ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার হঠাৎ ঢাকা সফর অনেক কৌতুহল সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত কী হলো তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে৷
বিজ্ঞাপন
লাদাখ সীমান্তে ভারতের সাথে চীনের যুদ্ধ-পরিস্থিতি, ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ‘নেতিবাচক’ প্রচারণা, বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ- এসব বিবেচনা করলে সফরটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভারতের জন্য৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কী পেলো বা বাংলাদেশের জন্য ভারতের নতুন কোনো বার্তা আছে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে হর্ষবর্ধন শ্রিংলার বৃহস্পতিবারের বৈঠকটিই হলো সফরের উল্লেখযোগ্য বিষয়৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথেও তিনি দেখা করেছেন৷ সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের সাথেও কথা বলেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব৷
এখানে যে বিষয়টি মূলত আলোচনায় উঠে আসছে তা হলো ভারত বাংলাদেশকে করোনার ভ্যাকসিন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেবে৷ তবে এই ভ্যাকসিনটি ভারতের আবিস্কার নয়, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কথাই তারা বলছে৷ ভারতে একটি প্রতিষ্ঠান এই ভ্যাকসিনের সঙ্গে যুক্ত৷ বাংলাদেশে এর ট্রায়ালের কথা হয়েছে৷ বাংলাদেশও সম্মতি দিয়েছে৷ যদিও চীনা ভ্যাকসিনের ট্রায়াল আটকে আছে৷
এর বাইরে এয়ার বাবল, সীমান্ত হত্যা, রোহিঙ্গা সমস্যা, করোনার সময় অর্থনেতিক ও চিকিৎসা সহযোগিতা, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা-এসব বিষয় নিয়েই দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে৷
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় ছিলেন না, ছিলেন তার গ্রামের বাড়ি সিলেটে৷ ফলে তার সাথে শ্রিংলার সাক্ষাৎ হয়নি৷ আর প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার সাক্ষাতের ইস্যুগুলোও জানা যাচ্ছে না আপাতত৷
কোনো চুক্তি বা যৌথ বিবৃতি আমরা দেখিনি: সাবেক রাষ্ট্রদূত শহীদুল হক
তবে বালাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত রীভা গাঙ্গুলি দাশ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শ্রিংলার সাক্ষাতের পর এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে এই বার্তা দিতেই শ্রিংলা ঢাকা সফর করছেন এবং উন্নয়নের পথে অংশীদার হতে ভারত সবসময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশের সাথে ভারতের বিশেষ ও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে৷ এজন্য এই মহামারি চলাকালীনও পররাষ্ট্রসচিব প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে এসেছেন৷’’
এদিকে বৃহস্পতিবার দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘‘করোনাকালের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, সেটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছি৷ আমাদের সম্পর্কে যে অপ্রীতিকর বিষয়গুলো আছে, সেগুলো নিয়েও আলোচনা করেছি৷ সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা করেছি৷ আগামী মাসে আমরা চেষ্টা করবো বিজিবি ও বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠক করার৷ এ বছর প্রথম সাত মাসে সীমান্ত হত্যার সংখ্যাটি বিভিন্ন সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে এবং এ বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছি৷’’
তবে এই সফর আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে করেছিলেন বাংলাদেশের কূটনীতিকরা৷ তারা মনে করেন, আসলে চীন ইস্যুতে ভারতে সঙ্গে একটি ‘আনইজি’ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ সেটা দূর করতেই ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের হঠাৎ ঢাকায় আসা৷ বিশেষ করে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ এবং বাংলাদেশের জন্য আরো কিছু চীনা সুবিধা ভারতকে ‘উদ্বিগ্ন’ করে তোলে৷ তবে এই সফরে সেই পরিস্থিতির অবসান হয়েছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না৷ কিন্তু ভারত যে বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে বলে মনে করেন কূটনীতিকরা৷ সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, ‘‘ভারতের সাথে এখন প্রতিবেশীদের সম্পর্ক খারাপ৷ তারা নানা দিক দিয়ে চাপে আছে৷ তাই ভারত হয়তো সম্পর্কের উন্নয়ন চায়৷ কিন্তু এই সফরে কতটা অগ্রগতি হলো তা বোঝা যাচ্ছে না ৷ কারণ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নরেন্দ্র মোদীর কী বার্তা তিনি নিয়ে এসেছেন তা তো এখনো স্পষ্ট নয়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করা থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা না হওয়া- এসব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে পরিষ্কার কোনো মেসেজ অন্তত আমরা পাইনি৷ দুই পররাষ্ট্র সচিব করোনা ভ্যাকসিনসহ আরো কিছু বিষয়ে যে কথা বলেছেন তা সৌজন্য কথাবার্তা বলেই আমার মনে হয়েছে৷ কোনো চুক্তি বা যৌথ বিবৃতিও আমরা দেখিনি৷’’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন মনে করেন, করোনা ভ্যাকসিন যদি ভারত আগে বাংলাদেশকে দেয় তাতে খারাপ কী? এটাতো একটা সাফল্য৷ করোনা ভ্যাকসিন বাংলাদেশ যদি আগে পায় সেটা ভালো৷ তবে এটাকে এই ‘রুটিন আলোচনার’ সফর বলে তিনি মনে করেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘হঠাৎ করে একদিন আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকায় চলে আসা কোনো রুটিন আলোচনার জন্য বলে আমি মনে করি না৷ এটার ভিতরে একটা রহস্য আছে৷ হতে পারে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে যে আনইজি পরিস্থিতি চলছে সেটা স্বাভাবিক করার বার্তা নিয়ে তিনি এনেছেন৷ তারপরও এটা আমার অনুমান, কারণ, প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি কী বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, কোনো বার্তা নিয়ে এসেছেন কিনা তা তো আমরা জানি না৷ এটা প্রকাশ না করলে আমরা জানবোও না৷’’
তার মতে, ‘‘পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে তা এখন বোঝা যাবে না৷ ভারত যা আশা করে তা পুরণ না-ও হতে পারে৷ আমার কাছে অনেক কিছুই স্বাভাবিক লাগেনি৷’’
গত অক্টোবরের ছবিঘরটি দেখুন...
ভারত বাংলাদেশ যত চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পেয়েছে অন্য এক মাত্রা৷ দুই দেশের সরকারের মধ্যে বেড়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ, হয়েছে নানা চুক্তি, আর একে অপরকে দিয়েছে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ মর্যাদা৷
ছবি: AFP/P. Singh
১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৪ প্রকল্প
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছর পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ভারত সফরে যান৷ সেসময় ১০০ কোটি ডলারের এলওসি বা ঋণরেখা অনুমোদন করে ভারত৷ এই অর্থে জনপরিবহন, সড়ক, রেলপথ সেতু আর অভ্যন্তরীন নৌপথের ১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি হয়৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্দী বিনিময়
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়৷ ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারি তা কার্যকর হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক অন্য দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে অনুরোধক্রমে ফেরত পাঠাতে পারবে৷ তবে এর আগেই অনুপ চেটিয়াসহ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটিতে পাঠানো হয় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Barreto
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়৷ যার মাধ্যমে ২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও হয়ে যায় ভারতের অংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
নদীর পানি বন্টন
বাংলাদেশের ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি৷ এর মধ্যে শুধু গঙ্গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে৷ যদিও পানি বন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি ভারত মানছে না বলে অভিযোগ আছে৷ অন্যদিকে পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তির চেষ্টা চললেও তা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির উদাসীনতার কারণে৷ যার ফলে এখন একতরফাভাবে নদীটির পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হয় এ বিষয়ে নতুন চুক্তি৷ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরো কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি হয়েছে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকার ছিল ৯১৪ কোটি ডলার৷ যার সিংগভাগই ভারতের অনুকূলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে একটি উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যার মধ্যে আছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ; বিদ্যুৎ; শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
এই চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেশ অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রক্ষার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর মর্যাদা দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বাংলাদেশ ভারতের পণ্য পরিবহন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের জল, স্থল ও রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা নিতে পারে৷ ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালে আখাউড়া অগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয়৷ যা পরবর্তীতে নিয়মিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভারতের রেল যাবে বাংলাদেশ হয়ে
আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাবে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী এজন্য দুই দেশকে তাদের অংশের রেলপথ নির্মাণ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অংশের সাত কিলোমিটার রেলপথ আগামী বছরে জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: DW/P. Mani
সাবরুমের মানুষে জন্য ফেনীর পানি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি সমঝোতা সই ও চুক্তি হয়েছে৷ একটি সমঝোতার আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷
ছবি: AFP/P. Singh
বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত আটটি রুটে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোদে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে৷ এজন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে৷
ছবি: DW/U. Danisman
চুক্তি থাকলেও হত্যা থেমে নেই
সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ একটি চুক্তি করে৷ নেয়া হয় সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ তবে সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷