ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্থানীয়রা বলছেন, বাঘগুলোর আকার লম্বায় প্রায় চার ফুট ও উচ্চতা প্রায় তিন ফুট৷ উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের বাঁকাকূড়া, পশ্চিম বাঁকাকূড়া, গান্ধিগাঁও, হালচাটি ও ছোট গজনী গ্রামে গত এক সপ্তাহে গরুসহ প্রায় ২০টি ভেড়া ও ছাগল বাঘের পেটে গেছে৷ বনের ভেতর আহত এবং ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে একটি ছাগল, একটি ভেড়া ও একটি গরু৷ বাঘের আক্রমণের ভয়ে গ্রামের শিশুরাও স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে৷ তবে এখনও পর্যন্ত কোনো মানুষ ওই বাঘের আক্রমণের শিকার হয়নি বলে জানান তারা৷
ঘটনাটি জানার পর বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের পক্ষ থেকে স্থানীয়দের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে৷
প্রকাশ্যে দিনের বেলাতেই ঝিনাইগাতীর বনাঞ্চলে বাঘ চলাফেরা করছে বলে জানান বাঁকাকুড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল হালিম ৷ সেই সঙ্গে বন সংলগ্ন বিভিন্ন বাড়িতে হামলা করে ছাগল ও ভেড়া ধরে গিয়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে৷ পরবর্তীতে গভীর জঙ্গলে ওই ছাগল ও ভেড়ার নাড়ি-ভুড়ি ও দেহাবশেষ পড়ে থাকতে দেখতে পাচ্ছেন গ্রামবাসীরা৷
তিনি বলেন, ‘‘আমি প্রায় ২০-২৫ বছর ধরে বনের মধ্যে ঘরে থাকি৷ আমি সপ্তাহ খানেক ধরে রাতে বাঘের ডাকাডাকি শুনছি৷ আগে ছিল বন্যহাতির আতঙ্ক, এখন নতুন করে শুরু হয়েছে বাঘের আতঙ্ক৷”
একই গ্রামের স্কুল ছাত্র রবিন বলেন, ‘‘আমরা এখন দলবদ্ধভাবে বনের রাস্তা বাদ দিয়ে অন্য রাস্তায় স্কুলে যাচ্ছি৷ বাবা-মা আমাদের বাঘের আক্রমণের জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন৷ আমরা স্কুলে যেতে এখন ভয় পাচ্ছি৷”
জলবায়ু পরিবর্তন আর বাঘের শিকার যে জীবন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ছে৷ সুন্দরবন অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার মানুষ তাই বাধ্য হচ্ছেন জীবিকার সন্ধানে বনের গভীরে যেতে৷ কিন্তু সেখানে আছে বাঘের ভয়৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
প্রাকৃতিক দুর্যোগ
এনভায়রনমেন্ট, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ক্রান্তীয় ঝড়ের সংখ্যা ২৬ শতাংশ বেড়েছে৷ গত বছরের মে মাসে সাইক্লোন আমপান ঘণ্টায় ১৩৩ কিলোমিটার বেগের বাতাস নিয়ে সুন্দরবনে আছড়ে পড়ে৷ প্রাণ হারান বহু মানুষ৷ কয়েক হাজার বাড়িঘর ও বাঁধ ধ্বংস হয়ে যায়৷ এমন একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছেন এ অঞ্চলের মানুষ৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
পানির নিচে ধানক্ষেত
অক্টোবরে নোনা পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে কুমিরমারি দ্বীপের বাসিন্দা নাগিন মুন্ডার আধা একরের ধানক্ষেত৷ ‘‘আমার পুকুরে কোনো মাছ নেই, বাগানে কোনো সবজি নেই; আর আমার ধানের ফসল অর্ধেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে,’’ বলেন ৫০ বছর বয়সি এ কৃষক৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
১৫ শতাংশ জমি
গত বছর কুমিরমারির প্রায় আড়াইশ একর কৃষিজমি প্লাবিত হয়েছে৷ এতে দেড় হাজারের বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার স্থানীয় কর্মকর্তা দেবাশীষ মন্ডল৷ তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে কুমিরমারির আনুমানিক এক হাজার একর জমি মুছে গেছে, যা দ্বীপটির মোট ভূখণ্ডের ১৫ শতাংশেরও বেশি৷ এর ফলে কৃষি জমি আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
বাঘের খাদ্য
চার বছর আগে সুন্দরবনের গভীরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি পারুল হালদারের স্বামী৷ মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের শিকার হয়েছেন তিনি৷ চার সন্তানের ভরণপোষণের ভার পুরোটাই এখন পারুলের কাঁধে৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
বাড়ছে মৃত্যু
৭৮ বছরের সুভদ্রা হালদারের স্বামীও মারা গেছেন বাঘের হামলায়৷ সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের পরিচালক তাপস দাস বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, সুন্দররনের ভারত অংশে গত বছরের এপ্রিল থেকে বাঘের হামলায় অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে৷ স্থানীয় গণমাধ্যমের হিসাবে, গত বছর বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে মোট ২১ জনের৷ আগের দুই বছর এই সংখ্যা ছিল ১৩৷ প্রকৃত সংখ্যাটা হয়ত তার চেয়েও বেশি৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
পারুলের সংগ্রাম
স্বামীর পরিণতির কথা জেনেও জীবিকার সন্ধানে নিয়মিত সুন্দরবনের গভীরে যেতে হয় ৩৯ বছরের পারুলকে৷ মাসে দুইবার তিনি ছয় ঘণ্টা নৌকা চালিয়ে যান সুন্দরবনের গভীরে৷ মৃত্যুর শঙ্কা নিয়েও কয়েকদিন তাকে থাকতে হয় বনের ভিতরে৷ মাছ আর কাঁকড়া ধরে মাসে দুই হাজার রূপি আয় হয় তার৷ ‘‘যদি আমি জঙ্গলে না যাই, তাহলে খাবারও জুটবে না,’’ বলেন পারুল৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
মেয়ের জন্য
১১ বছর বয়সি পাপড়ির জন্যই কাজের খোঁজে অন্য কোথাও যেতে চান না পারুল৷ কারণ তিনি না থাকলে সন্তানের যত্ন নেবে এমন কেউ পরিবারে কেউ নেই৷ ‘‘যত কষ্টই হোক না কেন, আমি ওকে পড়াবোই’’, বলেন তিনি৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
করোনা ও হরিপদের নির্মম ভাগ্য
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সুন্দরবনে গিয়ে আর ফেরেননি ৩১ বছরের হরিপদ মণ্ডল৷ কুমিরমারির বাসিন্দারা একটি গাছের নিচে তার একজোড়া মোজা দেখতে পান৷ পরে তার দেহাবশেষ খুঁজে পান তারা৷ ‘‘তিনি (হরিপদ) বলেছিলেন কাছাকাছি কোথাও মাছ ধরে ৫০-১০০ রুপি পেলে তা দিয়ে ঘরের খরচ মেটাবেন৷ যদি লকডাউন বা করোনা ভাইরাস না থাকতো, তিনি হয়তো কাজেই থাকতেন,’’ বলেন ২৯ বছর বয়সি অষ্টমী৷
ছবি: Anushree Fadnavis/REUTERS
8 ছবি1 | 8
এক সপ্তাহ ধরে বাঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে জানিয়ে রাংটিয়া রেঞ্জের বন বিভাগের বন প্রহরী আলম মিয়া বলেন, ‘‘আমি নিজের চোখেও বাঘ দেখেছি৷ এছাড়া রাতে আমার বাড়ি থেকে দুটি ছাগল বাঘে কামড় দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে৷ এ ব্যাপারে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি৷ তারা আমাদের সতর্ক থাকার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন৷ ’’
উত্তর বাকাকুড়া গ্রামের আব্দুর রহমান নামে এক কৃষক বলেন, ‘‘রাতে আমার ছাগল বাঘে আক্রমণ করে৷ আমি বাঘকে খুব কাছ থেকে দেখেছি৷ পরে বাঁশ-লাঠি নিয়ে তাড়া করলে আমার ছাগলটি ছেড়ে দিয়ে বাঘ চলে যায়৷ এতে আমার ছাগলটি গুরুতর আহত হয়েছে৷ আহত ছাগলটিকে এখন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে৷’’
তিনি আরও বলেন, দিনের বেলায় বাঘ গহীন বনে অবস্থান করে৷ রাতের বেলায় এদের আনাগোনা শুরু হয়৷ আমরা খুব আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছি৷ বিশেষ করে আমাদের শিশু বাচ্চাদেরকে আমরা দিনের বেলাতেও বাড়ির বাইরে বের হতে দিচ্ছি না৷
এ বিষয়ে রাংটিয়া রেঞ্জের গজনী বীটের বীট কর্মকর্তা মকরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, ‘‘সম্প্রতি গারো পাহাড়ে গভীর জঙ্গলে বাঘের আগমন ঘটেছে৷ আমরা গ্রামবাসীদের সতর্কতার সঙ্গে চলাচলের পরামর্শ দিয়েছি৷ প্রয়োজনে আরও সতর্ক করার জন্য মাইকিং করার বিষয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে৷’’