ভারতের ষোড়শ সংসদে বিরোধী দলনেতা কে হবেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের কপালে ভাঁজ৷ কারণ সংসদীয় বিধিনিয়ম অনুসারে বিরোধী দলনেতার স্বীকৃতির জন্য সংসদের মোট আসন সংখ্যার ১০ শতাংশ পেতে হবে সেই দলকে, যা কংগ্রসের নেই৷
বিজ্ঞাপন
সফল সংসদীয় গণতন্ত্রের শর্তই হলো কার্যকর বিরোধী দল৷ কিন্তু ভারতের নব নির্বাচিত ষোড়শ সংসদে বিরোধী দলগুলির কোমর একেবারে ভেঙে গেছে৷ সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় মাত্র ৪৪টি আসন পেয়ে বিরোধী দলের মর্যাদা হারাতে বসেছে প্রধান জাতীয় দল কংগ্রেস৷
১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রচলিত বা প্রথাগত নিয়ম হলো, কোনো দলকে বিরোধী দলনেতার মান্যতা পেতে হলে তাকে লোকসভার মোট ৫৪৩টি আসনের এক-দশমাংশ, অর্থাৎ ৫৪টি আসন পেতে হবে৷ এক্ষেত্রে কংগ্রেসের তা নেই৷ অথচ সংসদে বিরোধী দলনেতা ছাড়া সংসদীয় কাজকর্ম চলতে পারে না৷ কারণ সংসদীয় আইনে এমন অনেক সংস্থান আছে, যেখানে বিরোধী দলনেতার অনুমোদন প্রয়োজন৷ এই যেমন কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন, কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর প্রধানের নিযুক্তি বা লোকপাল নিয়োগ৷ বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অবশ্য নির্ধারিত আইন সংশোধন করা চলতে পারে৷
এছাড়া আর বিকল্প কী হতে পারে? বিরোধী দলগুলির কোয়ালিশন? কংগ্রেসকে সরিয়ে রেখে প্রধান প্রধান আঞ্চলিক দলগুলি এক জোট হয়ে বিরোধী দলের স্থান নিতে চেষ্টা করছে৷ যেমন আসন সংখ্যার ভিত্তিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার এআইএডিএমকে-র হাতে আছে ৩৭ জন সাংসদ, তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূলের হাতে আছে ৩৪টি আসন এবং ওড়িষার নবীন পট্টনায়েকের বিজু জনতা দলের ঝুলিতে আছে ২০টি আসন৷ অর্থাৎ মোট ৯১টি আসনের জোট৷
বলা বাহুল্য, এদের মধ্যে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে ‘ফ্লোর কোঅর্ডনেশন'-এর আলোচনা৷ তৃণমূল চেষ্টা করছে বিরোধী দলনেতার পদ, ডেপুটি স্পিকার এবং পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির মতো ইস্যুগুলি নিয়ে একটা সমঝোতায় আসতে৷ যদি সার্থক সমন্বয়ের মাধ্যমে লোকসভায় যৌথভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা নিতে পারে এই জোট, তাহলে সেটা হবে বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্য বিকল্প৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল সুভাষ কাশ্যপ অবশ্য মনে করেন, কোনো একটি দল যদি লোকসভার ১০ শতাংশ আসন পায় তাহলে সেই দলের নেতা বিরোধী দলনেতার স্বীকৃতি পেতে পারেন৷ প্রাক-নির্বাচনি কিংবা নির্বাচন-পরবর্তী কোনো জোটের নেতাকে এটা দেয়া যায় না৷ বড়জোর তাদের বিরোধী জোটের নেতা বলা যেতে পারে, কিন্তু বিরোধী দলনেতা বলা যাবে না৷
এই যুক্তি খণ্ডন করে কংগ্রেস তরফে বলা হয়েছে, এতে সেরকম কোনো আইনগত বাধা নেই৷ স্পিকার ইচ্ছা করলে তা করতে পারেন৷ ১০ শতাংশের শর্ত পালন বাধ্যতামূলক নয়৷ কংগ্রেসের বিদায়ী আইন মন্ত্রীর মতে, বৃহত্তম দলের নেতাকেই বিরোধী দলনেতার পদ দেয়া যেতে পারে৷ উল্লেখ্য, ১৯৫২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রথম পাঁচটি সংসদীয় নির্বাচনে কোনো বিরোধী দলনেতা ছিলেন না৷ আর চতুর্থ লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস দু'ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল৷