নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আরো কড়া অবস্থান নিলেন আজারি প্রেসিডেন্ট। শান্তি নয়, যুদ্ধের শেষ দেখে ছাড়ার হুমকি দিলেন।
বিজ্ঞাপন
ছয় সপ্তাহেও থামলো না যুদ্ধ। নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো সমাধান সূত্রে পৌঁছতে পারলো না আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান। তারই মধ্যে রোববার আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট জানিয়ে দিয়েছেন, আর্মেনিয়া অস্ত্র না ছাড়লে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে আজারি ফৌজ। নাগর্নো-কারাবাখ থেকে আর্মেনিয়া সরে গেলেই একমাত্র এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটতে পারে বলে রোববার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। এ দিকে রাশিয়া জানিয়েছে, নাগর্নো-কারাবাখ থেকে যুদ্ধ যদি আর্মেনিয়ার সীমান্তের ভিতরে ঢুকে পড়ে, তা হলে রাশিয়া বাধ্য হবে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে।
এখনো পর্যন্ত তিনবার আলোচনায় বসেছেন আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মস্কোর মধ্যস্থতায় দুই বার শান্তি বৈঠক হয়েছে। সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ থামেনি। এরপর ওয়াশিংটনের মধ্যস্থতায় ফের একবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয় দুই দেশ। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের যুদ্ধ অব্যাহত। প্রতিদিনই নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। ধ্বংস হচ্ছে একের পর এক শহর। সাধারণ মানুষ ঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন।
নাগর্নো-কারাবাখে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ
02:23
রোববার যুদ্ধ বন্ধের জন্য ফের আজারবাইজানের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করে মস্কো। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুট কাভুসোগ্লুর সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন আজারি প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ। সেখানে প্রেসিডেন্ট স্পষ্টই জানিয়ে দেন, যে কোনো সমাধান মেনে নিতে রাজি নয় আজারবাইজান। নাগর্নো-কারাবাখ আর্মেনিয়া ছেড়ে দিলে তবেই একমাত্র তাঁরা শান্তি প্রস্তাব গ্রহণ করবেন। নইলে যুদ্ধ চলবে। বিষয়টির শেষ দেখে ছাড়বে আজারবাইজান, এমনই হুমকি দিয়েছেন তিনি।
আজারবাইজান, আর্মেনিয়ার মধ্যে সংঘাতের কারণ কী?
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷ বিস্তারিত ছবিঘরে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
সংঘাতের কারণ
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে রাশিয়ার মিত্র আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মিত্র আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাত চলছে৷ এর কারণ নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল৷
ছবি: Defence Ministry of Azerbaijan/Reuters
নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল কোথায়?
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজানের অংশ৷ পাহাড় ও বন ঘেরা দুর্গম এই অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাস করেন৷ তাদের বেশিরভাগই আজারবাইজানের শাসনের বিরোধী আর্মেনীয়৷ অঞ্চলটির আয়তন প্রায় চার হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার৷
প্রথম সংঘাত
গত শতকের আশির দশকের শেষদিকে যখন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া চলছে, তখন থেকেই নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে সংঘাতের শুরু৷ ১৯৯৪ সালে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে এই সংঘাত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রাণ হারান প্রায় ৩০ হাজার মানুষ৷ সংঘাতের কারণে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আর্মেনীয়দের হাতে৷
ছবি: Reuters/Photolure/V. Baghdasaryan
আর্মেনিয়ার সহায়তা
১৯৯৪ সালের পর থেকে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে আর্মেনিয়া৷ এছাড়া সারা বিশ্বে থাকা আর্মেনীয়রাও ঐ অঞ্চলের জন্য দান করে থাকেন৷ ছবিতে কারাবাখের সবচেয়ে বড় শহর স্টেপানাকিয়ার্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Zuma/imago images
মাঝেমধ্যেই সংঘাত
যুদ্ধবিরতি চললেও নাগর্নো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সৈন্যদের মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ ২০১৬ সালে এক সংঘাতে (ছবি) প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারান৷ এছাড়া গত জুলাইতেও মোটামুটি বড় আকারের সংঘাত হয়েছিল৷ রবিবার শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন৷ নিহতদের অন্তত ১১ জন বেসামরিক নাগরিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Baghdasaryan
আবার কেন সংঘাত?
জুলাইয়ের সংঘাতের সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তার সমাধানে ততটা আগ্রহ দেখায়নি৷ অতীতে রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র ঐ অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে মধ্যস্থতা করলেও বর্তমানে করোনা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, বেলারুশ, লেবানন পরিস্থিতি ইত্যাদির কারণে নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়া যায়নি৷ তাই রবিবার থেকে যুদ্ধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/Reuters
এবারের সংঘাত কতটা বড়?
‘জর্জিয়ান স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিস সেন্টার’-এর সিনিয়র ফেলো গেলা ভাসাদজে বলছেন, ১৯৯০ দশকের পর এই ‘প্রথম’ আর্মেনিয়া ও কারাবাখ ঐ অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক যান জড়ো করছে৷ আজারবাইজানও সামরিক আইন জারি করেছে৷ এছাড়া আকাশ থেকে হামলা চালানোর সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি সবকিছুর ব্যবস্থা করছে দেশটি৷
খ্রিস্টানপ্রধান আর্মেনিয়ার সবচেয়ে বড় বন্ধু রাশিয়া৷ তাদের সঙ্গে সামরিক চুক্তিও আছে দেশটির৷ আর মুসলমানপ্রধান দেশ আজারবাইজানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি আছে তুরস্কের৷ তবে বিশ্লেষক গেলা ভাসাদজে বলছেন, রাশিয়া ও তুরস্ক হয়ত সরাসরি এই সংঘাতে যুক্ত হবে না, কারণ, এতে যুক্ত হয়ে খুব বেশি লাভ নেই৷ বরং এর ফলে তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷
ছবি: Armenian Defense Ministry/AP/picture alliance
রাশিয়ার সুযোগ
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে সমর্থন জানিয়ে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিনের বিরোধী নাভালনিকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ সমালোচনার মুখে আছে রাশিয়া৷ এই অবস্থায় রাশিয়া যদি আলোচনার মাধ্যমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া প্রশংসিত হতে পারে৷ পুটিন ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: picture-alliance/Russian Look/Belarus 24 TV
9 ছবি1 | 9
এই যুদ্ধে আজারবাইজানকে সমর্থন করছে তুরস্ক। প্রথম দিকে তুরস্কের সামরিক বাহিনীও নাগর্নো-কারাবাখে আক্রমণ চালিয়েছিল বলে আর্মেনিয়া অভিযোগ করেছিল। অন্য দিকে প্রথম থেকেই রাশিয়ার কাছ থেকে সাহায্য চাইছে আর্মেনিয়া। পুরনো এই সোভিয়েত দেশ দেশটি রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ। আর্মেনিয়া আক্রান্ত হলে রাশিয়া সাহায্য করতে বাধ্য। রাশিয়া অবশ্য গত সপ্তাহেও জানিয়েছে, এই যুদ্ধে তারা কোনো পক্ষকেই সমর্থন করছে না। কী ভাবে সংঘাত বন্ধ করা যায়, সে চেষ্টাই তারা চালাচ্ছে। তবে শনিবার আর্মেনিয়ার সংবাদসংস্থা দাবি করেছে, অবস্থান সামান্য হলেও কড়া হয়েছে রাশিয়ার। শনিবার তারা জানিয়েছে, যুদ্ধ যদি নাগর্নো-কারাবাখ থেকে আর্মেনিয়ার সীমান্তে ঢুকে পড়ে, তা হলে আর্মেনিয়াকে সামরিক সাহায্য দেবে রাশিয়া।
কিছুদিন আগে ইরানওঠিক এই একই আশঙ্কা করেছিল। তারা বলেছিল, যে কোনো সময় আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজানের এই যুদ্ধ গোটা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তুরস্ক, ইরান, সকলে জড়িয়ে পড়তে পারে। সে কারণে দ্রুত সমাধান সূত্র খোঁজার আবেদন জানিয়েছিল ইরান। কিন্তু আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান সে পথে হাঁটতে চাইছে না। নাগর্নো-কারাবাখে নিজেদের অধিকার ছাড়তে চাইছে না আর্মেনিয়া। নাগর্নো-কারাবাখ হাতছাড়া করতে রাজি হচ্ছে না আজারবাইজান।