকা খুললেই খুন-খারাবির খবর, মনে হচ্ছে ‘মার্ডার’ করাটা এখন সহজ ক্রাইম৷ আমরা প্রত্যেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি৷ ঘর থেকে বেড়িয়ে আবার যে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারব, এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
আরিফ জেবতিক, ব্লগার
ব্লগার আরিফ জেবতিক বললেন, ‘‘নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই আছি৷ ব্যক্তিগতভাবে যে যেভাবে পারছি সাবধানে থাকার চেষ্টা করছি৷ জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন আনতে হয়েছে৷ এই যেমন, ‘পাবলিক প্লেসে’ যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি৷ সিনেমা দেখতাম, নাটক দেখতাম, জগিং করতাম৷ এখন এগুলো আর করতে পারি না৷ যেহেতু পরিস্থিতির কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই, তাই এভাবেই সাবধানে থাকতে হচ্ছে৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
হযরত আলী, ব্যবসায়ী
পুরনো ঢাকার ব্যবসায়ী হযরত আলী৷ তাঁর মতে, দেশের কোনো শ্রেণির মানুষেরই নিরাপত্তা নেই৷ দিনে-দুপুরে খুন-খারাবি চলছে৷ তাই দিন কিংবা রাত – কখনোই নিরাপদ নই আমরা৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
হারিছ মিয়া, ফল ব্যবসায়ী
মাদারীপুরের হারিছ মিয়া গত প্রায় ১৭ বছর ধরে ঢাকায় ফলের ব্যবসা করেন৷ গত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে খুন-খারাবি বেড়ে যাওয়ায় খুবই চিন্তিত তিনি৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
আক্কাস আলী, দিনমজুর
পুরনো ঢাকায় ঠেলাগাড়ি চালান আক্কাস মিয়া৷ জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সময় নেই তাঁর৷ আপাতত সন্তানদের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে পালেই সন্তুষ্ট তিনি৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
আব্দুর রহমান, রিকশা চালক
লালমনির হাটের আব্দুর রহমান ঢাকায় রিকশা চালান গত প্রায় ছ’বছর ধরে৷ জীবনের নিরাপত্তার চেয়েও তাঁর কাছে বেশি চিন্তার বিষয় ছিনতাই৷ রাস্তায় থাকা হয় বলে প্রতিনিয়ত অনেক ছিনতাইয়ের সাক্ষী তিনি্৷ কিন্তু জীবনের ভয়ে সেগুলোর প্রতিবাদ না করে নিরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করতে হয় তাঁকে৷ কিন্তু এতে খুবই মনোকষ্টে ভোগেন বিদ্যালয়ের প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে না পারা এই রিকশা চালক৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
আবুল কালাম, অটোরিকশা চালক
শেরপুরের আবুল কালাম অটোরিকশা চালান ঢাকা শহরে৷ তাঁর কথায়, দেশে কোনো নিরাপত্তা নেই৷ যে যেভাবে পারছে খুন-খারাবি করে যাচ্ছে৷ অপরাধীরা থাকছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷ অনেকে ধরা পড়ার খবর শুনলেও তাদের বিচারের আর কোনো খবর পান না বলে জানালেন এই অটোরিকশা চালক৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
10 ছবি1 | 10
সবাক: কথিত হিটলিস্টেরও আগে যখন ২০১৩ সালের ১৪ জানুযারি ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা হয়, তখনই বুঝে ফেলেছি এটা একমাত্র ঘটনা নয়, বরং ঘটনার শুরু৷ বুঝতে পারি আসিফ যেহেতু আক্রান্ত হয়েছে, আরো অনেকে হবে, আমিও হবো৷ ধারণা মিথ্যা ছিল না৷ আক্রমণের ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হলেন ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন৷ শোভনের মৃত্যুর পর তাকে নাস্তিক আখ্যায়িত করে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সমর্থিত মিডিয়া তার খুনকে বৈধ প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগে৷ এ সময় টানা কয়েকদিন চারটি দৈনিক পত্রিকায় আমিসহ কয়েকজন ব্লগারকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড' নাস্তিক পরিচয় দিয়ে আমাদের ছবিসহ সংবাদ প্রচার হতে থাকে৷ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবিতে চট্টগ্রামে মিছিল বের করে হেফাজতে ইসলাম৷ ফাঁসির দাবিতে স্লোগানসহ মিছিলের ব্যানারে আমি ও আরো তিনজন ব্লগারের ছবি ব্যবহার করে৷ এ সব দেখে চূড়ান্তমাত্রার সতর্ক হই৷ সেই থেকে আজ পর্যন্ত নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেইনি৷ কিন্তু জীবনটা অস্বাভাবিক হয়ে গেল৷
রক্ষণশীলরা দাবি করেন, ব্লগাররা ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেন এবং তীব্র ইসলামবিরোধী৷ এই যে বক্তব্য, এটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
আমার কৈশোরের বাংলাদেশ এমন ছিল না৷ গ্রামের অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান জনগোষ্ঠী৷ শিক্ষক এবং বন্ধুদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু৷ আমরা বন্ধুরা ধর্ম নিয়ে অনেক ঠাট্টা করতাম৷ কখনো কাউকে রাগতে দেখিনি৷ এখন যে ভয়াবহ মাত্রার ধর্মানুভূতি দেখতে পাচ্ছি, এটা মৌলবাদীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফল৷ তারা জঙ্গিপনাকে মাদ্রাসা শিক্ষার বাইরে এনে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে৷ দেশের মানুষকে আত্মপরিচয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে৷ এ দেশের মানুষ এখন যতটা না বাঙালি, তারচেয়ে বেশি মুসলাম কিংবা হিন্দু৷ সর্বশেষ যখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলও এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে, তখন সবকিছু শেষ হয়ে গেছে৷ এখন ব্লগার কিংবা কোনো প্রগতিশীল মানুষ মারা গেলেই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই বসে থাকে একটি তথ্যের জন্য, নিহত ব্যক্তি ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করেছেন কিনা৷ এটা অসহ্য৷
বাংলাদেশে আবারো মুক্তমনাদের হত্যা শুরু
গতবছর চার ব্লগার এবং একজন সেক্যুলার প্রকাশককে হত্যার পর কিছু দিন বিরতি ছিল৷ কিন্তু চলতি বছর আবারো শুরু হয়েছে মুক্তমনাদের উপর আঘাত৷ চলতি মাসেই তাতে নিহত চারজন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S.Ramany
নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ড
গত ৮ এপ্রিল ঢাকায় খুন হন সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় সদস্য নাজিমুদ্দিন সামাদ৷ গতবছর ব্লগারদের যেভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে ঠিক সেভাবেই সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করে ফেলে রেখে যাওয়া হয়৷ উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠী ‘আনসার আল ইসলাম’৷
ছবি: Facebook/Nazimuddin Samad
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খুন
গত ২৩ এপ্রিল রাজশাহীতে খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী৷ বাড়ি থেকে মাত্র কয়েকগজ দূরে বাসস্টান্ডে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে মোটর সাইকেলে পালিয়ে যায় দুই দুর্বৃত্ত৷ তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: DW/A. Islam
রূপবানের সম্পাদক খুন
বাংলাদেশে সমকামীদের একমাত্র পত্রিকা রূপবানের সম্পাদক জুলহাস মান্নানকে হত্যা করা হয় তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে প্রবেশ করে৷ কমপক্ষে ছয় দুর্বৃত্ত কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী পরিচয় দিয়ে তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে৷ আর তারপর হত্যাকাণ্ড ঘটায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S.Ramany
সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট মাহবুব তনয় খুন
সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট এবং মঞ্চকর্মী মাহবুব তনয় ছিলেন মান্নানের বন্ধু৷ তাঁকেও ঐ একইসময়ে হত্যা করা হয়৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার আল-ইসলাম’ দু’টি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে জানিয়েছে, বাংলাদেশে সমকামিতার প্রসারে ভূমিকা রাখায় তাঁদের খুন করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S.Ramany
4 ছবি1 | 4
সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের কারণে ব্লগারদের লেখালেখিতে কোনো ধরনের পরিবর্তন কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন? বিশেষ করে ‘সেল্ফ সেন্সরশিপ' কি দেখা যাচ্ছে?
বাংলাদেশে যারা বসবাস করছে, তাদের মাঝে হতাশ হওয়ার মত সেল্ফ সেন্সরশিপ দেখা যাচ্ছে৷ সেন্সরশিপ হবে না কেন? ব্লগারদের পাশে কেউ নেই৷ সবাই সাহস হারিয়েছে৷ আবার যেসব ব্লগার সাম্প্রতিক সময়ে নিরাপদ জীবনের উদ্দেশ্যে সুশাসন আছে এমন দেশে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের সাহস বেড়েছে কয়েকগুণ৷ তারা এখন অনেক বেশি শাণিত এবং ক্ষুরধার৷ একটুখানি নিরাপত্তা একজন ব্লগারকে কতটুকু সাহসী করে তুলতে পারে, তা বিদেশে অবস্থানরত ব্লগারদের দেখলে বোঝা যায়৷ বাংলাদেশ সরকার যদি ব্লগারদের সামান্য নিরাপত্তা দিতে পারতো, অন্তত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতো, তাহলে এই লড়াইয়ের মাধ্যমে ব্লগাররা বাংলাদেশকে ৫০ বছর সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতো৷
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে একধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে বলে মনে করেন অনেকে৷ মুক্তমনাদের উপর গত দু'বছর ধরে যে হামলা চললে তার সঙ্গে এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক কি আপনি খুঁজে পান?
অবশ্যই সম্পর্ক আছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অতীতের জন্য তাঁকে সবাই সাহসী হিসেবে চিনেন৷ কিন্তু তিনি এখন ক্লান্ত৷ কারণ তিনি সাহস হারিয়েছেন৷ সাহস হারিয়েছেন, কারণ তাঁর আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকছে৷ আত্মবিশ্বাস নেই, কারণ দেশের জনগণ তার পাশে আছে কিনা, তিনি নিশ্চিত নন৷ আর এই অনিশ্চয়তার কারণ হচ্ছে ভোট ও ভোটারহীন নির্বাচন৷ প্রধানমন্ত্রী জানেন, তার ১৫৩ জন এমপি বিনা ভোটে নির্বাচিত৷ বাকি ১৪৭ জনের কোনো শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল না৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন দুর্বল জনপ্রতিনিধি নিয়ে তিনি জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করার কথা চিন্তাও করতে পারেন না৷ কারণ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বিষয়টা তার চিন্তার পুরোটা জুড়ে আছে৷ তাছাড়া জঙ্গিবাদের উত্থান বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সে বিষয়ে তিনি উদ্বিগ্ন নন৷ কারণ দেশ নিয়ে তার স্বপ্নের অভাব আছে৷ স্বপ্নহীন শাসকের ক্লান্তির সুযোগে জঙ্গিবাদের চাপাতির আঘাতে প্রগতিশীল মানুষদের শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হচ্ছে৷
বাংলাদেশ সরকার ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্টদের খুনিদের ধরতে, বিচার করতে কতটা সচেষ্ট বলে আপনি মনে করেন?
‘‘আল্লাহ’র নামে আর কোনো হত্যাকাণ্ড নয়’’
বাংলাদেশে মুক্তমনাদের উপর হামলা নিয়ে বার্লিনে মানববন্ধনে প্রদর্শন করা প্ল্যাকার্ডের ছিল বিশেষ কিছু বার্তা৷ চলুন সেগুলো দেখে নেয়া যাক৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতাকে ‘না’ বলুন’’
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার কারণে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ৷ তাই এই বার্তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ৷ আরেকটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘‘ধর্মীয় সন্ত্রাসকে আপনার মুখ বন্ধ করতে দেবেন না৷’’
ছবি: DW/A. Islam
‘‘আল্লাহ’র নামে কোনো হত্যাকাণ্ড নয়’’
এই বার্তাটাও পরিষ্কার৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হামলার শিকার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী (টুটুল) বলেছিলেন, ‘‘আল্লাহু আকবর’’ বলে তাঁকে কোপানো হয়েছিল৷ বার্লিনে মানববন্ধনে আরেকটি প্ল্যাকার্ডে আল্লাহ’র জায়গায় সৃষ্টিকর্তার কথা উল্লেখ করা হয়৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘ধর্মভিত্তিক সহিংসতা বন্ধ কর’’
ধর্মভিত্তিক সহিংসতা বন্ধের দাবি জানান মানববন্ধনে অংশ নেয়া এক প্রবাসী বাঙালি৷ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিরও বিপক্ষে অবস্থান তাঁর৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হোন’’
ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্দে সরব হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এই প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে৷
ছবি: DW/A. Islam
বাংলা প্ল্যাকার্ড
বাংলা ভাষায় লেখা প্ল্যাকার্ডও প্রদর্শন করা হয়েছে মানববন্ধনে৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘নাস্তিকতার জন্য মৃত্যু নয়’’
নাস্তিকতা কারো মৃত্যু বা কারাভোগের কারণ হতে পারে না, এমন প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছেন একাধিক ব্যক্তি৷ মানবন্ধনে অংশ নেয়াদের সবাই নাস্তিক নন, তবে তাঁরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘শব্দ হত্যা করে না, মানুষ করে’’
গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার, লেখক অভিজিৎ রায়ের ছবির সঙ্গে এই বাক্যটি লেখা প্ল্যাকার্ডও ছিল বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে৷ চলতি বছর বাংলাদেশে খুন হয়েছেন চারজন ব্লগার এবং একজন প্রকাশক৷
ছবি: DW/A. Islam
7 ছবি1 | 7
মোটেও না৷ সরকারি দল তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মরিয়া৷ তারা ভয় পাচ্ছে৷ এই ভয় দেশের এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ভয়৷ বাংলাদেশে প্রতি তিনজন শিক্ষার্থীর একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী৷ প্রতি তিনজন শিক্ষকের একজন মাদ্রাসা শিক্ষক৷ তাদের প্রতি সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷ এর মধ্যে যেগুলো কওমী মাদ্রাসা, সেগুলোতে আসলে কী হয় না হয়, তার কিছুই সরকার জানে না৷ কয়েকলাখ মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষক হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ২০১৩ সালে রাজধানী ঢাকায় এসে তাণ্ডব চালিয়েছে৷ সেই তাণ্ডব সরকার প্রতিহত করতে পারেনি৷ এক পর্যায়ে রাতে বিতাড়িত করতে পারলেও দিনের বেলায় তাদের করা তাণ্ডব সরকারের সাহসে দাগ কেটে দিয়েছে৷ সেই থেকে সরকার মৌলবাদের সাথে আপস করতে শুরু করে৷ ধর্মহীনতার অভিযোগ একটা ভয়ংকর অস্ত্র৷ শেখ হাসিনা তার বার্ধক্যে এসে এই অস্ত্রের মোকাবেলা করতে ইচ্ছুক নন৷ তার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কারণে এই অস্ত্রের পুরো প্রয়োগ হয় মুক্তচিন্তার মানুষদের উপর৷ ২০০৮ সালে নিরঙ্কুশ সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসে মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগকে কর্মক্ষম পেয়ে, শাহবাগ মুভমেন্টের মতো ইশতেহার সহায়ক গণআন্দোলন পেয়েও তিনি মৌলবাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পন করেছেন৷ সরকার ব্লগার হত্যায় জড়িতদের ধরতে, বিচার করতে এবং এ সব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে সচেতনভাবে অনিচ্ছুক৷ কারণ তিনি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেননি৷ এখন মৌলবাদের সৃষ্ট ধর্মানুভূতির রক্ষক হওয়া ছাড়া ক্ষমতায় থাকার আর কোনো উপায় নেই৷
আপনি কি বর্তমানে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন কিংবা যেতে চাচ্ছেন?
আমি আছি৷ তবে নিরাপদে নেই৷ স্বজনদের মতো আমিও মনে করি স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে দ্রুত নিরাপদ আবাসে চলে যাওয়া উচিত৷ চলে যাবো৷