‘কোনো কূটনৈতিক বিনয় নয়’
ভারতের ইংরেজি দৈনিক ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ এই ঘটনাকে ‘চীনের আগ্রাসন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে৷ করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে চীনের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে তদন্তের যে আন্তর্জাতিক দাবি উঠেছে, তাতে সায় আছে ভারতের৷ আর এ কারণেই চীন মূলত ভারতকে সতর্কবার্তা দিয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমটি তাদের এক কলামে উল্লেখ করেছে৷
‘‘বেইজিং যদি ভারতকে চীনের কূটনৈতিক অবস্থানের বিষয়ে চুপ করাতে পারে তাহলে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও এই কঠিন বার্তাটি দেয়া হবে যে এশিয়ার সিদ্ধান্ত আসলে কে নিবে৷ আর সে কারণেই চীন যা পছন্দ করে না, ভারতের সেটাই করা উচিত হবে এবং পালটা কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে,’’ এমনটাই লেখা হয়েছে টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে৷
এই প্রেক্ষাপটে হংকংয়ের অর্থনীতি, তিব্বত ও শিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা এবং তাইপের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে জোর দিতে নতুন দিল্লিকে পরামর্শ দিয়েছেন ঐ কলামের লেখক৷ চীনের পণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে বাণিজ্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারেরও পরামর্শ দেন তিনি৷
‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ এর একটি কলামে বলা হয়েছে, অল্প কিছুদিন আগেই দুই দেশের সামরিক কর্মকর্তারা একটি সমঝোতা করেছিলেন৷ চীনের হাতে ভারতীয় ২০ সেনার মৃত্যু সেটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে৷ লেখক মনে করছেন, ‘‘বিভিন্ন বৈঠকের মধ্য দিয়ে শি জিনপিং ও নরেন্দ্র মোদী যে চুক্তি করেছেন চীনের হঠকারিতায় তার বরখেলাপ ঘটেছে৷ সব ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক চ্যানেল চালু করে নতুন দিল্লিকে এই বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত৷’’
বার বার সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীনের সেনা। কেন? ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ছবি: Rouf Bhat/Afp/Getty Imagesভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।
ছবি: DW/H. Joshiলাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo১৩৪ কিলোমিটার লম্বা প্যাংগং লেক ১৪ হাজার ফুটে অবস্থিত। নোনতা জলের এই হ্রদকে ঘিরে প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জমি। প্যাংগংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। প্রকৃত সীমান্তরেখা এই লেকের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ভারতের দাবি, চীন সেই সীমান্তরেখা অগ্রাহ্য করে ভারতের জমি দখল করছে এবং সীমান্তের খুব কাছে রাস্তা বানাচ্ছে। চীনের দাবি, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না।
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Karelগালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayanaদারবুক, শাইয়োক হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের উচ্চতম এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে ভারত। এই এয়ার স্ট্রিপ এবং সিয়াচেন পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে চীনের আপত্তি আছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Khawer১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে উত্তর পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়েছিল ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এই লাইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে চীনকে নেওয়া হয়নি। সেই তখন থেকেই অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অরুণাচল অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে এই সমস্যার সমাধানে দুই দেশ আলোচনা করেছে। তবে চীন এখনও মনে করে অরুণাচল তাদের।
ছবি: Prabhakar Maniসীমান্ত সমস্যার জেরে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সরাসরি দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা-য় দুই দেশের সৈন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলের তুলু লা-তে ফের সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। যদিও কোনওটাই দীর্ঘ সংঘর্ষ বা যুদ্ধের স্তরে পৌঁছয়নি। তবে জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা নজিরবিহীন।
ছবি: DW চীনের দিক থেকে বন্ধুত্বের ইঙ্গিত!
চীনের সংবাদমাধ্যম জিয়েফাং জুনবাও (পিপলস লিবারেশন আর্মির সংবাদপত্র) সীমান্তে সোমবারের সংঘর্ষকে দেখছে এভাবে: ‘‘১৫ জুন সন্ধ্যায় ভারতীয় বাহিনী চীন-ভারত সীমান্তের গালওয়ান নদী উপত্যকায় সীমান্তরেখা বরাবর পুনরায় বেআইনি কর্মকাণ্ড চালিয়েছে৷ তারা পরিকল্পিতভাবে হামলার উসকানি দিয়েছে৷ যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট সংঘাতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে৷’’
নিবন্ধটিতে ভারতকে তার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ, সব ধরনের সীমান্ত সংঘাত নিরসন এবং বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আলোচনায় ফেরার আহবান জানানো হয়৷
ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে ২০ সেনাসদস্য নিহত হওয়ার খবর বের হলেও চীন এখনও উভয় দেশের কারো হতাহতের বিষয়েই মুখ খোলেনি৷ এর কারণ হিসেবে গ্লোবাল টাইমসের চীনা সংস্করণে সংবাদপত্রটির প্রধান সম্পাদক লিখেছেন, ‘‘দুই দেশের জনগণ মৃত্যুর পরিসংখ্যানের তুলনা করুক, চীন এমনটা চায় না৷ এতে খারাপ হওয়া পরিস্থিতি আরো নাজুক হতে পারে৷ চীনের দিক থেকে এটি বন্ধুত্বের ইঙ্গিত৷’’
তিনি ‘দেশের বাইরে থেকে ছড়ানো মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কোনো গুজবে’ কান না দিতে পাঠকদের প্রতি আহবান জানান৷ প্রধান সম্পাদক লিখেছেন, ‘‘উত্তেজনা নিরসনে আমাদের সরকার ও পিপলস লিবারেশন আর্মি যে কৌশল নিয়েছে আমরা তার উপর আস্থা রাখি৷’’
এদিকে বুধবার তিব্বতের মালভূমিতে সামরিক বাহিনীর মহড়া চালানোর ছবি প্রকাশ করেছে চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন৷ পিপলস লিবারেশন আর্মির ব্রিগেডটি সামরিক সরঞ্জামসহ তিন স্তরের নিরাপত্তা অনুশীলন চালিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে খবরে৷
হান্স স্প্রস, হাও গুই/এফএস
ভারত ও চীনের মধ্যে একবারই যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬২ সালে। কিন্তু তার আগে ও পরে অনেকবারই সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে এই দুই দেশ। সেই সংঘাতের কাহিনি দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত।
ছবি: Getty Images/Three Lions/Radloffচীন তিব্বতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো ১৯৫১ সালে। তার আট বছর পরে চতুর্দশ দলই লামা পালিয়ে ভারতে আসেন। ভারত তাঁকে আশ্রয় দেয়। চীন তার বিরোধিতা করে। তারপর শুরু হয় সীমান্তে দুই সেনার সংঘর্ষ।
ছবি: APসীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে প্রচুর। কিন্তু যুদ্ধ একবারই। ১৯৬২ সালে এক মাস এক দিনের লড়াইয়ে ভারতীয় ভূখন্ডে ঢুকে পড়ে চীন। অরুণাচল প্রদেশে ও লাদাখের ভিতরে। ভারত ছিলো অপ্রস্তুত। চীন সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলো।
ছবি: Getty Imagesভারত ও চীনের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে। সহজভাবে বললে, যুদ্ধের পর দুই দেশের সেনা যেখানে অবস্থান করছে, সেটাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা।
ছবি: Getty Imagesপাঁচ বছরের মধ্যে অবস্থা বদলে গেলো। ১৯৬৭-র ১১ সেপ্টেম্বর চীনা সেনা নাথু লা-য় ভারতীয় পোস্ট আক্রমণ করে। পাঁচ দিন ধরে সংঘর্ষ চলে। এ বার ভারত ছিলো সুবিধাজনক অবস্থায়। তারা চীনা সেনাকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। সংঘর্ষ হয় চো লা-তেও।
ছবি: Diptendu Dutta/AFP/Getty Imagesআবার উত্তেজনা ২০ বছর পরে, সামডরং উপত্যকায়। ভারত তখন অপারেশন চেকারবোর্ড চালাচ্ছিলো। কত তাড়াতাড়ি আসাম থেকে সীমান্তে সেনা পৌঁছনো যায় তা নিয়ে। সেখান থেকেই উত্তেজনা। দুই দেশের সেনা সামনাসামনি। তবে সংঘর্ষ হয়নি।
ছবি: picture-alliance/AP Photoএ বার বিরোধ ২০১৭-তে, ডোকলামে। ভারত, ভূটান ও চীনের সীমান্তে। চীনের সেনা একটা রাস্তা বানাতে থাকে। ভারতীয় সেনাও বুলডোজার নিয়ে চলে যায় তা থামাবার জন্য। সেই সংঘাত ৭৩ দিন চলে। অবশেষে কূটনৈতিক আলোচনার পর বিরোধ মেটে।
ছবি: APএ বার ২০২০-তে। আবার লাদাখ। প্রথমে দুই সেনার হাতাহাতি লড়াই। সিকিমেও একই ঘটনা ঘটলো। চীনের প্রেসিডেন্ট বললেন, তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তারপর ভারত ও চীন দুই পক্ষই সীমান্তে প্রচুর সেনা মোতায়েন করেছে। দুই দেশই প্রচুর কামান ও গোলাবারুদ নিয়ে গিয়েছে।
ছবি: Eesha Khenyচীন দাবি করে অরুণাচল প্রদেশ তাঁদের এলাকা। বিশেষ করে তাওয়াং শহর। অরুণাচলের লোকের চীনে যেতে ভিসা লাগবে না। ভারত জানায়, অরুণাচল তাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ছবি: picture-alliance/dpa/dinodiaভারতের দাবি, আকসাই চীন তাদের এলাকা। চীন জবরদখল করে রেখেছে। ১৯৬২ থেকেই এ নিয়ে বিরোধ চলছে। এখানে কোনও মানুষের বসতি নেই। কিন্তু সামরিক দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
ভারত ও চীনের সম্পর্ককে বলা হয় ব্লো হট, ব্লো কোল্ড রিলেশন বা নরমে-গরমের সম্পর্ক। মাঝে মাঝেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর উত্তেজনা হয়। আবার শান্তি আসে। দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর। দুই দেশের সেনা শক্তিশালী। তাই তা আর যুদ্ধের দিকে যায় না।
ছবি: Reuters/Handout