বাংলাদেশে নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে৷ তাঁদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ ব্লগ আর ফেসবুকে এই হামলার সমালোচনার পাশাপাশি, কারা এর জন্য দায়ী তা নিয়েও আলোচনা চলছে৷
বিজ্ঞাপন
সামহয়্যার ইন ব্লগে তানভীর আরিফ লিখেছেন, ‘‘এটা কেমন দেশ কিছু হলেই কিছু স্বার্থান্বেষী লোকজন, যার মধ্যে বিভিন্ন দলের লোকজন দেখা যায়, যারা সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়িতে হামলা করে প্রকৃত পরিস্থিতি অন্য কোনো দিকে আড়াল করতে চায়৷ সংখ্যালঘুদের উপর রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক সকল হামলার তীব্র নিন্দা এবং ঘৃণা জানাই৷ সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি যারা করেন তাদের ধিক্কার জানাই৷ মনে করিয়ে দিতে চাই, সংখ্যালঘুরা আমাদের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অংশ এবং আমাদের জন্য গৌরবের৷ এই দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে তাদের গৌরবদীপ্ত ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই৷''
তানভীর আরিফ তাঁর পোস্টটি শেষ করেছেন এভাবে, ‘‘এই মুহূর্তে একটাই সমাধান, চলুন সবাই হিংসা-বিদ্বেষের পরিবর্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়, ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে সচেষ্ট হই৷''
একই ব্লগে রেজা ঘটক ‘‘সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর এই হামলার দায় কার!!!'' শীর্ষক ব্লগে লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশে যে-কোনো ধরনের নির্বাচন ও রাজনৈতিক টানাপোড়নের প্রথম শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়৷ এর কারণ কি? সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্যতম হাতিয়ার৷ এটি সবচেয়ে বড় কারণ৷ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্য, সংখ্যালঘুদের সহায় সম্পত্তি লুটপাট ও ভোগ-দখল করার জন্য, সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার জন্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক অজুহাতে সংখ্যালঘুদের উপর বিভিন্ন সময়ে নির্মম নির্যাতন, অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ সহ অনেক মানবতাবিরোধী কাজ করে থাকে৷ এটা এতটাই নির্মম, পাশবিক, হৃদয় বিদারক ও মর্মস্পর্শী যে, তখন আর কিছুতেই মানুষ হিসেবে দাবি করা যায় না, বাংলাদেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র৷''
পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে মানবতা
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
এদিকে তারেক মোরতাজা ফেসবুকে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে লিখেছেন, ‘‘আমার জন্ম এমন এক গ্রামে যেখানে মুসলিম বাড়ি মাত্র তিনটি৷ আরেকটি আমার দাদার বাড়ি৷ আরেকটি আবুল মিয়ার বাড়ি৷ শতাধিক পরিবার নিয়ে যে গ্রাম সেখানে এই তিনটে বাড়ির ছেলে মেয়েরা এক অসাধারণ সখ্যতার ভেতর দিয়ে বড় হয়েছে৷ এখনো সেটি অব্যাহত রয়েছে৷ নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর উপজেলার চর বজলুল করিম গ্রামটিতে যে-কোনো বিবেচনায় শান্তি ও আনন্দের স্মৃতি নিয়ে আমরা বড় হয়েছি৷....৩৩ বছর পর খবরের কাগজে হিন্দু বাড়ি ঘর, উপাসনালয় পুড়িয়ে দেবার খবর অনেক বেশি পড়ছি৷ এটি আমাকে খুবই কষ্ট ও পীড়া দেয়৷ আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই ধর্মপরায়ণ, পর্দানশিন এবং ধর্মের বাইরে যে-কোনো কর্মকাণ্ডকে বরদাশত করেন না৷ কিন্তু এমন একটা পরিবারে আমরা ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি পাশের বাড়ি আলোরানী মাসি, সুধীর ও মানিকের মা মাসি, রুনা আমাদের বাড়িতে আড্ডায় জমাতো, এখনো জমায়৷''
হামলার ঘটনার সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘...যে-কোনো ছুঁতোয় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও পাহাড়িদের নিয়ে হাঙ্গামা, তাদের বলির পাঠা বানিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার কোনো যুক্তি না থাকলেও আমরা সেটিই করি এবং এটা নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গের মতোই ঘটনা৷''
আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ লিখেছেন, ‘‘কপাল ভালো বাংলাদেশে হিন্দু হয়ে জন্ম নেইনি৷ হলে হয়ত আমার বাড়িতে কোনো না কোনো সময় ঢিল পড়তো, কোনো না কোনো সময় হয়তো আক্রমণ হতো৷ আমার বা আমার বাবা বা আমার মা বা আমার বোন বা আমার ভাই-ভাতিজার ওপরও হয়ত কোনো না কোনো সময় হামলা হতো৷''