1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ষাটের দশকের বেড়িবাঁধে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ

সুলাইমান নিলয়
২৮ মে ২০২১

বাংলাদেশে ইয়াস ভয়ঙ্কর রূপে হানা না দিলেও জলোচ্ছাসের কারণে সাতক্ষীরাসহ কিছু এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ অনেক বাঁধ প্রাচীন এবং ‘অকার্যকর’ হওয়ায় উপকূলীয় ওইসব এলাকায় ক্ষতি বেশি হয়েছে বলে স্থানীয় এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷

ফাইল ছবি৷ছবি: AFP/M.U. Zaman

গিরিন্দ্রনাথ রপ্তানের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে৷ এক সময় তার এত বিপুল সংখ্যক গরু ছিল যে, সেই দুধ মানুষকে বিলিয়ে বেড়াতেন৷ আরো নানাভাবে করতেন সমাজসেবা৷  সাত বার নদী ভাঙনের শিকার হওয়ার পর এখন গিরিন্দ্রনাথ বাস করেন কুঁড়েঘরে৷

সাতক্ষীরার সাংবাদিক শরীফুল্লাহ কায়সার সুমনের মতে, এখানে এরকম গিরিন্দ্রনাথের সংখ্যা হাজার হাজার৷ টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে চারদিকে কেবল মানুষের নিঃস্ব হওয়ার গল্প৷ 

এই বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, জল-জলোচ্ছ্বাস ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলের মানুষের জীবন এখন বিপর্যস্ত৷ আর এই সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে বেড়িবাঁধ৷ এটা ঠিক না হলে মানুষের জীবন-জীবিকা কোনো কিছুই ঠিক করা যাচ্ছে না৷ 

বাংলাদেশে বেড়িবাঁধের দায়িত্বে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড৷ স্বাধীনতার আগে এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পানি উইং৷ 

প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মহাপরিচালক এ কে এম ওয়াহেদ উদ্দিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ষাটের দশকে ৫ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধউপকূলীয় অঞ্চলে নির্মাণ করা হয়েছিল৷ এরপর তার কোনো মেজর রিহ্যাবিলিটেশন হয়নি৷ তবে এখন অনেকগুলোতে কাজ করছে৷ আবার অনেক জায়গায় বেড়িবাঁধ করার জন্য জাইকা, এডিবির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ জোগানোর চেষ্টা চলছে৷ ঠিকঠাক মতো অর্থ পাওয়া গেলেও এই সব বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণে ৫ বছর লেগে যাবে৷’’

‘ভাঙা বাঁধগুলো এখন অভিশাপ’

This browser does not support the audio element.

ইয়াসের ক্ষয়ক্ষতি

পাশের নদীর জোয়ারের পানি বেড়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার  বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অধিকাংশ জায়গা দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। বেশ কিছু এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এই ইউনিয়নের মোট অধিবাসীর সংখ্যা ৪৪ হাজার।  

এর মধ্যে ইয়াস উপকূলে আঘাত হানার ৪৮ ঘণ্টা পরও সেখানে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার, বলেছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান। এখানকার হাজারো চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষির ঘের ভেসে গেছে।

শ্যামনগর উপজেলার কেবল এই ইউনিয়নেই নয়, বরং গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ, কৈখালী ইউনিয়ন, আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা, প্রতাপনগরসহ আশপাশের এলাকায়ও ছিল একইচিত্র। বুধবার দুপুরের পরের জোয়ারে ৫/৬ ফুট উচ্চতার পানি লোকালয়ে ঢুকে ঘরবাড়ি, মাছের ঘের, কাঁকড়া খামার, ফসলি জমি ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

সরকারি হিসাবে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারের পানি বেড়ে উপকূলীয় ৯টি জেলার ২৭টি উপজেলায় ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশের স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

লবণাক্ত পানিতে সুন্দরবনের অধিকাংশ পুকুর ভেসে গেছে। ফলে বনজীবী ও পশুপাখিরা খাবার পানির সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। 

কী চায় মানুষ

নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, ‘‘এখানকার মানুষের দুর্দশার কারণ বেড়িবাঁধ না থাকা৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, এই উপকূলবাসীকে বাঁচাতে বেড়িবাঁধের কোনো বিকল্প নেই৷'' 

তিনি বলেন, ‘‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসিনতা, গাফিলতি, দুর্নীতি, অর্থপ্রাপ্তির বিলম্বের কারণগুলো অনুসন্ধানপূর্বক এই অঞ্চলের মানুষের পরিত্রাণের উপায় এখনই খোঁজা উচিত বলে আমি মনে করি৷ টেকসই বেড়িবাঁধের ব্যবস্থা করা হোক৷ গত ৩০ বছর ধরে আমরা এটা দেখছি৷'' 

‘নিঃস্ব হওয়ার গল্প হাজার হাজার’

This browser does not support the audio element.

বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চারপাশে ২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে৷ এগুলোও ষাটের দশকে নির্মাণ করা৷ এই দীর্ঘ সময় এই বাঁধ নানা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷

ভবতোষ কুমারের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জোয়ারের পানি বাড়ছে৷ এই অবস্থা সামলাতে পারছে না জোড়াতালি দেয়া বেড়িবাঁধ৷ তাই উপকূলে ষাটের দশকের এই বেড়িবাঁধ এখন অভিশপ্ত এক নাম৷

তিনি বলেন, ‘‘বেড়িবাঁধ না থাকার কারণে মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট হয়ে গেছে৷ খাবার পানির উৎস ধ্বংস হয়ে লবণাক্ত হয়ে গেছে৷ কোথাও কোথাও ১০ কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়৷ সাঁতরে, বুক পানি- গলা পানি গিয়ে অনেককে পানি আনতে যেতে হয়৷’’

এবারের ইয়াস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ঝড় না হলেও জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে  বড় ধরনের প্লাবন তৈরি করে ফেলেছে৷ গাবুরা পদ্মপুকুর ইউনিয়নেও একটা বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হতে চলেছে৷’’

কেমন বেড়িবাঁধ হলে সবচেয়ে ভালো হয়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বেড়িবাঁধের সাথে স্লুইজ গেট থাকবে৷ পানি ব্যবস্থাপনা করা হবে৷ আউটগোয়িং এবং ইনকামিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে৷ এটা হলে জলাবদ্ধতা থাকবে না৷ রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, মানুষের কর্মসংস্থান সবকিছু নির্ভর করে এই বেড়িবাঁধের উপরে৷ বেড়িবাঁধ হলে এখানে সুপেয় পানি সমস্যার সমাধান হবে৷’’

‘পুরনো বেড়িবাঁধ ভাঙার দাবিও রয়েছে’

শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল ষাটের দশকে৷ এখানকার উপকূলীয় এলাকা যাতে নদীর পানিতে তলিয়ে না যায়, ফসলের যাতে ক্ষতি না হয়৷’’

তিনি বলেন, ‘‘এই বাঁধের বিরুদ্ধেও কিন্তু এক সময় আন্দোলন ছিল যে, এই বাঁধ আমাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে৷ নদীর গতিপথ বদলে দিচ্ছে৷ পরবর্তীতে সেই বাঁধও নষ্ট হয়ে গেছে৷ কোথাও বাঁধ এখন এক হাত, কোথাও এক বিঘত, কোথাও এটা চার ফুট আছে৷’’

তিনি বলেন, বাঁধ নিয়ে এখন এই এলাকায় দুটি বিষয় আছে৷ প্রথমত, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবি৷ দ্বিতীয়ত, সেটা সেটা যদি না হয়, তাহলে যে বাঁধ আছে, সেটা সরিয়ে নাও৷’’

‘সাইক্লোন-জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলার উপযোগী হবে আগামীর বাঁধ’

This browser does not support the audio element.

‘‘এর কারণ হচ্ছে, ভাঙা এসব বাঁধের ভেতরে পানি ঢুকে আটকে থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে জীবন-জীবিকার উপর আঘাত হানে৷ বাঁধ একেবারে না থাকলে জোয়ারে পানি আসতো, ভাটায় দ্বিগুণ বেগে তা নেমে যেতো৷ এখনকার মতো এত ক্ষতি হতো না৷”

তিনি বলেন, ‘‘যেখানে দুর্বল বাঁধ, সেখানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে মূলত বিশেষ করে ২০০৭ সাল থেকে৷ ৯১-এর ঘুর্ণিঝড়েও ভেঙেছে৷ কিন্তু প্রবলভাবে বাঁধ ভাঙা শুরু হয় সিডর থেকে, যা আইলায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়৷ তারপর ফনী-বুলবুল-আম্ফা, সর্বশেষ ইয়াস৷’’ 

"ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে সাতক্ষীরার নদী উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগর, আশাশুনি৷ পরে একই চিত্র উঠে এসেছে কালীগঞ্জ, দেবহাটা- এই চার উপজেলা থেকে৷ এমনকি তালা উপজেলার টিআরএমের বাঁধও ভেঙে গেছে৷ মানুষের ঘর-বাড়ি পানিতে ভেসে গেছে৷ দেখলে মনে হবে এখানে সাগর হয়ে গেছে, যেন এখানে কখনোই ফসল ছিল না, মৎস্য খামার ছিল না, কাঁকড়ার প্রকল্পও ছিল না৷ এসব কিছু পানিতে একাকার হয়ে গেছে৷

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ