দূরের কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শন অথবা হারিয়ে যাওয়া অতীতের কোনো স্থাপনা কি জীবন্ত করে তোলা যায়? বাংলাদেশের এক ভার্চুয়াল মিউজিয়াম আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ঠিক সেই উদ্যোগ নিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার ষাট গম্বুজ মসজিদ তুঘলকি নির্মাণশৈলির অপূর্ব নিদর্শন৷ সেই মসজিদের অন্ধকার অলিগলি ঘুরে দেখতে এখন আর সশরীরে হাজির থাকার প্রয়োজন নেই৷ ভার্চুয়াল রিয়ালিটি প্রযুক্তির কল্যাণে যে কেউ সেখানে ঢুঁ মারতে পারে৷ ভার্চুয়াল মিউজিয়াম বাংলাদেশ উদ্যোগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশেক এ ইলাহী অনি সেই ওয়েবসাইটের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘‘ল্যান্ডিং পেজেই আমরা দেখতে পাবো যে বেশ কয়েকটা জায়গা নির্দিষ্ট করা আছে, যেখানে আমি টেলিপোর্ট করে যেতে পারবো৷ ধরা যাক ষাট গম্বুজ মসজিদে যেতে চাই, সেখানে টেলিপোর্ট করে যাবো৷ ওখানে সিলেক্ট করবো৷ নির্দিষ্ট জায়গায় টেলিপোর্ট করে গেলেই সাথে সাথে ষাট গম্বুজ মসজিদে ঢুকে যাবো এবং পুরো জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবো৷ সেখানেও হ্যান্ড কনট্রোলারের সাহায্যে টেলিপোর্ট করে করে বাইরে, ভিতরে সবকিছুই দেখতে পারবো৷ এমনকি ষাট গম্বুজের ছাদে উঠেও দেখতে পারবো পুরো ব্যাপারটা কেমন৷''
বাংলাদেশের ভার্চুয়াল মিউজিয়াম
04:55
বাংলাদেশের প্রথম ভারচুয়াল মিউজিয়াম হিসেবে সম্প্রতি এই উদ্যোগ যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করেছে৷ দেশের ঐতিহ্যের নিদর্শনগুলির বেহাল অবস্থা দেখে ডেভেলপারদের মনে এই আইডিয়া আসে৷ ভার্চুয়াল মিউজিয়াম বাংলাদেশ উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী ও ডেভেলপার আহমেদ জামান সঞ্জীব বলেন, ‘‘ভার্চুয়াল মিউজিয়াম বাংলাদেশের আইডিয়াটা আসে ২০১৭ সালে, পানাম সিটিতে বেড়াতে গিয়ে৷ পানাম সিটিটার অবস্থা আসলে তখন অনেকটাই খারাপ ছিল৷ সেখানে ঘুরতে গিয়ে মনে হলো যে এইটা তো আর খুব বেশিদিন ধরে রাখা যাবে না৷ এটার জন্য কোনোভাবে আমরা কি কিছু করতে পারি? তখন মনে হলো যে হ্যাঁ, হয়তো একটা উপায় আছে৷ এটা ভিআর-এ ডিজিটাল রেস্টোরেশন করা যায়৷ তখন ভিআর টেকনোলজিটা একদম নতুন ছিল৷''
একদল সফটওয়্যার ডেভেলপারর সেই যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না৷ তারা বিশাল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে অবশেষে একটি সিমুলেশন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন৷ আহমেদ জামান সঞ্জীব বলেন, ‘‘ছয়শ বছর আগে যখন ষাট গম্বুজ মসজিদটি তৈরি হয়েছিল, তখন সেটা আসলে কী রকম ছিল? আমাদের মূল লক্ষ্য থাকে সেটাকে বের করে আনা৷ এই জায়গায় আসলে প্রথম আমাদের চ্যালেঞ্জ যেটা হয়, সেটা হলো ডাটা বা তথ্য৷ আমরা প্রথমে যত বেশি সম্ভব ডাটা কালেকশন করি৷ তারপর সেই ডাটা সাজানো হয়, বাদ দেওয়া হয় এবং একেবারে আসল ডাটা আমরা রাখি৷ সেই ডাটা থেকে আমরা একটা সিমুলেশন করি৷ সিমুলেশনটা করার পর আমরা একটা লুক বা চেহারা পেয়ে যাই, যে জিনিসটা এ রকম৷ সেখানে থ্রিডি মডেলিং ও ডাটা স্ক্যানিংয়ের বিষয় জড়িত থাকে৷ তারপর আমরা দেশের ইতিহাসবিদ, স্থপতি ও বিশেষজ্ঞদের দেখাই৷ জিনিসটা দেখার পর তারা মতামত দেন৷ আমরা সেটিকে আরো একটি ফাইন টিউনিং করার পর একটা চেহারা স্পষ্ট হয়ে যায়৷ এই প্রক্রিয়ায় আমরা এখন কাজটা করছি৷
মসজিদের শহর বাগেরহাটের বিশ্ব ঐতিহ্য
খুলনার প্রচীন মসজিদের শহর বাগেরহাটের নাম ছিল খলিফাতাবাদ৷ শহরটির প্রতিষ্ঠাতা খান-ই-জাহান ছিলেন এক সাধক পুরুষ৷ ষাট গম্বুজ মসজিদসহ এখানকার নানা প্রাচীন স্থাপনা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায় ১৯৮৫ সালে৷
ছবি: DW/M. Mamun
নির্মাণ কাল ১৪৫৯
খান জাহান আলীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি ষাট গম্বুজ মসজিদ৷ ঐতিহাসিকদের মতে, এই ষাট গম্বুজ মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দেরও কিছু আগে৷
ছবি: DW/M. Mamun
একাশিটি গম্বুজ
নাম ষাট গম্বুজ হলেও মসজিদটিতে মূলত একাশিটি গম্বুজ আছে৷ মসজিদের ছাদে ৭৭টি এবং চারকোণার টাওয়ারে চারটি৷ তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ষাটটি স্তম্ভ থাকার কারণে এর নাম হয়ত ষাট গম্বুজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
অভ্যন্তর ভাগ
ষাট গম্বুজ মসজিদের ভেতরের অংশ৷ এই অংশ অতীতে চুন-শুরকির মিশ্রণে লাল রঙের হলেও, পরবর্তীতে তা পলেস্তরা আরা সাদা রঙের প্রলেপে ঢাকা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢেকে ফেলা হয়েছে কালো পাথর
ষাট গম্বুজ মসজিদের ভেতরের স্তম্ভগুলো ছিল মূলত কালো পাথরের তৈরি৷ উত্তর দিকের একটি স্তম্ভ খালি দর্শনার্থীদের দেখার জন্য রেখে বাকি স্তম্ভগুলোর মূল্যবান কালো পাথর ঢেকে ফেলা হয়েছে সিমেন্টের পলেস্তারার প্রলেপে৷ বাংলাদেশের অনেক প্রাচীন স্থাপনাই এরকম অদক্ষ সংস্কারের নামে ধ্বংস করেছে খোদ সরকারেরই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর!
ছবি: DW/M. Mamun
সিংড়া মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপনা সিংড়া মসজিদ৷ইট নির্মিত মসজিদের প্রাচীরগুলি প্রায় সাত ফুট প্রশ্বস্ত৷ মসজিদের পূর্ব দেয়ালে আছে তিনটি প্রবেশপথ৷ প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি অলংকৃত মিহরাব৷ তবে কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং সুসজ্জিত৷ এর নির্মাণ শৈলী বিবেচনা করে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সিংড়া মসজিদের নির্মাণকাল পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি৷
ছবি: DW/M. Mamun
হযরত খানজাহান আলীর সমাধিসৌধ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এক গম্বুজ বিশিষ্ট হযরত খানজাহান আলীর সমাধিসৌধ৷ কথিত আছে, হযরত খান জাহান আলী বাগেরহাটে এসেছিলেন ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দের পরে৷ তিনি প্রথমে দিল্লির সুলতান এবং পরে বাংলার সুলতানের কাছ থেকে সুন্দরবন অঞ্চলের জায়গির লাভ করেন৷ এখানকার গভীর বন কেটে তিনি মুসলিম বসতি গড়ে তোলেন৷ ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর খান জাহান আলীর মৃত্যু হলে, এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
জিন্দাপীর মসজিদ
হযরত খানজাহান আলীর সমাধির পশ্চিম দিকে ঠাকুর দিঘির পশ্চিম পাড়ে সুন্দরঘোনা গ্রামে ইট নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট জিন্দাপীর মসজিদ৷ মসজিদের পাশেই হযরত খানজাহানের অনুসারী জিন্দাপীরের সমাধি৷ তাঁর নামেই এ মসজিদের নামকরণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
নয় গম্বুজ মসজিদ
খান জাহান আলীর সমাধির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, ঠাকুর দিঘীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত নয় গম্বুজ মসজিদ৷ ইটের তৈরি এ মসজিদের উপরে নয়টি গম্বুজ রয়েছে৷ পুরো মসজিদের গায়ে পোড়ামাটির কারুকাজ খচিত৷ মসজিদের ছাদ নয়টি নীচু অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ দিয়ে ঢাকা৷
ছবি: DW/M. Mamun
নয় গম্বুজের মিহরাব
নয় গম্বুজ মসজিদের অভ্যন্তরভাগ৷ মসজিদের ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
রণবিজয়পুর মসজিদ
বাগেরহাট শহরের উপকণ্ঠে রণবিজয়পুর গ্রামের ষাটগম্বুজ সড়কে এ মসজিদটি অবস্থিত৷ ফকিরবাড়ি মসজিদ নামেও এর পরিচিতি আছে৷ স্থাপত্যশৈলির বিচারে এটিকে হযরত খান জাহান আলীর সময়কালে (১৪৫৯ সাল) নির্মিত বলে মনে করা হয়৷ ইটের তৈরি এ মসজিদটি বর্গকারে নির্মিত এবং এক কক্ষ বিশিষ্ট৷ রণবিজয়পুর গ্রামের নামেই এ মসজিদের নামকরণ হয়েছে৷ রণবিজয়পুর মসজিদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ৷
ছবি: DW/M. Mamun
চুনাখোলা মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে ধান খেতের মধ্যে অবস্থিত চুনাখোলা মসজিদ৷ বর্গাকৃতির এ মসজিদটি বাইরের দিকে লম্বায় প্রায় ৪০ ফুট এবং ভেতরের দিকে ২৫ ফুট৷ দেয়ালগুলি প্রায় আট ফুট চওড়া৷ কেন্দ্রস্থলের উপরের দিকে রয়েছে বড় একটি গম্বুজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিবি বেগনী মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে এক গম্বুজ বিশিষ্ট বিবি বেগনী মসজিদ৷ মসজিদটি সিংড়া মসজিদের অনুরূপ হলেও, এর পশ্চিম দেয়ালে মিহরাবের সংখ্যা তিনটি৷ মসজিদটির সঠিক নির্মাণকাল সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তি
খান জাহান আলীর স্থাপত্য শৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তির অবস্থান বাগেরহাট শহরের উপকণ্ঠে সাবেকডাঙ্গা গ্রামে৷ লাল ইটের তৈরি আয়তকার এ ভবনটি একেক পাশে দৈর্ঘ্য ৭.৮৮ মিটার৷ ভবনটির দক্ষিণপাশে কেবল একটি প্রবেশপথ আছে৷ এর ভেতরে আর কোন দরজা, জানালা কিংবা মিহরাব নেই৷ তাই এটিকে মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি৷ জনশ্রুতি আছে খান জাহান আলী তাঁর বিশেষ প্রার্থনার জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
13 ছবি1 | 13
এই ভারচুয়াল মিউজিয়ামের বিটা ভার্সন বা প্রাথমিক খসড়া এরই মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেছে৷ ২০২২ সালে সেটির উদ্বোধন হওয়ার কথা৷ আশেক এ ইলাহী অনি বলেন, ‘‘এটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা এবং আমরা মনে করি যে আমরা ভারচুয়াল রিয়ালিটির মাধ্যমে আমরা অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরেছি, এখনো হয়ত পুরোপুরি শতভাগ সফল হইনি, কিন্তু আমরা সেই মান অর্জন করার আশা রাখি৷
বাংলাদেশের ভার্চুয়াল মিউজিয়ামে ইতিহাস জীবন্ত করে তোলা হচ্ছে৷ ফলে মানুষ কয়েক'শো বছর আগে ফিরে গিয়ে অতীতের স্বাদ নিতে পারেন৷