নিলামে চড়ানো হয়েছিল ভারতের সরকারি বিমান পরিবহণ সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়াকে৷ কিন্তু কোনও শিল্পপতি, গোষ্ঠী, বা সংস্থাই উৎসাহ দেখালো না৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের আকাশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের ক্ষেত্রে ‘এয়ার ইন্ডিয়া' এবং ‘ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স', এই দুটি সরকারি উড়ান সংস্থারই একছত্র আধিপত্য ছিল দীর্ঘদিন৷ সেসময় ওই দুই সংস্থার গর্বিত বিজ্ঞাপন ছিল— আমরা বিমান সফরের টিকিট বিক্রি করি না, লোকে আমাদের থেকে টিকিট কেনে! এবং এই একাধিপত্যের সুযোগ নিয়ে একদিকে বিমানযাত্রা চিরকালই মহার্ঘ এবং একমাত্র বিত্তবানের আয়াস-সাধ্য হয়ে থেকেছে৷ অন্যদিকে একচেটিয়া কারবার হওয়া, কোনও প্রতিযোগিতা না থাকার যা যা কুফল, সবই এই দুই উড়ান সংস্থার পরিষেবায় চোখে পড়েছে৷ দ্রুত পড়েছে পরিষেবার গুণমান৷
বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ/অনিরাপদ এয়ারলাইন্সের তালিকা
২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৬০টি এয়ারলাইন্সের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ এবং সবচেয়ে অনিরাপদ এয়ারলাইন্সগুলোর তালিকা করেছে জার্মানির জেএসিডিইসি ইনস্টিটিউট৷ তালিকাটি দেখে বোঝা যায় বিমানযাত্রায় বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে মানুষ৷
ছবি: Reuters/E. Su
অনিরাপদ চায়না এয়ারলাইন্স
২০১৬ সালে ৩৭০ কোটি যাত্রী তাদের বিমানে যাতায়াত করেছে৷ যাঁরা চায়না এয়ারলাইন্সে যাতায়াত করেছেন তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছে এটি একটি অনিরাপদ পরিবহন৷ তাই ৬০ টি এয়ারলাইন্সের তালিকায় তাইওয়ানিজ এয়ারলাইন সবচেয়ে অনিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/X. Qintao
কলম্বিয়ার অ্যাভিয়াঙ্কার বিকল্প নেই
গত ৩০ বছরের নিরাপত্তার উপর ভিত্তি করে ঐ তালিকা করা হয়েছে৷ বিমান কতবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, কত যাত্রী নিহত হয়েছে, বিধ্বস্ত হয়েছে কিনা, এছাড়া কত কিলোমিটার যাত্রা করেছে এবং যাত্রী সংখ্যা কত- এসবের ভিত্তিতে তালিকা করা হয়েছে৷ এসবের ভিত্তিতে তাদের ০ থেকে ১.০০ পয়েন্ট দেয়া হয়েছে৷ কলম্বিয়ার অ্যাভিয়াঙ্কার স্কোর দাঁড়িয়েছে ০.৯১৪৷ ২০১৬ সালের সবচেয়ে খারাপ বিমানের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থান তাদের৷
ছবি: AFP/Getty Images
ইন্দোনেশিয়ায় এয়ারলাইন্সে বিধ্বস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি
গারুদা ইন্দোনেশিয়ার স্কোর ০.৭৭৭৷ খারাপ বিমানের তালিকায় এর অবস্থান তৃতীয়৷ ১৯৫০ সালে চলাচল শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এই এয়াররলাইন্স ৪৭টি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে মোট ৫৮৩ জন৷
ছবি: A.Berry/AFP/GettyImages
গবেষণা নিয়ে সমালোচনা
কিন্তু জেএসিডিইসি’র তালিকা কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়েছে, কেননা, টেকনিক্যাল কোনো ত্রুটির কথা তারা উল্লেখ করেনি৷ এমনকি মানব আচরণের সমস্যার কথাও নেই সেখানে৷ আবহাওয়া বা সন্ত্রাসী হামলার উল্লেখ নেই, যেমন, সন্ত্রাসবাদ বিমানের নিরাপত্তার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় হুমকি৷ এর কারণে ১০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ বিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক সিমন অ্যাশলে বলেছেন, সন্ত্রাসের ভয় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ৷
ছবি: AP
খারাপ আবহাওয়া
এছাড়া ভয়াবহ খারাপ আবহাওয়ার কারণে বহু দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিমান৷ সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দুর্ঘটনার ১০ ভাগ দুর্ঘটনা তুষারপাত, কুয়াশা এবং ঝড়ের কবলে পড়ে হয়েছে৷
ছবি: dapd
প্রযুক্তিগত কারণ
বর্তমানের বিমানগুলো নতুন প্রযুক্তি সমৃদ্ধ৷ দুর্ঘটনার ২০ ভাগ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eisele
মানব আচরণ
বিমানের চালকরা ঝুঁকির অন্যতম কারণ৷ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অর্ধেকের বেশি দুর্ঘটনা হয় তাদের ভুলের কারণে৷ মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভুল থেকেও দুর্ঘটনা ঘটে৷ এছাড়া পাইলটের মানসিক অবস্থার উপরও দুর্ঘটনা নির্ভর করে৷
ছবি: picture alliance/ROPI
আকাশের হিরো
২০০৯ সালে হাডসন নদীতে ১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে নেমে পড়েছিল বিমান৷ পাইলট ছিলেন চেসলে শুলেনব্যর্গার৷ কিন্তু তিনি পানিতে বিমানটি অবতরণ করাতে পারায় প্রাণে বেঁচেছিলেন যাত্রীরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Day
দুর্ঘটনার শিকার বিমান
দুর্ঘটনার পর যেসব বিমান মেরামত করে আবার চালানো হয়, সেগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে সবসময়ই উদ্বেগ থাকে৷ বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলেন না যে দুর্ঘটনায় পড়া বিমান আদৌ নিরাপদ কিনা৷
ছবি: Reuters
এবং বিজয়ী
হামবুর্গভিত্তিক ঐ গবেষণা তালিকায় হংকংয়ের ক্যাথে প্যাসিফিক ২০১৬ সালের সবচেয়ে নিরাপদ এয়ারলাইন্স হয়েছে৷ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এয়ার নিউজিল্যান্ড এবং তৃতীয় অবস্থানে চীনের হাইনান এয়ারলাইন্স৷ জার্মানির লুফৎহানসার অবস্থান তালিকায় দ্বাদশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যে দুর্ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে
জেএসিডিইসি জানিয়েছে, গত বছর বিমান দুর্ঘটনায় ৩২১ জন প্রাণ হারিয়েছে৷ এ বছর যে বিমান দুর্ঘটনাটি সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা হলো ৭২ জন যাত্রী নিয়ে বলিভিয়া থেকে কলম্বিয়া যাওয়ার সময় মেডেলিন বিমানবন্দরের কাছে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা, যেখানে ব্রাজিলের শাপেকোইনসি রেয়াল ফুটবল দলের খেলোয়াড়রাও নিহত হন৷
ছবি: Reuters/F. Builes
11 ছবি1 | 11
সরকারি কর্মচারীদের মার্কামারা ‘নিতে হলে নিন, না হয় বাদ দিন' হাবভাব প্রকট হয়ে উঠেছে কর্মীদের আচরণে৷ এর পাশাপাশি আরও বেতন, আরও সুযোগের দাবিতে প্রায়ই আন্দোলন, কর্মবিরতি৷ এমনকি ধর্মঘটও প্রায় নিয়মিত হয়ে ওঠে দুই সরকারি সংস্থায়৷ ফলে যেদিন থেকে বেসরকারি উড়ান সংস্থা ভারতের বাজারে পা রাখলো একের পর এক, বিমানসফরের খরচ দ্রুত কমলো, পরিষেবা আন্তর্জাতিক মানের হলো এবং সমস্ত ব্যাপারেই নিখুঁত পেশাদারিত্ব এলো, এয়ার ইন্ডিয়া আর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স দ্রুত নিজেদের ব্যবসা হারিয়ে জরাগ্রস্ত দুই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো৷ তাদের দুরবস্থা এখন এতটাই যে, সরকার দায়মুক্ত হতে পারলে বাঁচে!
কিন্তু খোলাবাজারে নিলাম ডেকে এয়ার ইন্ডিয়াকে বিক্রি করা, বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা সদ্য সদ্য ব্যর্থ হলো৷ কোনও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না দেখে নিলামের দিন বাড়ানো হয়েছিল, কিন্তু তাতে বাজারে উৎসাহ বাড়লো না৷ শোনা গেল, শেষ পর্যন্ত কোনও ক্রেতাই এয়ার ইন্ডিয়ার বিপুল পরিমাণ আর্থিক ঘাটতির বোঝা নিজেদের ঘাড়ে নিতে চাইছে না৷ এই আর্থিক দায়ের মধ্যে আছে বিরাট সংখ্যক কর্মীর বেতন এবং প্রাক্তন কর্মীদের অবসরকালীন ভাতা৷ এই দায়িত্ব নিতে কেউ রাজি নয়৷ এ কারণে ভারতের একাধিক উড়ান সংস্থা আগ্রহ দেখিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে৷
DhrubajyotiNandy - MP3-Stereo
কিন্তু এখন এ-ও জানা যাচ্ছে, এটা হয়তো সম্ভাব্য ক্রেতাদের সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর যোগসাজশ, যাতে সরকারি শর্তে নয়, খদ্দেরের শর্তেই এয়ার ইন্ডিয়ার হাতবদল হয়৷ যেমন, সরকার চাইছে ৭৬% মালিকানা ছেড়ে দিয়ে ২৪% নিজের হাতে রাখতে৷ কিন্তু কোন সম্পত্তি সরকার ছাড়তে চায়, কোনটা রাখতে চায়, সেটা এখনও ক্রেতাদের কাছে স্পষ্ট নয়৷ ডয়চে ভেলেকে জানালেন বাজার বিশেষজ্ঞ ধ্রুবজ্যোতি নন্দী৷ তিনি বলছেন, এয়ার ইন্ডিয়ার এখনও এমন অনেক সম্পত্তি আছে, যা ধরে রাখা লাভজনক হবে বলে সরকার মনে করছে৷ এয়ার ইন্ডিয়া সূত্রের খবর, ভারতের সব বড় শহর ছাড়াও বিশ্বের বেশ কিছু বড় শহরে এয়ার ইন্ডিয়ার নিজস্ব দপ্তর থেকে শুরু করে বিমানবন্দরগুলিতে দীর্ঘমেয়াদি ইজারা নেওয়া নিজস্ব জায়গা এবং আরও স্থাবর বিষয়-সম্পত্তি আছে৷ এছাড়া বিমান বন্দর কর্মীদের এক প্রশিক্ষিত দলও এয়ার ইন্ডিয়ার আছে, যা আয়তনে বিরাট৷ এর মধ্যে সরকার কোনটা ধরে রাখতে চায়, সেটা এখনও পরিষ্কার নয়৷ ফলে ঝুলেই থাকলো এয়ার ইন্ডিয়ার ভবিষ্যৎ৷ তবে ক্রেতাদের মনোভাবের আঁচ পেয়ে সরকার এখন তড়িঘড়ি সব কিছু স্পষ্ট করতে উদ্যোগী৷ জানা যাচ্ছে, কিছুদিনের মধ্যেই নতুন নিলামের আয়োজন হবে৷