শান্তিনিকেতনে অশান্তির বিরাম নেই। দিনের পর দিন ঘেরাও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি বেরোতে গেলে বাধছে ধুন্ধুমার। মধ্যরাতে পড়ুয়াদের ধরনা মঞ্চ ভাঙা নিয়ে চলছে বিতর্ক।
বিজ্ঞাপন
গোড়া থেকেই উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সংঘাত লেগে আছে। নানা কারণে মতানৈক্য এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। উপাচার্যের বাড়ির সামনে প্রায় চার সপ্তাহ ধরে ধরনা মঞ্চ গড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন আন্দোলনকারী ছাত্ররা। তাতে কার্যত গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন উপাচার্য।
দিনের পর দিন নিজের কার্যালয়ে যেতে পারেননি বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। জরুরি বৈঠকে তিনি যোগ দিতে পারছেন না। টানা ২১ দিন আটকে থাকার পর এই সপ্তাহে তিনি বেরোনোর চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীরা রুখে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বেধে যায় ধুন্ধুমার।
নিরাপত্তারক্ষীদের ঘেরাটোপে বাইরে আসেন উপাচার্য। তার আগে রক্ষীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধস্তাধস্তি হয়। এই সময় পড়ুয়াদের মারধর করার অভিযোগ উঠেছে। পাল্টা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ তুলেছেন কর্তৃপক্ষ।
মঙ্গলবারের এই ঘটনায় উত্তাপ বেড়েছে শান্তিনিকেতনে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পঠনপাঠন নিয়ে উদ্বিগ্ন পড়ুয়া, অভিভাবকরা। আন্তর্জাতিক স্তরে সুনাম আছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানের। সেই সুনাম আজ চ্যালেঞ্জের মুখে বলে মনে করছেন অনেকে।
শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন
দুই বাংলার সাংস্কৃতিক যোগসূত্রকে আরো শক্তিশালী করতে শান্তিনিকেতনে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ভবন৷ এর জন্য ২৫ কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ৷ এখানে ৪৫০ আসনের প্রেক্ষাগৃহসহ একটি সংগ্রহশালা ও পাঠাগারও রয়েছে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
শুভ উদ্বোধন
রবীন্দ্রনাথের সার্ধ-শতবর্ষের সময়ই শান্তিনিকেতনে এই ভবন গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন শেখ হাসিনা৷ তখন থেকেই তিনি প্রতীক্ষায় ছিলেন৷ শুক্রবার সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো৷ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে উদ্বোধন হলো বাংলাদেশ ভবনের৷ আশা, ভারত-বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নতুন অধ্যায় খুলে যাবে এবার৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
আনন্দযজ্ঞ
বাংলাদেশ ভবনে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ের গ্রন্থের সংগ্রহ নিয়ে একটি পাঠাগার তৈরি করা হয়েছে৷ সাধারণের ব্যবহারের করার কথা ভেবেই বাড়িটিতে একটি ক্যাফেটোরিয়াও রাখা হয়েছে৷ গত এপ্রিলের মাঝামাঝি বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর শান্তিনিকেতনে এসে বাড়িটির চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ তদারকি করে গিয়েছিলেন৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে চাঁদের হাট
বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনের দিন শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা৷ ছিলেন বহু রবীন্দ্র অনুরাগীও৷ এদিনই ছিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবর্তন৷
ছবি: DW/P. Samanta
কবি ও মুজিবুর
বাংলাদেশ ভবন যে শান্তিনিকেতনের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই৷ বাংলাদেশ ভবনের প্রবেশদ্বারের দুই প্রান্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুরাল’ স্থাপন করা হয়েছে৷ ভেতরেও দেখা মিলবে তাঁদের৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
স্মারক
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসভিত্তিক সংগ্রহশালায় দেখা মিলবে জানা-অজানা কিংবা চেনা অচেনা বস্তুর৷ কিন্তু রবীন্দ্র অনুরাগী মাত্রেই জানেন পদ্মার বোটের প্রতিরূপটির কথা৷ কবিগুরুর জীবনের একটা বিশেষ সময় কেটেছে বাংলাদেশে৷ সেই সব স্মৃতিকে নিয়ে গড়া হয়েছে বাংলাদেশ ভবনের গ্যালারি৷ এখানেই ঠাঁই দেওয়া হয়েছে কবিগুরুর বাংলাদেশে কাটানোর নানা স্মৃতিবাহী স্মারক, ছবি৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
পায়ে পায়ে শান্তিনিকেতন
বিশ্বভারতীতে আজকাল পর্যটকদের জন্য প্রায়ই যানজট হয়৷ ব্যক্তিগত গাড়ি বা টোটোর উৎপাতে অনেকেই অতিষ্ঠ হয়ে যান৷ তবে এমন আনন্দঘন মুহূর্তকে ধরে রাখতে কেউ কেউ পায়ে পায়েই বেরিয়ে পড়েছেন৷ পুলিশি নিরাপত্তায় শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন ভবনগুলি আর বিখ্যাত মনীষীদের বাড়িগুলিও দেখে নিয়েছেন তাঁরা৷ ছবিতে অমর্ত্য সেনের বাড়ি ‘প্রতীচী’৷
ছবি: DW/P. Samanta
আলোকিত মঞ্চ
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রথমবার শান্তিনিকেতনে এলেন বিশ্বভারতীর আচার্য তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ সঙ্গে ছিলেন দুই বাংলার দুই নেত্রী৷ কাজেই তিস্তার জলবণ্টন সমস্যা বা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা নিয়ে কোনো কথাই হয়নি, এটা ভাবা যায় না! বাংলাদেশে এ বছরই সাধারণ নির্বাচন৷ তাই শেখ হাসিনার এই পশ্চিমবঙ্গ সফর বাড়তি তাৎপর্য পাচ্ছে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
7 ছবি1 | 7
সকালে বাসভবনের সামনে উপাচার্যকে ঘিরে অশান্তির পর মঙ্গলবার রাতে পরিস্থিতি আরো ঘোরালো হয়। নিরাপত্তারক্ষীরা ধরনা মঞ্চ ভেঙে দেয়। অভিযোগ, সেই সময় তারা মদ্যপ অবস্থায় ছিল। এমনকী ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযোগ খারিজ করে বলেছে, পড়ুয়ারা বাসভবন লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়েছিলেন। তাই মঞ্চ ভাঙা হয়েছে। ধর্ষণের হুমকির অভিযোগ ভিত্তিহীন।
দ্রুত ফলপ্রকাশ, ছাত্রাবাসের শূন্য আসন পূরণ-সহ সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দাবি তুলেছেন পড়ুয়ারা। আন্দোলনের নেত্রী মীনাক্ষী ভট্টাচার্য বলেন, "আন্দোলনকারীদের হেনস্থা করা হচ্ছে। সিবিআই তদন্তের ভয় দেখানো হচ্ছে। উপাচার্য যদি আশ্রমের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারেন তা হলে তার পদে না থাকাই শ্রেয়।"
গত কয়েক মাসের পরিস্থিতি বিশ্বভারতীর প্রাক্তনীদেরও হতাশ করেছে। ১৯৮৭ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মেরি খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ক্যাম্পাসের এই ছবিটা আমরা ভাবতেও পারতাম না। এখন এসব দেখলে কান্না পেয়ে যায়।"
বিশ্বভারতীর অধ্যাপকদের একাংশকে পাশে পেয়েছেন আন্দোলনকারীরা। অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য ধরনা মঞ্চে এসেছেন। সেজন্য তাকে শোকজ করেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি উঠেছে বারবার। এই দাবি খারিজ করে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর বক্তব্য, "৩০০ জন আবেদনকারীর মধ্যে আমি উপাচার্য পদে মনোনীত হয়েছি। রাষ্ট্রপতি আমার নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। যারা পদত্যাগ করতে বলেছেন, তারা নিয়োগ করেননি।"
চলতি অচলাবস্থাকে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন প্রাক্তন উপাচার্য রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ছাত্রদের দাবি যদি আইনি পথে পূরণ করা সম্ভব না হয়, সেটা বোঝাতে হবে। কর্তৃপক্ষ পড়ুয়াদের বোঝাতে পারছেন না। উপাচার্যকে নমনীয় হতে হবে, তিনি হুমকি দিলে সমস্যা মিটবে না।"