জার্মানির বন শহরে এসে প্রথমে যে জায়গাটিতে চোখ আটকায় সেটা হলো মুনস্টারপ্লাৎস৷ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কালো এক ব্রোঞ্জের মূর্তি৷ চিনতে কষ্ট হয়নি এই সুরস্রষ্টাকে৷ সন্ধ্যার মায়াবী আলোয় সেদিন ছবিও তুলেছিলাম কয়েকটি৷
বিজ্ঞাপন
বন শহরের এক ব্যস্ত গলি বনগাসে৷ আশপাশে জমকালো নানান দোকানপাটের ভিড়ে চাপা পড়া বাড়িটি চোখে পড়েনি৷ অথচ গত বিশ দিনে এই বাড়ির সামনে দিয়ে কতবারই না হেঁটে পার হয়েছি! বাইরে থেকে বোঝার উপায়ও নেই যে এর ভেতরেই আছে বিস্ময়কর এক সঙ্গীত স্রষ্টার জীবনের নানান স্মৃতি আর ইতিহাস৷ বেটোফেনের সংগীত জীবনের নানা সামগ্রী আর তাঁর ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে বাড়িটিকে রূপ দেয়া হয়েছে মিউজিয়ামে৷
বন শহরে নিবন্ধনের সময় নগর কর্তৃপক্ষ আমাকে এক বান্ডেল কুপন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ সেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই থিয়েটার আর মিউজিয়াম দর্শনের সৌজন্য কুপন৷ বেটোফেন হাউসে প্রবেশের একটি কুপনও ছিল সেখানে৷
এক সকালে বেরিয়ে পড়লাম বেটোফেন হাউস দেখতে৷ ভেড়ানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম৷ সংগীত স্রষ্টা লুডভিগ ফন বেটোফেনের জন্ম এই বাড়িতেই৷ বেশ পুরনো বাড়ি৷ বাড়ির উপরের তলায় ছোট্ট একটি কক্ষেই ১৭৭০ সালের ১৬ অথবা ১৭ ডিসেম্বর জন্মেছিলেন ইয়োহান এবং মারিয়া দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান লুডভিগ ফন বেটোফেন৷
এখানে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার আগে বাড়িটিতে বেটোফেনের এক বন্ধু একটি রেঁস্তোরা চালু করেছিলেন৷ পরে ১৮৮৯ সালে বেটোফেন হাউস সংরক্ষণ সংস্থা নিজদের উদ্যোগে বাড়িটি কিনে নেন৷ বাড়িটিকে রূপ দিতে শুরু করেন জাদুঘর হিসেবে৷ কাজ শেষে ১৮৯৩ সালের ১০ মে এক সংগীত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় বেটোফেন হাউসের৷
বেটোফেন হাউসের ১২ টি গ্যালারি যেন বিস্ময়ে ভরা৷ ১ নং গ্যালারি থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে চারতলা ভবনের কক্ষে কক্ষে ঘুরে ১২ নং গ্যালারিতে এসে শেষ হয় জাদুঘর দেখা৷ জাদুঘরের বেশিরভাগ জিনিসপত্রই বেটোফেনের সময়কালের৷ সবগুলো গ্যালারি ঘুরে দেখলাম বেটোফেনের হাতের লেখা স্মরলিপি, প্রাচীন বনের নানান রকম ছবি, বেটোফেনের ব্যবহার করা নানা রকম বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও তাঁর স্মৃতিধন্য নানান জিনিসপত্র৷ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা জাদুঘরের প্রতিটি বিষয়বস্তুর বর্ণনা লেখা আছে জার্মান ভাষায়৷ তবে জাদুঘরে প্রবেশের সময় ইংরেজিতে গাইড দেয়া হয়েছিল৷ তাতে প্রতিটি গ্যালারির বিস্তারিত বিবরণ ছিল৷
বেটোফেন সবশেষে যে পিয়ানোটি বাজিয়েছিলেন, সেটিও দেখলাম৷ কনরাড গ্রাফ নামে ভিয়েনার এক পিয়ানো নির্মাতা মৃত্যুর মাত্র দেড় বছর আগে পিয়ানোটি দিয়েছিলেন তাঁকে৷ জাদুঘর হিসেবে যাত্রার শুরুর দিন থেকেই বেটোফেন হাউসে রক্ষিত আছে বেটোফেনের স্মৃতিধন্য এই বাদ্যযন্ত্রটি৷
জাদুঘরের উপরের তলার যে কক্ষটিতে জন্মছিলেন বেটোফেন, সেটিতে এখন দর্শনার্থীদের প্রবেশ করতে দেয়া হয় না৷ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এর ভেতরটা দেখা যায়৷ কক্ষটির এক পাশে বেটোফেনের একটি আবক্ষ মূর্তি রেখে সেখানে আলোছায়ার খেলা দেখানো হয়েছে৷
সকালের দিকে গিয়েছিলাম বলে দর্শনার্থী ছিল না বললেই চলে৷ কিন্তু বের হওয়ার সময় দেখলাম ছোট্ট এই জাদুঘর দর্শনার্থীতে একরকম ঠাসা৷ বড় কয়েকটি পর্যটক দলকেও দেখলাম৷ তারমধ্যে চীনা পর্যটক দলের কাছে গাইড নিজস্ব ভাষায় গ্যালারির প্রত্যেকটি বিষয় বর্ণনা করছিলেন৷ গ্যালারির ভেতরে ছবি তুলতে মানা, টিপ টিপ বৃষ্টিতেও জাদুঘরের বাইরের আঙ্গিনায় তাই ছবি তুলতে কেউ কার্পণ্য করছিলেন না৷
বেটোফেন হাউসের নিচ তলায় দেখলাম সমৃদ্ধ একটি বিক্রয় কেন্দ্র৷ জাদুঘর দেখতে আসা দর্শনার্থীরা সেখান থেকে সংগ্রহ করতে পারেন বেটোফেনের বিভিন্ন রকম স্মারক৷ কী নেই সেখানে? পোস্টার, পোস্টকার্ড, টিশার্ট, কলম, তাঁর মিউজিকের সিডিসহ বলতে গেলে সবই আছে৷ দর্শনার্থীরা এসব কিনতে পারেন সেখান থেকে৷
বেটোফেন হাউস খুবই ছেট একটি জাদুঘর৷ একজন সংগীত শিল্পীর স্মৃতি কতটা যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়েছে তা এই জাদুঘর না দেখলে বোঝা কঠিন৷ অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের ভবনের ভেতর কিংবা বাইরের সবকিছু অবিকল রেখে কত সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে বেটোফেনের নানান স্মৃতি৷
বাংলাদেশে এ চিত্র পুরোটাই বিপরীত৷ দেশের প্রায় সবগুলো জাদুঘরই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, যার বেশিরভাগের অবস্থাই অত্যন্ত নাজুক৷ আর এ ধরনের সংগীতশিল্পীদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগেরও অভাব আছে৷ যেমন বাউল সম্রাট লালন সাঁই, মরমী শিল্পী আবদুল আলীম, আব্বাস উদ্দীন, শাহ আবদুল করিমের মতো সংগীত স্রষ্টাদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখবার এরকম মহৎ উদ্যোগ বাংলাদেশে নেই৷
ইউরোপের দশটি চোখ ধাঁধানো কনসার্ট হল
ইউরোপ কেন, দুনিয়া জুড়ে বড় বড় শহরের কনসার্ট হল শুধু গানবাজনা শোনার জায়গাই নয়, আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শনও বটে৷ তারা নিজেরাই পর্যটকদের টানে৷
ছবি: picture alliance/Arcaid/S. Ellingsen
কিলডেন পার্ফর্মিং আর্টস সেন্টার, নরওয়ে
কিলডেন পার্ফর্মিং আর্টস সেন্টার, নরওয়ে
কনসার্ট হলটি জলের ধারে৷ সামনেটা ১০০ মিটার লম্বা একটা কাচের দেয়াল, তার ওপর ঝুলছে ওক কাঠের সোনালি রঙের এক পর্দা, যেন থিয়েটারের যবনিকা৷ তৈরির কাজ শেষ হয় ২০১২ সালে৷ মোট এলাকা ১৬৫,০০০ বর্গমিটার৷ এখানে নাটক, অপেরা বা সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা সব কিছুই অনুষ্ঠিত হয়৷
ছবি: picture alliance/Arcaid/S. Ellingsen
ফিলহার্মনি দ্য পারি, ফ্রান্স
এমন একটি কনসার্ট হলের আইডিয়া প্রথম এসেছিল নামকরা অর্কেস্ট্রা পরিচালক পিয়ের বুলে ও পুরস্কার বিজয়ী স্থপতি জঁ নুভেলের মাথায়৷ উদ্বোধন করা হয় ২০১৫ সালে৷ অ্যালুমিনিয়ামের সম্মুখভাগটি তিন লাখ চল্লিশ হাজার পাখি দিয়ে সাজানো, তাদের সাত ধরনের আকৃতি ও ধূসর থেকে কালো, এই চার ধরনের রঙ৷ দূর থেকে দেখলে মাছের আঁশের মতো ঝকঝক করে৷ ৩৭ মিটার উঁচু বাড়িটির ছাদে ওঠা যায় ও সেখান থেকে প্যারিসের দৃশ্য উপভোগ করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/T. Muncke
সেজ গেটসহেড, ইংল্যান্ড
গেটসহেড আর নিউক্যাসলের মধ্যে টাইন নদীর ওপর সাতটা সেতু৷ তার মধ্যে মিলেনিয়াম ব্রিজটি সেজ গেটসহেড কনসার্ট হলের ওপর দিয়ে চলে গেছে৷ গোটা বাড়িটাতেই আলো জ্বলে৷ ডিজাইন প্রখ্যাত স্থপতি স্যার নর্মান ফস্টারের৷ উদ্বোধন করা হয় ২০০৪ সালে৷ কনসার্ট হলটি প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা করে বছরে ৩৬৪ দিন খোলা থাকে৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/M. Sunderland
কাসা দা মুজিকা পোর্তো, পর্তুগাল
তেরশ’ দর্শকের বসার মতো এই কনসার্ট হলটিকে দেখতে যেন একটি সুবিশাল বাক্স৷ বাইরেটা সাদা কংক্রিট আর কাচের৷ ভেতরটায় নানা রঙ ও আকৃতির বিভিন্ন ফিচার, সেই সঙ্গে পর্তুগালের ‘আজুলেজস’ পাথরের টালি৷ কাচের ছাদটা খুলে দেওয়া যায়; তখন এখানে থেকে পোর্তো শহরের সব বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে অতলান্তিক সমুদ্র অবধি দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Karmann
পালাউ দে লেজার্ত রেইনা সোফিয়া, স্পেন
ভ্যালেন্সিয়া শহরে কুইন সোফিয়া প্যালেস অফ দ্য আর্টসের উদ্বোধন করা হয় ২০০৫ সালে৷ বিশ্বখ্যাত স্থপতি সান্তিয়াগো কালাত্রাভা যে সুবিশাল সিটি অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেসের পরিকল্পনা করেছিলেন, এই কনসার্ট হলটি ছিল তার চূড়ান্ত অংশ৷ ৭৫ মিটার উঁচু ভবনটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু অপেরা হাউস বলে পরিচিত৷
ছবি: picture-alliance/Arco Images GmbH/J. Moreno
নর্স্কে অপেরা ও ব্যালে, নরওয়ে
অসলোর নরওয়েজিয়ান অপেরা ও ব্যালেট ভবনটির ছাদ ৩৬,০০০ কারারা শ্বেতপাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি৷ এই ছাদের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়৷ হলটির চারপাশে পাতলা কাচের দেয়াল৷ হলের ভেতরটা তেলে ‘সিজনড’ ওক কাঠ দিয়ে তৈরি, যার ফলে খুব ভালো শুনতে পাওয়া যায়৷ ইন্টারভ্যালের সময় ব্যালকনি থেকে বাইরে নরওয়ের ফিয়র্ডগুলির দৃশ্য দেখতে পারা যায়৷
কনসার্ট হলটির ধাঁচ কিছুটা আলাদা বলে গোড়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল৷ অর্কেস্ট্রার বাজনদাররা হলের মাঝখানে একটা পোডিয়ামের ওপর বসেন৷ স্থপতি হান্স শারুনের এই বিপ্লবী ডিজাইন পরে সারা বিশ্বে আধুনিক কনসার্ট হল তৈরির মডেল হয়ে ওঠে৷
ছবি: picture alliance/Arco Images/Schoening Berlin
আল্টো থিয়েটার, এসেন, জার্মানি
জার্মানির এসেন শহরের এই কনসার্ট হলটির বিশেষত্ব হলো, স্টেজের সামনে বসা দর্শকদের আসনগুলি অর্ধগোলাকৃতি করে অপ্রতিসমভাবে সাজানো৷ ফিনল্যান্ডের স্থপতি আলভার আল্টো জানিয়েছেন, তিনি ডেলফির প্রাচীন গ্রিক থিয়েটারগুলো থেকে এ ধরনের অডিটোরিয়াম সৃষ্টির প্রেরণা পেয়েছেন৷ আলভার থিয়েটারের নকশাটি করেন পঞ্চাশের দশকে, কিন্তু কাজ শুরু হয় ১৯৮৩ সালে৷ আজ এই ভবনটিকে আধুনিক ক্লাসিক্যাল ডিজাইনের একটি নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়৷
ছবি: Bernadette Grimmenstein
হার্পা মিউজিক হল, রাইকজাভিক, আইসল্যান্ড
আংশিক রঙ করা কাচের বিল্ডিং ব্লকগুলোকে মৌমাছির চাকের মতো বসিয়ে আলোর জাদু সৃষ্টি করেছেন শিল্পী ওলাফুর এলিয়াসন৷ দিনের বেলায় বাইরে থেকে কাচের ওপর আলো পড়ে বর্ণালীর সৃষ্টি হয়; রাত্রে ভবনটির ভিতরের আলো জ্বললে গোটা বাড়িটা রঙ বদলায় যেন বহুরূপীর মতো৷
হামবুর্গের এই কনসার্ট হলটি তৈরি হতে যে পরিমাণ বিলম্ব হয়েছে আর বাজেট যে পরিমাণে বেড়েছে, তাতে কেউ প্রত্যাশাই করেননি যে, তার চূড়ান্ত আকার এত সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর হবে৷ ফিলহার্মনিকের ছাদটা ঢেউ খেলানো, যেন একসঙ্গে সাগর আর সংগীতের ওঠা-নামা৷ হামবুর্গের বন্দর এলাকার একটি মালগুদামের উপর কাচের এই বাড়িটি যেন জলের ওপর ভাসছে৷ প্রথম কনসার্টের তারিখ হলো ১১ই জানুয়ারি, ২০১৭৷