সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা বিচার করতে সরকার ব্যর্থ – বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান৷ তাঁর এ কথাকে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষের বক্তব্য বলে অভিহিত করেছেন শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার জাতীয় পূজা উদযাপন পরিষদ আয়োজিত দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে অতিথি ছিলেন শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নসিম ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান৷ সেখানেই ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘গত ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, সরকার ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতার জন্য তার বিচার হয়নি৷''
এরপর শিল্পমন্ত্রী তোফয়েল আহমেদ তাঁর বক্তব্যে ড. মিজানের সমালোচনা করে বলেন, ‘‘সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কী কারণে সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে আপনারা কোনো কথা বলেন না৷ শুধু সরকারের সমালোচনা করেন৷ এ থেকেই বোঝা যায় যে, প্রকৃত বুদ্ধিজীবী ও বিএনপি-জামায়াতপন্থি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে পার্থক্য৷ এই বক্তব্য প্রকারন্তরে বিএনপি জামায়াতের পক্ষেই যায়৷''
মালোপাড়ার হিন্দুদের কান্না থামেনি
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়াকে ঘিরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার মালোপাড়ায় ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি লুটপাটও করা হয়৷
ছবি: DW
নেই নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া
যশোরের অভয়নগরের চাপাতলী গ্রামের প্রবেশপথে পুলিশের সতর্ক অবস্থান৷ গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের দিন এই গ্রামের নিম্নবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত মালোপাড়ায় বসবাসরতদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে৷ আক্রান্তরা জানান, ঘটনাস্থলের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে থানার অবস্থান হলেও অনেক ফোন করেও সে সময়ে পুলিশ কিংবা কোনো নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া মেলেনি৷
ছবি: DW
‘নদী ঠাকুর’
দুর্বৃত্তদের হামালায় লণ্ডভণ্ড মায়া রানি বিশ্বাসের একমাত্র মাথা গোঁজার ছোট্ট নিবাস৷ সেদিন হামলা শুরু হলে পাশের বুড়ি ভৈরব নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে উঠে প্রাণে বেঁচে যান বিধবা এই নারী৷ তাঁর ভাষায় ‘নদী ঠাকুর’ সেদিন না থাকলে জানটা হয়ত থাকতো না৷
ছবি: DW
প্রাণ বাঁচাতে নদীতে
নিজের ঘরের ভাঙা আসবাব, টেলিভিশনের পাশে মালোপাড়ার গৃহবধু উজ্জ্বলা বিশ্বাস৷ হামলাকারীদের ভয়াবহ রূপ সামান্য দেখেছিলেন তিনি৷ প্রাণ বাঁচাতে তিনিও ঝাঁপ দেন বুড়ি ভৈরবে৷ হামলার সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল যে ভগবান সেদিন পাশে ছিলেন না৷
ছবি: DW
বই-পত্র পুড়িয়ে দিয়েছে
কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের বই-পত্র, এমনকি সার্টিফিকেটও পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা৷
ছবি: DW
সুন্দর স্বপ্নে চির
হামলাকারীদের ভেঙে দেয়া আয়নায় কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব৷ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো এই ভাঙা আয়নার মতোই মঙ্গলার সুন্দর স্বপ্নেও চির ধরিয়েছে হামলাকারীরা৷ মঙ্গলার আক্ষেপ, তাঁর বই-পত্র আর সার্টিফিকেট কী দোষ করলো?
ছবি: DW
আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয়
হামলার ছয় দিন পরে এঁরা ফিরছেন বাড়িতে৷ হামলার সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: DW
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী
৮৬ বছর বয়সি মৃত্যুঞ্জয় সরকার সেদিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও দেশ ছাড়েননি তিনি৷ কিন্তু হামলার পর তাঁর মনে হচ্ছিল যে, সে সময়ে ছেড়ে যাওয়াটাই উচিত ছিল তাঁর৷
ছবি: DW
গাছও রেহাই পায়নি
বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি মালোপাড়ার গাছও জ্বালিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: DW
পলাতক জামায়াত নেতা
মালোপাড়ায় হামলার পরে চাপাতলী গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বালিয়াডাঙ্গায় স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর থানা আমীর মাওলানা আব্দুল আজিজের বাড়ি ভাঙচুর করে যৌথবাহিনী৷ ঘটনার আগে থেকেই পলাতক রয়েছেন এ জামায়াত নেতা৷
ছবি: DW
আক্রান্তদের অভিযোগ
জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুল ওহাব৷ মালোপাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য জামায়াত শিবির ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলকেও দায়ী করেছেন অনেকে৷ সাবেক এই সাংসদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন৷ সেখানে নতুন প্রার্থী হিসেবে রণজিৎ রায় মনোনয়ন পাওয়ায় এই দুই জনের সমর্থকদের মাঝে বেশ উত্তেজনা ছিল পুরো নির্বাচনের সময়টায়৷
ছবি: DW
গণধর্ষণ
যশোরের আরেক ভয়াল জনপদ মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল গ্রামের দাসপাড়ার বাসিন্দা অনারতী দাস৷ ৭ জানুয়ারি রাতে তাঁর সামনেই অস্ত্রের মুখে একদল দুবৃত্ত গণধর্ষণ করে পুত্রবধু মনিমালা দাস আর ভাতিজি রূপালী দাসকে৷
ছবি: DW
ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী
কার্তিক দাসকেও সেদিন রাতে সেই ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিল৷ দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার নিম্নবর্ণের হিন্দু মনিমালা দাসের শ্বশুর ও রূপালী দাসের চাচা তিনি৷
ছবি: DW
বাড়িঘর ছেড়েছেন
দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার হওয়া পরিবার দুটি আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়েছেন৷
ছবি: DW
শুধুই আতঙ্ক
দাসপাড়ার এক নারী৷ দাসপাড়ার নারীদের এখন নির্ঘুম রাত কাটে আতঙ্কে৷
ছবি: DW
14 ছবি1 | 14
এর জবাবে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের বিচারে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে৷ এটা রাখ-ঢাক করে বলার কিছু নাই৷ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে শত শত অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে৷ এছাড়া অজ্ঞাতদের নামে পুলিশ গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালিয়েছে৷ মূল অপরাধীদের আটক বা বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারমন্ত্রী হয়ত না বুঝেই কথা বলেছেন৷ আর তিনি (তোফয়েল আহমেদ) আমার বক্তব্যকে কেন বিএনপি-জামায়াতপন্থি বলেছেন তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন৷''
ড. মিজান বলেন, ‘‘শুধু দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারেই ব্যর্থতা নয়, সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে৷ ১৮ই মার্চের জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো তথ্য তুলে ধরা হয়নি৷ উল্টে সেখানে সরকারবিরোধীরাই সরকারকে দায়ী করে তথ্য তুলে ধরেছে৷''
তাই তাঁর কথায়, ‘‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হলে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে৷ শুধু বিচারের কথা বলে বক্তৃতা দিলে চলবে না৷ অর্থাৎ বক্তৃতায় কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে নয়, কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে৷''