‘যদি', ‘কিন্তু', ‘অথবা' – এ সব শব্দ বারবার ব্যবহার করার মানেই হলো আশার গুড়ে অল্প অল্প করে বালু ঢেলে দেয়া৷ তা জেনেও বলতে হচ্ছে, ‘‘সংখ্যাগুরু যদি মানুষের মর্যাদা না বোঝে, প্রধানমন্ত্রী একা সংখ্যালঘুর হলেও তাহলে লাভ নেই৷''
বিজ্ঞাপন
কিন্তু অনেকেই আশা করছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে থেমেছে, অর্পিত সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া এবং সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ রোধ করাও সেভাবেই সম্ভব৷ মহাভুল৷ শুধু প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকলে আরো কিছুদিন হয়ত মরীচিকার পেছনে ছোটা হবে, কাজ হবে না৷
মালোপাড়ার হিন্দুদের কান্না থামেনি
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়াকে ঘিরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার মালোপাড়ায় ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি লুটপাটও করা হয়৷
ছবি: DW
নেই নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া
যশোরের অভয়নগরের চাপাতলী গ্রামের প্রবেশপথে পুলিশের সতর্ক অবস্থান৷ গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের দিন এই গ্রামের নিম্নবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত মালোপাড়ায় বসবাসরতদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে৷ আক্রান্তরা জানান, ঘটনাস্থলের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে থানার অবস্থান হলেও অনেক ফোন করেও সে সময়ে পুলিশ কিংবা কোনো নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া মেলেনি৷
ছবি: DW
‘নদী ঠাকুর’
দুর্বৃত্তদের হামালায় লণ্ডভণ্ড মায়া রানি বিশ্বাসের একমাত্র মাথা গোঁজার ছোট্ট নিবাস৷ সেদিন হামলা শুরু হলে পাশের বুড়ি ভৈরব নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে উঠে প্রাণে বেঁচে যান বিধবা এই নারী৷ তাঁর ভাষায় ‘নদী ঠাকুর’ সেদিন না থাকলে জানটা হয়ত থাকতো না৷
ছবি: DW
প্রাণ বাঁচাতে নদীতে
নিজের ঘরের ভাঙা আসবাব, টেলিভিশনের পাশে মালোপাড়ার গৃহবধু উজ্জ্বলা বিশ্বাস৷ হামলাকারীদের ভয়াবহ রূপ সামান্য দেখেছিলেন তিনি৷ প্রাণ বাঁচাতে তিনিও ঝাঁপ দেন বুড়ি ভৈরবে৷ হামলার সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল যে ভগবান সেদিন পাশে ছিলেন না৷
ছবি: DW
বই-পত্র পুড়িয়ে দিয়েছে
কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের বই-পত্র, এমনকি সার্টিফিকেটও পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা৷
ছবি: DW
সুন্দর স্বপ্নে চির
হামলাকারীদের ভেঙে দেয়া আয়নায় কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব৷ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো এই ভাঙা আয়নার মতোই মঙ্গলার সুন্দর স্বপ্নেও চির ধরিয়েছে হামলাকারীরা৷ মঙ্গলার আক্ষেপ, তাঁর বই-পত্র আর সার্টিফিকেট কী দোষ করলো?
ছবি: DW
আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয়
হামলার ছয় দিন পরে এঁরা ফিরছেন বাড়িতে৷ হামলার সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: DW
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী
৮৬ বছর বয়সি মৃত্যুঞ্জয় সরকার সেদিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও দেশ ছাড়েননি তিনি৷ কিন্তু হামলার পর তাঁর মনে হচ্ছিল যে, সে সময়ে ছেড়ে যাওয়াটাই উচিত ছিল তাঁর৷
ছবি: DW
গাছও রেহাই পায়নি
বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি মালোপাড়ার গাছও জ্বালিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: DW
পলাতক জামায়াত নেতা
মালোপাড়ায় হামলার পরে চাপাতলী গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বালিয়াডাঙ্গায় স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর থানা আমীর মাওলানা আব্দুল আজিজের বাড়ি ভাঙচুর করে যৌথবাহিনী৷ ঘটনার আগে থেকেই পলাতক রয়েছেন এ জামায়াত নেতা৷
ছবি: DW
আক্রান্তদের অভিযোগ
জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুল ওহাব৷ মালোপাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য জামায়াত শিবির ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলকেও দায়ী করেছেন অনেকে৷ সাবেক এই সাংসদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন৷ সেখানে নতুন প্রার্থী হিসেবে রণজিৎ রায় মনোনয়ন পাওয়ায় এই দুই জনের সমর্থকদের মাঝে বেশ উত্তেজনা ছিল পুরো নির্বাচনের সময়টায়৷
ছবি: DW
গণধর্ষণ
যশোরের আরেক ভয়াল জনপদ মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল গ্রামের দাসপাড়ার বাসিন্দা অনারতী দাস৷ ৭ জানুয়ারি রাতে তাঁর সামনেই অস্ত্রের মুখে একদল দুবৃত্ত গণধর্ষণ করে পুত্রবধু মনিমালা দাস আর ভাতিজি রূপালী দাসকে৷
ছবি: DW
ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী
কার্তিক দাসকেও সেদিন রাতে সেই ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিল৷ দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার নিম্নবর্ণের হিন্দু মনিমালা দাসের শ্বশুর ও রূপালী দাসের চাচা তিনি৷
ছবি: DW
বাড়িঘর ছেড়েছেন
দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার হওয়া পরিবার দুটি আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়েছেন৷
ছবি: DW
শুধুই আতঙ্ক
দাসপাড়ার এক নারী৷ দাসপাড়ার নারীদের এখন নির্ঘুম রাত কাটে আতঙ্কে৷
সংখ্যালঘুদের জীবনে শান্তি এবং সম্মান খুব দরকার৷ সম্পত্তি গেলে জানাজানি হয়, শান্তি তার অনেক আগেই সঙ্গোপনে বিদায় নেয়, কেউ খবর রাখে না, হয়ত রাখতে চায়ও না৷ স্বাধীনতার পরের ৪৪ বছরে কোন শ্রেণি-পেশার মানুষ সংখ্যালঘুদের অধিকার, মর্যাদা, কিংবা সামাজিক গুরুত্বের কথা ভেবে কিছু করেছে?
৪৪ বছরে কয়টি গল্প লেখা হয়েছে সংখ্যালঘুদের নিয়ে? কয়টি চলচ্চিত্র হয়েছে যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানের ছোট হলেও গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি আছে? সংবাদমাধ্যমে একটা সময় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে ‘পাকিস্তানের সেনাবাহিনী' বলা বা লেখা যেত না, বঙ্গবন্ধুর নামটাও ছিল নিষিদ্ধ৷ ৪৪ বছরের বড় একটা সময় কি সংখ্যালঘুরাও গল্প-কবিতার বর্ণনায়, নাটক-চলচ্চিত্রের কাহিনীতে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিলেন?
ভারতের সিদ্ধান্তে সমস্যায় বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মানুষ যেন গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয় সেজন্য ভারত থেকে বাংলাদেশ গরু পাচার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷
ছবি: S. Rahman/Getty Images
সীমান্তরক্ষীদের নতুন দায়িত্ব
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২,২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত পাহারা দেয়ায় নিয়োজিত প্রায় ৩০ হাজার ভারতীয় সৈন্যকে নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ সেটা হলো, ভারতীয় গরু যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশে পৌঁছতে না পারে৷ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিএসএফ সদস্যদের এই নির্দেশ দেন যেন ‘বাংলাদেশের মানুষ গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়’৷
ছবি: Str/AFP/Getty Images
গরু পবিত্র
হিন্দুদের কাছে গরু একটি পবিত্র প্রাণী৷ তাই ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার গরুর মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করতে চায়৷ রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক সংঘ আরএসএস এর পশ্চিমবঙ্গের মুখপাত্র বলেছেন, ‘‘গরু জবাই কিংবা চোরাই পথে চালান, আর হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করা বা হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা একই কথা৷’’
ছবি: Shaikh Azizur Rahman.
চার যুগের ইতিহাস
ভারত থেকে চোরাই পথে আসা গরুই এতদিন বাংলাদেশের মানুষের মাংসের প্রধান উৎস ছিল৷ গত চার দশক ধরে সেটা হয়ে আসছে৷ এর সঙ্গে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য জড়িয়ে আছে৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman.
দাম বেড়ে গেছে
বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গরুর মাংস রপ্তানিকারক বেঙ্গল মিট এর সৈয়দ হাসান হাবিব গত জুলাই মাসে রয়টার্সকে জানান, ভারতের এই সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাঁর কোম্পানির মাংস রপ্তানি প্রায় ৭৫ শতাংশ কমে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Asia News Network/Jofelle P. Tesorio
চাকরি হারিয়েছে প্রায় ৪,০০০
বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট শাহীন আহমেদ জানিয়েছেন, জুন পর্যন্ত চামড়া শিল্পে কর্মরত প্রায় চার হাজার কর্মীর চাকরি গেছে৷ আর ১৯০টি ট্যানারির মধ্যে ৩০টি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman
ভারতীয় গরুর মাংস ভালো
বেঙ্গল মিট এর সৈয়দ হাসান হাবিব বলেন, তিনি এখন নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমার থেকে মাংস আমদানির চিন্তা করছেন৷ কিন্তু ভারতীয় মাংস ও চামড়ার মান ভালো বলে জানান তিনি৷ উল্লেখ্য, ভারত গরুর মাংসের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক৷
ছবি: AFP/Getty Images
ভারতের সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন মাংসের জন্য বাংলাদেশকে নতুন উৎস খুঁজে বের করতে হবে কেননা ভারত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকবে৷
ছবি: S. Rahman/Getty Images
7 ছবি1 | 7
রাজনীতিবিদরা তো সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি করেছেন, করছেন, ভবিষ্যতেও হয়ত করবেন৷ বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজ কী করেছেন এতকাল? তাদের কেউ কেউ ‘বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের সংখ্যালঘু বলা ঠিক কিনা' – এই বিতর্কে যত ‘পাণ্ডিত্য' জাহির করার চেষ্টা করেছেন, সংখ্যালঘু নির্যাতন বা জমি দখলের প্রতিবাদে তার কণাভাগ সক্রিয়তাও দেখিয়েছেন? সুশীল সমাজের কাছে প্রশ্ন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের কী নাম দেয়া যায় – তা নিয়ে এত মাথাব্যথা আপনাদের, যার মান গিয়েছে, সম্পত্তিও যায়, তাঁদের নামে কি বা আসে যায়?
অর্পিত সম্পত্তি আইনের ৫০ বছর পূর্ণ হলো কয়েকদিন আগে৷ সংখ্যালঘূদের সম্পত্তি এবং মর্যাদা হরণেরও অর্থশত বছর পূর্ণ হলো একই সঙ্গে৷ সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার শাব্দিক অস্তিত্ব ধরে রাখা গেলেও, ধর্মের প্রশ্নে নিরপেক্ষতা সেখানে নেই৷ আইনের চোখে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় ‘শত্রু' না হলেও, কিছু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ‘শত্রুর সম্পত্তি' আখ্যা পেয়েছে৷ তারপরও সেই সম্প্রদায়গুলো রাষ্ট্রের কোন শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা, নিরাপত্তা পেতে বা আশা করতে পারে?
অর্পিত সম্পত্তি প্রকৃত মালিকের হাতেই আবার অর্পণ করার উদ্যোগ চলছে৷ খুব ভালো৷ কিন্তু এই ভালো কতদিন থাকবে, ভালোর সুফল আদৌ ভুক্তভোগীরা কোনোদিন পাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ, সংশয় অবশ্যই আছে৷ এবং সে সংশয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক চেষ্টাতেও দূর হবার নয়৷
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুর সম্পত্তি আদালতের রায়ে, সরকারের প্রেচেষ্টায় সাময়িকভাবে হয়ত ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হবে, কিন্তু সব পর্যায়ে নীরব, নিষ্ক্রিয়, নিস্পৃহ বা আপাত উদাসীন থেকে শুধু আইন প্রণয়ন এবং কার্যকর করার মাধ্যমে সংখ্যালঘূর অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করা কখনোই সম্ভব নয়৷
টুইটারে এক ভদ্রলোক সংখ্যালঘুদের মর্যাদা এবং অধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য তৃণমূল পর্যায়ে কোনো কাজ হচ্ছে না দেখে আক্ষেপ করেছেন৷ তৃণমূল পর্যায়ে মৌলবাদী চেতনা ও সম্পদের লালসা চরিতার্থ করার ক্রমবর্ধমান প্রয়াস রুখতে না পারলে যে সব আশা মরীচিকা হবে তা আমাদের রাজনীতিবিদ বা সুশীল কেউই হয়ত এখনো বুঝতে পারছেন না৷
না বুঝলে প্রধানমন্ত্রী একা কিছুই করতে পারবেন না৷ শিক্ষার্থীদের ভ্যাট প্রত্যাহার করা সহজ, সংখ্যালঘুর সম্মান – সম্পত্তি নিরাপদ রাখা, হাতছাড়া হলে তা আবার ফিরিয়ে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে অসম্ভব৷