সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র৷ দেশটি হামলা বন্ধে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জেন সাকি নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই উদ্বেগের কথা জানান৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলায় আমরা হতাশ৷ আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি৷'' হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যারা ক্ষমতায় আছেন এবং যারা ক্ষমতা প্রত্যাশী – দুই দলের পক্ষেই সম্ভাব্য সবকিছু করতে হবে হামলা ঠেকাতে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ প্রতিরোধে৷''
অন্যদিকে ‘রুখে দাড়াও বাংলাদেশ'এর ব্যানারে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সংখ্যালঘু নির্যাতনের এলাকা পরিদর্শন করে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছেন৷ তাঁরা নির্যাতিতদের সঙ্গে কথা বলছেন, কথা বলছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে৷ এই নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল৷ তাঁর সঙ্গে আছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংবাদিক আবেদ খান সহ আরো অনেকে৷ আবেদ খান ডয়চে ভেলেকে জানান, তাঁরা ইতিমধ্যেই সাতক্ষীরা, যশোর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, মাগুরা, নাটোরসহ আরো কয়েকটি এলাকায় গিয়েছেন৷ সর্বশেষ তাঁরা বৃহস্পতিবার দিনাজপুরের কর্ণাই গ্রামে যান৷ সেখানে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখেন, কথা বলেন নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে৷
মালোপাড়ার হিন্দুদের কান্না থামেনি
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়াকে ঘিরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার মালোপাড়ায় ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি লুটপাটও করা হয়৷
ছবি: DW
নেই নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া
যশোরের অভয়নগরের চাপাতলী গ্রামের প্রবেশপথে পুলিশের সতর্ক অবস্থান৷ গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের দিন এই গ্রামের নিম্নবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত মালোপাড়ায় বসবাসরতদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে৷ আক্রান্তরা জানান, ঘটনাস্থলের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে থানার অবস্থান হলেও অনেক ফোন করেও সে সময়ে পুলিশ কিংবা কোনো নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া মেলেনি৷
ছবি: DW
‘নদী ঠাকুর’
দুর্বৃত্তদের হামালায় লণ্ডভণ্ড মায়া রানি বিশ্বাসের একমাত্র মাথা গোঁজার ছোট্ট নিবাস৷ সেদিন হামলা শুরু হলে পাশের বুড়ি ভৈরব নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে উঠে প্রাণে বেঁচে যান বিধবা এই নারী৷ তাঁর ভাষায় ‘নদী ঠাকুর’ সেদিন না থাকলে জানটা হয়ত থাকতো না৷
ছবি: DW
প্রাণ বাঁচাতে নদীতে
নিজের ঘরের ভাঙা আসবাব, টেলিভিশনের পাশে মালোপাড়ার গৃহবধু উজ্জ্বলা বিশ্বাস৷ হামলাকারীদের ভয়াবহ রূপ সামান্য দেখেছিলেন তিনি৷ প্রাণ বাঁচাতে তিনিও ঝাঁপ দেন বুড়ি ভৈরবে৷ হামলার সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল যে ভগবান সেদিন পাশে ছিলেন না৷
ছবি: DW
বই-পত্র পুড়িয়ে দিয়েছে
কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের বই-পত্র, এমনকি সার্টিফিকেটও পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা৷
ছবি: DW
সুন্দর স্বপ্নে চির
হামলাকারীদের ভেঙে দেয়া আয়নায় কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব৷ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো এই ভাঙা আয়নার মতোই মঙ্গলার সুন্দর স্বপ্নেও চির ধরিয়েছে হামলাকারীরা৷ মঙ্গলার আক্ষেপ, তাঁর বই-পত্র আর সার্টিফিকেট কী দোষ করলো?
ছবি: DW
আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয়
হামলার ছয় দিন পরে এঁরা ফিরছেন বাড়িতে৷ হামলার সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: DW
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী
৮৬ বছর বয়সি মৃত্যুঞ্জয় সরকার সেদিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও দেশ ছাড়েননি তিনি৷ কিন্তু হামলার পর তাঁর মনে হচ্ছিল যে, সে সময়ে ছেড়ে যাওয়াটাই উচিত ছিল তাঁর৷
ছবি: DW
গাছও রেহাই পায়নি
বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি মালোপাড়ার গাছও জ্বালিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: DW
পলাতক জামায়াত নেতা
মালোপাড়ায় হামলার পরে চাপাতলী গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বালিয়াডাঙ্গায় স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর থানা আমীর মাওলানা আব্দুল আজিজের বাড়ি ভাঙচুর করে যৌথবাহিনী৷ ঘটনার আগে থেকেই পলাতক রয়েছেন এ জামায়াত নেতা৷
ছবি: DW
আক্রান্তদের অভিযোগ
জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুল ওহাব৷ মালোপাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য জামায়াত শিবির ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলকেও দায়ী করেছেন অনেকে৷ সাবেক এই সাংসদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন৷ সেখানে নতুন প্রার্থী হিসেবে রণজিৎ রায় মনোনয়ন পাওয়ায় এই দুই জনের সমর্থকদের মাঝে বেশ উত্তেজনা ছিল পুরো নির্বাচনের সময়টায়৷
ছবি: DW
গণধর্ষণ
যশোরের আরেক ভয়াল জনপদ মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল গ্রামের দাসপাড়ার বাসিন্দা অনারতী দাস৷ ৭ জানুয়ারি রাতে তাঁর সামনেই অস্ত্রের মুখে একদল দুবৃত্ত গণধর্ষণ করে পুত্রবধু মনিমালা দাস আর ভাতিজি রূপালী দাসকে৷
ছবি: DW
ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী
কার্তিক দাসকেও সেদিন রাতে সেই ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিল৷ দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার নিম্নবর্ণের হিন্দু মনিমালা দাসের শ্বশুর ও রূপালী দাসের চাচা তিনি৷
ছবি: DW
বাড়িঘর ছেড়েছেন
দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার হওয়া পরিবার দুটি আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়েছেন৷
ছবি: DW
শুধুই আতঙ্ক
দাসপাড়ার এক নারী৷ দাসপাড়ার নারীদের এখন নির্ঘুম রাত কাটে আতঙ্কে৷
ছবি: DW
14 ছবি1 | 14
তিনি জানান, তাঁরা দেখেছেন সংখ্যালঘুরা হামলার পরও চরম আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷ শত শত পরিবার সব হারিয়ে বলতে গেলে এখন নিঃস্ব৷ আর নির্বাচন বিরোধীরাই অধিকাংশ জায়গায় তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে৷ পরিস্থিতি এমন যে তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়া না হলে তারা তাদের এলাকায় থাকতে সাহস পাবেন না৷
আবেদ খান জানান, কোনো কোনো এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সংখ্যালঘুদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন৷ তবে পুলিশ বা প্রশাসনিক নিরাপত্তা পর্যাপ্ত নয়৷ নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের এখন সবধরণের নিরাপত্তা দেয়ার দাবি জানান তিনি৷
সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘রাজনৈতিক ঘটনার আড়ালে হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া চলছে৷ এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে৷''
আবেদ খান জানান, তাঁরা আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের সব এলাকা ঘুরে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা প্রকাশ করবেন৷ এই প্রতিবেদন সরকারকেও দেয়া হবে৷ প্রতিবেদনে হামলার জন্য কারা দায়ী, কেন হামলা করা হলো, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং সুপারিশ থাকবে৷ তিনি বলেন, তবে সরকারের এখন অবিলম্বে আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া উচিত৷