কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় ৪২ সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যুতে শোকাহত সব রাজনৈতিক দল৷ কিন্তু পাকিস্তানের ওপর দোষ চাপানোর প্রশ্নে সবাই সহমত নয়৷
বিজ্ঞাপন
পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির একটি মন্তব্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷ মমতা বলেছেন, ‘‘তড়িঘড়ি পাকিস্তানের ওপর দোষ চাপানো ঠিক নয়৷ তদন্ত করে দেখা দরকার৷ তাতে যদি ওরাই দোষী প্রমাণিত হয়, তা হলে অবশ্যই পদক্ষেপ করতে হবে৷ কিন্তু কীভাবে, কার গাফিলতিতে এত বড় হামলার ঘটনা ঘটে গেল, তাও দেখতে হবে৷''
মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে সারা দেশ জুড়েই৷ প্রশ্ন উঠেছে, কেন এত বেশি সংখ্যক আধা সামরিক বাহিনীকে একসঙ্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল? কেন সড়কপথে? সেটাও কেন বিনা পাহারায়? যেভাবে হামলা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে জঙ্গিদের কাছে নির্দিষ্ট খবর ছিল৷ কারা খবর দিল?
এতগুলো প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেহেতু বাকি, বিরোধীরা তাই প্রতিক্রিয়ায় অতি সতর্ক৷ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক প্রত্যাঘাত হানার দাবিতে যারা এখন সোচ্চার, তাদের সুরে যাতে সুর না মিলে যায়, এই হামলার রাজনৈতিক ফায়দা তোলার যে চেষ্টা হতে পারে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে, তা থেকে যাতে দূরত্ব বজায় রাখা যায়, সব বিরোধী দলই এখন সে নিয়ে সাবধান৷
সামনে সংসদীয় নির্বাচন৷ সীমান্তে যুদ্ধ বাধিয়ে দেশে জাতীয়তাবাদী হাওয়া তুলে ভোটে কামাল করার চেষ্টা যে শাসকগোষ্ঠী করতেই পারে, সে ব্যাপারে সচেতন সবাই৷ ফলে শনিবার দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাখ সিংয়ের পৌরহিত্যে যে সর্বদলীয় বৈঠক হল, তাতে জঙ্গি হামলার নিন্দা করা হয়েছে সমবেতভাবে, সমস্বরে, কিন্তু সরাসরি পাকিস্তানের নাম করে দোষারোপ করা হয়নি৷ যদিও বলা হয়েছে ভারত-বিরোধী জঙ্গিপনায় প্রতিবেশী দেশের মদত দেওয়ার কথা, কিন্তু ওইটুকুই৷
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।
ছবি: Reuters
19 ছবি1 | 19
এই বৈঠকে ছিলেন কংগ্রেসের গুলাম নবি আজাদ, আনন্দ শর্মা এবং জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া৷ তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে উপস্থিত ছিলেন ডেরেক ও ব্রায়েন এবং সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এছাড়া সিপিআইয়ের ডি রাজা, শিবসেনার সঞ্জয় রাউথ, লোক জনশক্তি পার্টির রামবিলাস পাসোয়ান এবং জম্মু–কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্স পার্টির ফারুক আবদুল্লা৷ বৈঠকে গৃহীত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে দেশের সেনাবাহিনীর প্রতি সমর্থন অটুট রাখার কথাও বলা হয়েছে৷
কলকাতাতে শনিবার নিহত সিআরপিএফ জওয়ানদের স্মরণে একটি মোমবাতি মিছিল হয় হাজরা মোড় থেকে ময়দানে গান্ধী মূর্তি পর্যন্ত, যে মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ মিছিলের শেষে মমতা এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, দেশকে রক্ষা করতে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে এবার এগিয়ে আসতে হবে৷
এদিন রাজ্যের বাম দলগুলিও আলাদা একটি শোক মিছিল বের করে শহরে৷ আর এদিনই বিকেলে কাশ্মীর থেকে ফিরিয়ে আনা হয় নিহত দুই বাঙালি সিআরপিএফ কর্মী বাবলু সাঁতরা এবং সুদীপ বিশ্বাসের কফিনবন্দি দেহ৷ বাবলুর বাড়ি হাওড়া-উলুবেড়িয়ার বাউড়িয়ার চককাশীতে৷ আর সুদীপ ছিলেন নদীয়ার পলাশীপাড়ার তিলিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা৷ দুই নিরাপত্তা কর্মীর পরিবার এবং পাড়া-প্রতিবেশী এদিন ছিল সংবাদ মাধ্যমের নজরে৷ দিনভর তাদেরই খবর প্রচারিত হয়েছে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে৷
তীব্র শোকের মাঝেও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছেন বাবলুর স্ত্রী৷ তিনি বলেছেন, এই হামলার শোধ নিতে যুদ্ধ বাধানো ঠিক হবে না৷ কারণ যুদ্ধে আরও অনেক মানুষের প্রাণ যাবে৷