বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কারাগারে আটক রাখা হলে রাজনৈতিক সংকট আরো বাড়বে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা৷ তাঁদের মতে, নেতাদের মুক্ত করে স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে দেয়া উচিত৷
বিজ্ঞাপন
বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলের ৩৬ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে রাজধানী ঢাকায় তেমন কোন উত্তাপ ছিলনা৷ পিকেটারদের বা কারাগারের বাইরে থাকা নেতাদের তেমন মাঠে দেখা যায়নি৷ দু'একজনকে অল্প সময়ের জন্য বাইরে দেখা গেলেও গ্রেফতার আতঙ্কে তারা দ্রুত আবার আড়ালে চলে যান৷ তবে ঢাকার বাইরে কয়েকটি এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে৷ আর বগুড়ায় পিকেটারদের ইট পাটকেলের আঘাতে একজন ট্রাক ড্রাইভারের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷
এদিকে হরতাল চলাকালে বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিএনপির কোনো শীর্ষ নেতাকে দেখা যায়নি৷ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু৷ তিনি দাবি করেন, হরতালে তাদের ৫ জন নেতা-কর্মীকে ৬ মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত৷ সারা দেশে ২০০ নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে৷ তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় নেতাদের আটক করে আন্দোলন দমানো যাবেনা৷ আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন ঘটান হবে৷
হেফাজতের ১৩ দফা, অস্থির বাংলাদেশ
ঢাকায় শনিবার (০৬.০৪.১৩) মহাসমাবেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম৷ ‘নাস্তিক' ব্লগারদের ফাঁসি, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে এই সমাবেশ করে তারা৷ হেফাজতের এসব দাবির বিপক্ষে অবস্থান অনেকের৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ
আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাগুলোর হিসাবে শনিবারে ঢাকার মতিঝিলে জড়ো হন লক্ষাধিক মানুষ৷ হেফাজতে ইসলাম এর সমর্থক তারা৷ সংগঠনটির আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফী এই সমাবেশ থেকে তাদের ১৩ দফা দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
কী আছে ১৩ দফায়?
শাহবাগের কথিত ‘নাস্তিক' ব্লগারদের ফাঁসি, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশে যত ভাস্কর্য আছে সব ভেঙে ফেলা এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধের মতো দাবি রয়েছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফায়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
আক্রান্ত নারী সাংবাদিক
শনিবার মহাসমাবেশ চলাকালে হেফাজতে ইসলামের লোকজন ঢাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়৷ তারা হামলা চালিয়েছে একুশে টেলিভিশনের নারী সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ওপর৷ পুরুষদের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন এই অজুহাত তুলে তারা শারমিনকে প্রকাশ্যে বেধড়ক পেটায়৷ সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য সাংবাদিকের ওপর হামলার দায় অস্বীকার করেছে হেফাজত৷
ছবি: Getty Images
সমর্থন, ধন্যবাদ
হেফাজতের এই মহাসম্মেলনে সরাসরি সহায়তা করেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের জোট সঙ্গী জাতীয় পার্টি৷ পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ সমাবেশের জন্য হেফাজতে ইসলামকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর৷
ছবি: Reuters
‘নতুন কোন আইন নয়’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, হেফাজতের দাবি অনুযায়ী ইসলাম অবমাননার অভিযোগ বিচারের জন্য নতুন কোনো আইন করার পরিকল্পনা সরকারের নেই৷ একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে হাসিনা বলেন, ‘‘সরকার হেফাজতের সবগুলো দাবিই দেখবে৷ এর মধ্যে কোনোটি গ্রহণযোগ্য হলে তা পূরণ করা হবে৷ আর যেসব দাবি ‘গ্রহণযোগ্য নয়’, সেগুলো পূরণ করা হবে না৷’’
ছবি: dapd
‘দাবি মানার কোন কারণ নেই’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘হেফাজতের যে সব দাবি, তা মেনে নেয়ার কোন কারণ নেই৷ তারা দেশকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায়৷ তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতার ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলাও ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে৷ এই হুমকিকে ভয় পায়না স্বাধীনতা এবং প্রগতির পক্ষের শক্তি৷’’
ছবি: AP
‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং নারী স্বাধীনতা, প্রগতি, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, ঐতিহ্য ও বাংলাদেশের হাজার বছরের সংস্কৃতি বিরোধী৷ তাদের দাবি মেনে নিলে দেশ অন্ধকার যুগে চলে যাবে৷ দেশে মোল্লাতন্ত্র চালু হবে৷ তা এদেশের মানুষ মানবেনা৷’’
ছবি: Reuters
নারী সমাজের প্রতিবাদ
নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং হেফাজতের নারী প্রগতি বিরোধী দাবির বিরুদ্ধে সংগঠিত হচ্ছেন নারী সমাজ৷ ঢাকায় একাধিক প্রতিবাদ সমাবেশে তারা বলেছেন, বাংলাদেশকে মধ্য যুগে ফিরিয়ে নেয়ার চক্রান্ত সফল হবেনা৷ হেফাজত আর জামায়াত শিবির এক হয়ে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে চায়৷ কিন্তু তাদের এই ষড়যন্ত্র কখনোই সফল হবেনা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে’
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের নেতারা মনে করেন, হেফাজতে ইসলাম নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেশের অগ্রগতি রুখতে চায়৷ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘‘প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে৷ এর কোনো বিকল্প নেই৷’’
ছবি: REUTERS
ব্লগার গ্রেপ্তার
হেফাজতের শনিবারের মহাসমাবেশের আগেই অবশ্য ‘ইসলাম ধর্ম নিয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য ও কটূক্তি’র অভিযোগে চার ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ৷ অনেকে মনে করেন, সরকার দৃশ্যত হেফাজতের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করতে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করছে৷ আরো কয়েকজন ব্লগারকে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১১ শীর্ষ নেতা এখন কারাগারে৷ মঙ্গলবার তাঁদের জামিনের আবেদন জানান হলেও আদালত ২১শে এপ্রিল জামিন আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য করেছেন৷ তাই ধরেই নেয়া যায়, ২১শে এপ্রিলের আগে এই নেতাদের কেউ মুক্তি পাচ্ছেন না৷ ফখরুল ছাড়া আটক অন্য নেতারা হলেন: ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, মির্জা আব্বাস, আব্দুল্লাহ আল নোমান, রুহুল কবির রিজভী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, আমান উল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ ভুলু, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল৷ হরতালের সময় গাড়ি ভাঙচুরসহ নাশকতার মামলায় তাঁদের গ্রেফতার করা হয়৷
এই পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ নিয়ে তার কোন কথা নেই৷ তাঁরা অপরাধ করেছেন কি করেন নি, তা আদালতেই নির্ধারিত হবে৷ তবে এই শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারে রাজনৈতিক সংকট আরো বাড়বে৷ সরকারের উচিত বিরোধী দলের নেতাদের মুক্ত এবং স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেয়া ৷ বিরুদ্ধ মতকে কারাবন্দি করে রাখা ঠিক না৷
অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিস কেন্দ্রের পরিচালক মানবাধিকার নেতা নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, শীর্ষ বিরোধী নেতাদের এভাবে কারাবন্দি রাখলে সংবিধান, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ এতে সামনের নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর অনিশ্চিত হয়ে পড়বে৷
তিনি বলেন, আটক বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগই থাকুক না কেন, তাঁদের জামিনে মুক্তি দেয়া উচিত৷ কারণ তারা দেশের সুপরিচিত রাজনীতিবিদ৷ তাঁরা দেশ থেকে পালিয়ে যাবেন, এমন ধারণা করা ঠিকনা৷ আর গণতান্ত্রিক চর্চায় আইন সবার জন্য সমান হওয়া উচিত৷ বিরোধী দলের জন্য নিবর্তনমুলক আর সরকারি দলের জন্য সহযোগিতামূলক – এই নীতি আইনের শাসনের পরিপন্থি৷