মিউজিয়ামের কাচের শোকেসের মধ্যে পুতুল ও মডেলভরা মিনিয়েচার জগত নিজস্ব কাহিনি তুলে ধরে৷ হামবুর্গের এক শিল্পী এমন ডায়োরামা তৈরির ক্ষেত্রে আরো সৃজনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
হামবুর্গের শিল্পী সান্ড্রা হাফেমাইস্টারের তৈরি ডায়োরামা বা ত্রিমাত্রিক মিনিয়েচার মডেল একইসঙ্গে রূপকথাময়, পরাবাস্তব এবং কৌতূকে ভরা৷ ছোট শোকেসের মধ্যে তিনি অসাধারণ জগত সৃষ্টি করেন৷ এভাবে নিজের সৃজনশীলতা উজাড় করে দেন এই শিল্পী৷ নিজের সৃজনশীলতার প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে সান্ড্রা বলেন, ‘‘মনে আছে, শৈশবে আমি আসলে মহাকাশচারী, বানর গবেষক অথবা সমুদ্রের ডুবুরি হতে চেয়েছিলাম৷ সে সব আমার স্বপ্নের পেশা ছিল৷ সৌভাগ্যবশত এখন আমি ডায়োরামা তৈরি করছি৷ আমি তার মধ্যে খেয়াল খুশি মতো সৃষ্টির কাজে মেতে উঠতে পারি৷ ছোট বাক্সের মধ্যে কম জায়গা সত্ত্বেও তার মধ্যে সব কিছু ঢোকাতে পারি৷ যে কোনো জগত সৃষ্টি করতে পারি৷''
ডায়োরামা তৈরির আগে সান্ড্রা তার আইডিয়াগুলি মুডবোর্ড ও হাতে আঁকা স্কেচের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন৷ ক্ষুদ্র বইয়ের মতো অনেক ছোট বস্তু তিনি নিজেই গড়ে তোলেন৷
কিছু তৈরি বস্তু কিনে তিনি সেগুলি আরও সুন্দর করে তোলেন৷ যেমন উটের ক্ষুদ্র পুতুল৷ ইলেকট্রিক মিনি করাত দিয়ে তিনি অবশিষ্ট কাঠ কেটে নানা রং ও আয়তনের আসবাবপত্রও তৈরি করেন৷ সান্ড্রা বলেন, ‘‘আমি মূলত কোনো বস্তুর ৮৭ গুণ ছোট সংস্করণ তৈরি বা ব্যবহার করি৷ তবে এই মাপকাঠির বাইরের জিনিসও কাজে লাগাই৷ একটু ছোটবড় হলে ক্ষতি নেই, ঠিক খাপ খেয়ে যায়৷ তখন কিছুটা পাগলামি ও পরাবাস্তবে ভরা জগত সৃষ্টি হয়৷''
মৎস্যকন্যা, ড্রাগন এবং ইউরোপের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান
গত সপ্তাহে ডেনমার্কের সবচেয়ে পরিচিত মূর্তি নিজের শততম জন্মদিন পালন করলো৷ ছোট্ট মৎস্যকন্যার বয়স হয়েছে ১০০ বছর৷ ইউরোপের আরো স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, তবে সেসবের অধিকাংশই এমন সুন্দর নয়৷
ছবি: DW/A. Riekmann
কোপেনহেগেনের মৎস্যকন্যা
পেশাদার বলুন আর শৌখিন আলোকচিত্রী – ডেনমার্কে সবাই যার ছবি সবচেয়ে বেশি তোলেন তিনি এই মৎস্যকন্যা৷ হান্স ক্রিস্টিয়ান অ্যান্ডারসনের রূপকথা থেকে জন্ম তাঁর৷ আর মৎসকন্যাকে গড়েছেন ভাস্কর এডভার্ড এরিকসন, ১৯১৩ সালে৷
ছবি: Fotolia
ব্রাসেলসে প্রস্রাবরত শিশুর মূর্তি
ব্রাসেলসের ‘‘দ্য ম্যানিকিন পিস’’ বা প্রস্রাবরত শিশুর মূর্তির বয়স অনেক, তবে বয়সের সঙ্গে তার জনপ্রিয়তা মোটেই কমেনি৷ সেই ১৬১৯ সালে তৈরি এটি৷ এরপর চুরি হয়েছে অনেকবার৷ এখন তামার যে মূর্তিটি প্রদর্শন করা হচ্ছে সেটি আসলটির আদলে তৈরি৷ আরেকটি মজার তথ্য হচ্ছে, ১৬৯৮ সাল থেকে নিয়মিত বিভিন্ন উপলক্ষ্যে শিশু মূর্তিটিকে কাপড় পরানো হয়৷ এখন অবধি ৮৫০টি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পোশাক পরোনো হয়েছে এটিকে৷
ছবি: Fotolia
ব্রেমেন শহরের বাদকরা
গ্রিম ভাতৃদ্বয়ের লেখা লোককাহিনির একটি গল্পের নাম ‘দ্য টাউন মিউজিশিয়ানস অফ ব্রেমেন’ বা ব্রেমেন শহরের বাদকরা৷ গল্পের চার চরিত্র মোরগ, বিড়াল, কুকুর এবং গাধা নিয়ে তৈরি হয়েছে মূর্তিটি, যা রয়েছে ব্রেমেন শহরের সিটি হলের সামনে৷ কথিত আছে মূর্তির সামনের অংশে থাকা গাধার পা ছুঁয়ে কিছু প্রত্যাশা করলে তা পূরণ হয়৷
ছবি: lassedesignen/Fotolia
ক্লাগেনফুর্টের লিন্ডওয়ার্ম ড্রাগন
সাধারণত শহর বা দেশের প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রচলিত কল্পকাহিনির উপর ভিত্তি করে মূর্তি তৈরি করা হয়৷ ক্লাগেনফুর্টের মূর্তিটিও সেই ভাবনা থেকে তৈরি৷ প্রচলিত আছে, অনেকটা ড্রাগনের মতো দেখতে এই দৈত্যাকার সাপটি শহরের পাশের এক জলাভূমিতে বাস করতো আর সেই জলাভূমির কাছে কেউ গেলে তাকে খেয়ে ফেলতো৷ একদিন শহরের বাসিন্দারা কৌশলে এটিকে পানি থেকে উপরে তোলে এবং হত্যা করে৷
ছবি: Fotolia
রোমে রোমুলুস এবং রেমুস
লোককাহিনি অনুযায়ী, জমজ ভাই রোমুলুস এবং রেমুস রোম শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ রেয়া সিলভিয়া নামে এক নারীকে ধর্ষণ করেন ওয়ার গড মার্স৷ এরপর রেয়ার গর্ভে রোমুলুস এবং রেমুসের জন্ম নেয়৷ তাদের আবার বড় করেছে এক নেকড়ে৷ এই গল্পের সমাপ্তি বিশেষ সুন্দর নয়৷ বড় হয়ে রেমুসকে হত্যা করেন রোমুলুস, যে কারণে ইটালির রাজধানীর নাম হয়েছে রোম, রেম নয়৷
ছবি: Fotolia
আইসেনাখের লুথার প্রতিমূর্তি
ভিটেনব্যার্গের এই প্রতিমূর্তিটি মার্টিন লুথারের৷ রোমান ক্যাথলিক চার্চে সংস্কারে সংগ্রামের জন্য বিশেষ পরিচিত তিনি৷ লুথার খ্রিষ্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল ল্যাটিন থেকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন৷ আর এভাবে তিনি চার্চকে সাধারণ মানুষের নিকটে নিয়ে আসেন৷
ছবি: Fotolia
স্যুয়েবজিনে নতুন প্রতিমূর্তি
এখনও নিত্য নতুন স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে৷ ২০১০ সালে খ্রিষ্টের সবচেয়ে বড় প্রতিমূর্তি বসানো হয়েছে পোল্যান্ডের স্যুয়েবজিনে৷ এটি রিও ডে জিনেরোর মূর্তির চেয়েও দুই মিটার লম্বা৷
ছবি: Fotolia
কন্সটান্সের ‘দ্য ইমপেরিয়া’
নয় মিটার লম্বা এই মূর্তিটি কার্যত বিদ্রুপাত্মকভাবে দ্য কাউন্সিল অফ কন্সটান্সকে (১৪১৪-১৪১৮) ফুটিয়ে তুলেছে৷ কাউন্সিলে রোমান এবং ফরাসি চার্চের মধ্যকার বিচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছিল৷ মাত্র ২০ বছর আগে স্থাপিত মূর্তিটি আক্ষরিক অর্থেই এক হাতে এম্পেরর এবং অন্য হাতে পোপকে ধরে রেখেছে৷ আর হ্যাঁ, চার বছর মেয়াদি কাউন্সিলে অংশ নেওয়াদের সেবা দিয়েছিলেন পতিতারা৷ মূর্তির অর্থ বুঝতে এবার নিশ্চয়ই আরো সুবিধা হচ্ছে৷
ছবি: Fotolia/VRD
টয়েটোবের্গ জঙ্গলে হারম্যান প্রতিমূর্তি
চেরুসি যুদ্ধের প্রধান হারম্যানের এই প্রতিমূর্তি ডেটমোল্ডে স্থাপন করা হয় ঊনিশ শতকে৷ বার্লিনের ঐতিহাসিক মিউজিয়ামের ইতিহাসবিদ মনিকা ফ্ল্যাকের মতে, ‘‘নবম শতকে টয়েটোবের্গ জঙ্গলে এক যুদ্ধে রোমানদের পরাজিত করেন হারমান৷ জার্মানির আত্ম-আবিষ্কারে তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ছোট্ট মৎস্যকন্যার মিশ্রিত রূপ
২০০৬ সালে কোপেনহেগেন পোতাশ্রয়ে একটি ‘জীনগতভাবে পরিবর্তিত’ বড় মৎস্যকন্যা স্থাপন করা হয়েছে৷ আসল মৎস্যকন্যা থেকে ৪০০ মিটার দূরে বসানো হয়েছে এটিকে৷
ছবি: DW/A. Riekmann
10 ছবি1 | 10
আপাতত তিনি দুবাইয়ের এক নতুন ডিজাইনার হোটেলের জন্য ছয়টি ভিন্ন ডায়োরামা গড়ে তুলছেন৷ সেই শোকেস-গুলি হোটেলের লিফটের মধ্যে বসানো হবে৷ তাই সেগুলি সাত সেন্টিমিটারের বেশি গভীর হলে চলবে না৷ এমন জায়গার জন্য অন্যভাবে ডিজাইন করার কথা ভাবতে হয়েছে৷ শিল্পী হিসেবে এমন চ্যালেঞ্জের মুখে সান্ড্রা হাফেমাইস্টার বলেন, ‘‘সবটা ছোট খুপরিওলা বাক্সের মতো করে ভাবতে হয়েছে৷ তার মধ্যে দুবাই শহরের কেন্দ্রস্থল বা পুরানো অংশের অনেক বিস্ময়জনক বস্তু ভরা রয়েছে৷ এক সপ্তাহ সেখানে ঘুরে অসংখ্য ছবি তুলেছি৷ অনেক আইডিয়া মাথায় এসেছে, অনেক জিনিস সংগ্রহ করেছি৷''
হামবুর্গ শহরের ‘পিরদ্রাই' হোটেল সান্ড্রা হাফেমাইস্টারকে দিয়ে ৭১টি ডায়োরামা তৈরি করিয়েছে৷ হোটেলের বিভিন্ন তলায় সেগুলি ছড়িয়ে রয়েছে৷ হোটেলের কর্ণধার স্টেফান পালাশ মনে করেন, ‘‘সান্ড্রা বিভিন্ন কাহিনির অনেক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে সফল হয়েছেন৷ এই ডায়োরামাগুলি হোটেলের তলাগুলিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে৷ দেখলেই মুখে হাসি ফোটে৷ শিশুদের কাছে সেগুলি খেলার মতো, অতিথি হিসেবে প্রাপ্তবয়স্করা ডিজাইন দেখে মুগ্ধ হন৷ হোটেলে থাকার অভিজ্ঞতা আরও রঙিন ও ঘটনাবহুল করে তোলে৷''
হামবুর্গের ‘মিনিয়েচার ওয়ান্ডারল্যান্ড' মিউজিয়ামের জন্য সান্ড্রা হাফেমাইস্টার একটি বই জীবন্ত করে তুলেছেন৷ ভিন্ন স্বাদের সেই ভ্রমণের গাইড বন্দর ও ফিলহার্মোনিক অডিটোরিয়ামের মতো শহরের বিভিন্ন পরিচিত দ্রষ্টব্যগুলিকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে নিয়ে আসে৷
ছবিতে তিনি ক্ষুদ্র মডেলগুলিকে শোকেসে বন্ধ না রেখে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বসিয়েছেন৷ সান্ড্রা বলেন, ‘‘আমি নানা রকম গভীরতাসহ একটি ডায়োরামা তৈরি করতে চাই৷ আধ মিটার, এক মিটার, অনেক জায়গা ভরিয়ে তুলতে চাই৷ একটির মধ্যে অ্যাকোয়েরিয়ামের মতো পানি ভরা থাকবে৷''
তবে আসল পানি থাকলে চলবে না৷ সান্ড্রা হাফেমাইস্টারের তৈরি ডায়োরামা জাদু ও কাব্যময় জগতে ডুবে যেতে হাতছানি দেয়৷