মুখে ধর্মের কথা বললেই কেউ ধার্মিক হয়ে যায় না৷ ধর্ম মূলত চর্চার বিষয়৷ আর ভাষণ-বিবৃতি সম্বল করেই কেউ সু-রাজনীতিবিদ হতে পারেন না৷ অথচ এমন লোকদের কারণেই বাংলাদেশে বাকি সবাই আজ নিরাপত্তাহীন৷
বিজ্ঞাপন
কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে জোরদার আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রথমে টার্গেট করা হলো ব্লগারদের৷ নাস্তিকতার ধুয়া তুলে প্রকাশ করা হলো তথাকথিত ‘হিটলিস্ট'৷ তালিকা প্রকাশে শুরুর নামটা হেফাজতের, কিন্তু সমর্থনে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি কেউই বাদ ছিল না৷ কেউ প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়েছে, কেউ বা পরোক্ষে৷ পরোক্ষ সমর্থনে আওয়ামী লীগের নামটাও রাখতেই হবে, কেননা, সরাসরি জোর বিরোধীতা না করা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বশক্তি নিয়োগ না করা অপশক্তিকে সমর্থনেরই নামান্তর৷ সরকার তো ধর্মান্ধ অপশক্তিকে রোখার চেষ্টা থেকে সরে এসে তাদের বরং খুশি রাখার চেষ্টাই করছে৷
নিরাপত্তা নিয়ে যা ভাবছে দেশের মানুষ
বাংলাদেশে একের পর এক মুক্তমনা, ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, প্রকাশক, ব্লগার ও ভিন্ন ধর্মের মানুষ খুন হচ্ছে৷ পুলিশ এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বললেও, দেশের মানুষ খুব উদ্বিগ্ন৷ ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে রিকশা চালক – আজ কতটা নিরাপদ আমরা?
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
আব্দুল্লাহ রিফাত, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাত্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ রিফাত৷ তার মতে, বাড়ি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় – কোথাও তেমন নিরাপদ না কেউই৷ তবে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে তিনি ভাবছেন না এই মুহূর্তে৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
নাফিউল হাসান, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাফিউল হাসান মনে করেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কেউই নিরাপদ নয়৷ আমরা একরকম ভয়ের মধ্যেই বসবাস করছি৷ যতক্ষণ বাইরে থাকি, বাসায় অভিভাবকরা চিন্তায় থাকেন৷ অনেক সময় তো স্বাভাবিক ঘোরাফেরাও বন্ধ করতে হচ্ছে৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
প্যারিস তালুকদার, তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া প্যারিস তালুকদার মনে করেন, গত দুই বছরের আগ পর্যন্ত নিজের নিরাপত্তা নিয়ে কখনো ভাবিনি, গভীর রাত পর্যন্তও ঘুরে বেড়াতাম বিভিন্ন জায়গায়৷ তবে গত দিনগুলোর নানান ঘটনায় আমার নিজেরই খুব ভয় হয়৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
ফারিয়া রিফাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী
বেশ নির্ভিক টাইপের মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ফারিয়া রিফাত৷ কিন্তু দেশের বর্তামান পরিস্থিতিটা তার কাছে খুবই ঘোলাটে মনে হচ্ছে৷ প্রত্যেক দিনই বড় কোনো অঘটন ঘটছে৷ পত্রিকা খুললেই খুন-খারাবির খবর, মনে হচ্ছে ‘মার্ডার’ করাটা এখন সহজ ক্রাইম৷ আমরা প্রত্যেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি৷ ঘর থেকে বেড়িয়ে আবার যে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারব, এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
আরিফ জেবতিক, ব্লগার
ব্লগার আরিফ জেবতিক বললেন, ‘‘নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই আছি৷ ব্যক্তিগতভাবে যে যেভাবে পারছি সাবধানে থাকার চেষ্টা করছি৷ জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন আনতে হয়েছে৷ এই যেমন, ‘পাবলিক প্লেসে’ যাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি৷ সিনেমা দেখতাম, নাটক দেখতাম, জগিং করতাম৷ এখন এগুলো আর করতে পারি না৷ যেহেতু পরিস্থিতির কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নেই, তাই এভাবেই সাবধানে থাকতে হচ্ছে৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
হযরত আলী, ব্যবসায়ী
পুরনো ঢাকার ব্যবসায়ী হযরত আলী৷ তাঁর মতে, দেশের কোনো শ্রেণির মানুষেরই নিরাপত্তা নেই৷ দিনে-দুপুরে খুন-খারাবি চলছে৷ তাই দিন কিংবা রাত – কখনোই নিরাপদ নই আমরা৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
হারিছ মিয়া, ফল ব্যবসায়ী
মাদারীপুরের হারিছ মিয়া গত প্রায় ১৭ বছর ধরে ঢাকায় ফলের ব্যবসা করেন৷ গত কয়েক বছরের তুলনায় বর্তমানে খুন-খারাবি বেড়ে যাওয়ায় খুবই চিন্তিত তিনি৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
আক্কাস আলী, দিনমজুর
পুরনো ঢাকায় ঠেলাগাড়ি চালান আক্কাস মিয়া৷ জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার সময় নেই তাঁর৷ আপাতত সন্তানদের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে পালেই সন্তুষ্ট তিনি৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
আব্দুর রহমান, রিকশা চালক
লালমনির হাটের আব্দুর রহমান ঢাকায় রিকশা চালান গত প্রায় ছ’বছর ধরে৷ জীবনের নিরাপত্তার চেয়েও তাঁর কাছে বেশি চিন্তার বিষয় ছিনতাই৷ রাস্তায় থাকা হয় বলে প্রতিনিয়ত অনেক ছিনতাইয়ের সাক্ষী তিনি্৷ কিন্তু জীবনের ভয়ে সেগুলোর প্রতিবাদ না করে নিরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করতে হয় তাঁকে৷ কিন্তু এতে খুবই মনোকষ্টে ভোগেন বিদ্যালয়ের প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে না পারা এই রিকশা চালক৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
আবুল কালাম, অটোরিকশা চালক
শেরপুরের আবুল কালাম অটোরিকশা চালান ঢাকা শহরে৷ তাঁর কথায়, দেশে কোনো নিরাপত্তা নেই৷ যে যেভাবে পারছে খুন-খারাবি করে যাচ্ছে৷ অপরাধীরা থাকছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷ অনেকে ধরা পড়ার খবর শুনলেও তাদের বিচারের আর কোনো খবর পান না বলে জানালেন এই অটোরিকশা চালক৷
ছবি: DW/Muhammad Mostafigr Rahman
10 ছবি1 | 10
এক্ষেত্রে সরকারি দলকে ১০ নম্বর দিলে জনসমর্থনের দিক থেকে অতি ছোট বা প্রায় অনু্ল্লেখ্য দলগুলোকেও কিছু নম্বর দিতেই হবে৷ ধর্মান্ধতা এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারের পরোক্ষ আপোসের বিরোধীতায় বাম বা অন্য ছোটদলগুলোও তেমন কোনো তৎপরতাই দেখায়নি৷ সরকারি দলের সঙ্গে তাদের পার্থক্য শুধু বিবৃতিতে৷ আর বাংলাদেশে শুভকাজে বিবৃতির কার্যকারীতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা তো কবে থেকেই প্রায় শূন্যের কোঠায়৷
দু'টো ভাষণ বা বিবৃতি অবশ্য কার্যকারিতার দিক থেকে দশে দশ পেয়েছে৷ সেগুলো যে শুভ উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছিল এমন দাবি অবশ্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ অন্তত করতে পারবেন না৷ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যে বক্তৃতায় ব্লগারদের বখাটে এবং নাস্তিক বললেন আর আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা যে ভাষণে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার পর কিছু ঘটে গেলে তার দায়িত্ব সরকার নেবে না' বললেন, সেই দু'টোর পর তো বাংলাদেশে ধর্মান্ধতাবিরোধী লড়াইটা পুরোপুরি পাতানো ম্যাচ হয়ে গেছে৷
এ এমন এক খেলা যেখানে দুই পক্ষ, অর্থাৎ বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ ঠিক করে নিয়েছে ‘গোল' করবে না, অর্থাৎ ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান বা ব্যবস্থা নেবে না৷ দেশের সবচেয়ে বড় দু'টি দল যখন ‘চিরশত্রুতা' ভুলে কৌশলগতভাবে এক অবস্থানে, তখন যা হওয়া স্বাভাবিক তা-ই তো হচ্ছে৷
ধর্মের নাম করে, ধর্মের অবমাননা রোধের ধুয়া তুলে এখন যা খুশি তা-ই করা যাচ্ছে বাংলাদেশে৷ ব্লগার মারা যাচ্ছে৷ শিক্ষক মারা যাচ্ছে৷ সমকামী অধিকার কর্মীকে মারা যাচ্ছে৷ হিন্দু দর্জিকে মারা যাচ্ছে৷ মাইকে ঘোষণা দিয়ে হিন্দু শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ প্রচার করে তাঁকে আচ্ছামতো পিটিয়ে কান ধরে ওঠ-বস করানোর পর চাকরিচ্যুতও করা যাচ্ছে৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন ধর্মের নামে সব সম্ভবের দেশ৷
বাংলাদেশে এখন বিদেশি নাগরিক, খ্রিষ্টান পাদ্রী, হিন্দু পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যাও ডাল-ভাত৷ এমনটি কিন্তু আগে দেখা যায়নি৷ দেখার কথাও নয়৷ ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেয়া ছাড়া আর কোনো ইস্যুতে আওয়ামী লীগ-বিএনপির এমন ‘বোঝাপড়া' কি আগে কখনো হয়েছে? হ্যাঁ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় হয়েছিল৷ স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল তখন৷ দু'দলের বর্তমান অলিখিত ‘ঐক্য' ধর্মান্ধতার পক্ষে৷ সুতরাং, সাধু সাবধান!
আপনিও কি মনে করেন ধর্মের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রায় একই অবস্থানে? লিখুন নীচের ঘরে৷
বাংলাদেশে আবারো মুক্তমনাদের হত্যা শুরু
গতবছর চার ব্লগার এবং একজন সেক্যুলার প্রকাশককে হত্যার পর কিছু দিন বিরতি ছিল৷ কিন্তু চলতি বছর আবারো শুরু হয়েছে মুক্তমনাদের উপর আঘাত৷ চলতি মাসেই তাতে নিহত চারজন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S.Ramany
নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ড
গত ৮ এপ্রিল ঢাকায় খুন হন সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের সক্রিয় সদস্য নাজিমুদ্দিন সামাদ৷ গতবছর ব্লগারদের যেভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে ঠিক সেভাবেই সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করে ফেলে রেখে যাওয়া হয়৷ উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠী ‘আনসার আল ইসলাম’৷
ছবি: Facebook/Nazimuddin Samad
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খুন
গত ২৩ এপ্রিল রাজশাহীতে খুন হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী৷ বাড়ি থেকে মাত্র কয়েকগজ দূরে বাসস্টান্ডে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে মোটর সাইকেলে পালিয়ে যায় দুই দুর্বৃত্ত৷ তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: DW/A. Islam
রূপবানের সম্পাদক খুন
বাংলাদেশে সমকামীদের একমাত্র পত্রিকা রূপবানের সম্পাদক জুলহাস মান্নানকে হত্যা করা হয় তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে প্রবেশ করে৷ কমপক্ষে ছয় দুর্বৃত্ত কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী পরিচয় দিয়ে তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে৷ আর তারপর হত্যাকাণ্ড ঘটায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S.Ramany
সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট মাহবুব তনয় খুন
সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট এবং মঞ্চকর্মী মাহবুব তনয় ছিলেন মান্নানের বন্ধু৷ তাঁকেও ঐ একইসময়ে হত্যা করা হয়৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার আল-ইসলাম’ দু’টি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে জানিয়েছে, বাংলাদেশে সমকামিতার প্রসারে ভূমিকা রাখায় তাঁদের খুন করা হয়েছে৷