বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করেছেন সুশীল সমাজের ছয়জন প্রতিনিধি৷ রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তাঁরা৷ আর রাষ্ট্রপতি নিজের সাংবিধানিক ক্ষমতার মধ্যে সংকট নিরসনের আশ্বাস দিয়েছেন বলে প্রকাশ৷
বিজ্ঞাপন
সুশীল সমাজের এই প্রতিনিধিরা হলেন সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী, অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, ড. আকবর আলি খান এবং গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন৷
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বঙ্গভনে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে তাঁরা প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক করেন৷ জানা গেছে, বৈঠকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের উপায় নিয়ে কথা বলেন নাগরিক প্রতিনিধিরা৷ তাঁরা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা, নির্বাচনকালীন সরকার এবং বিরোধী দলের আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন৷ সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা এবং একপাক্ষিক নির্বাচনে সংকট যে আরো গভীর হবে, তা তাঁরা তুলে ধরেন রাষ্ট্রপতির কাছে৷ এ নিয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথাও জানান৷ তাঁরা দেশের চলমান সংকট নিরসনে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেন৷ শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি তাঁর সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করার আশ্বাস দিয়েছেন৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে জানান, দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবেই তাঁরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন৷ তাঁরা মনে করেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি৷ এছাড়া নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ করতেও সবার অংশগ্রহণ একটা ভূমিকা পালন করে, বলেন তিনি৷ কিন্তু নির্বাচন কমিশন সব দলের অংশগ্রহণ ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়েই তফসিল ঘোষণা করছে৷ প্রসঙ্গত, তফসিল ঘোষণার পর এ পর্যন্ত সহিংসতায় নয়জন নিহত হয়েছেন৷
ড. বদিউল আলম বলেন, এখন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন৷ এ জন্য সংলাপের কোনো বিকল্প নেই৷ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও, সময় শেষ হয়ে যায়নি৷ এখনো সংলাপ হতে পারে৷ বলা বাহুল্য, প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আন্তরিক হলে সমঝোতা সম্ভব৷ আর সমঝোতা হলে নির্বাচনের তফসিল পুনর্নির্ধারণ সম্ভব৷ এমনকি ২৪শে জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে, সেই সময়ের মধ্যেই সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন সম্ভব৷ তাই সব দল যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে বা অংশ নেয়, সে জন্য উদ্যোগ নিতে রাষ্ট্রপতির কাছে অনুরোধ জানান হয়েছে বলে জানান বদিউল আলম মজুমদার৷ রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন সংলাপ আয়োজনের৷
সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে জানান, তাঁরা দেশের ও দশের মানুষের কথা চিন্তা করেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন৷ রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা থাকলেও দেশের সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসেবে একটি নৈতিক গুরুত্ব আছে৷ সেই জায়গা থেকেই তাঁরা রাষ্ট্রপতিকে সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ করেছেন৷
রাষ্ট্রপতির পর তাঁরা প্রধান দুই রাজনেতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেত্রীদ্বয়ের সঙ্গে দেখা করবেন কি? এমন প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখনো এ ব্যাপারে তাঁরা কোনো সিদ্ধান্ত নেননি৷