সাংবাদিক বলতে বাধ্য হচ্ছেন, যে কর্পোরটের চ্যানেলে বসেছেন, তার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না৷ এটাই এখন পশ্চিমবঙ্গের সংবাদচিত্র৷
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন শুরু হতে তখনো কয়েক সপ্তাহ বাকি৷ প্রতিদিন রাতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে জমজমাট ভোট-বিতর্কের আসর চলছে৷ এক প্রাক্তন সহকর্মী তেমনই একটি চ্যানেলের নামকরা অ্যাংকর৷ বিতর্কে এক বাম বক্তা বিজেপির সঙ্গে আম্বানি-আদানির সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে শুরু করতেই থামিয়ে দিলেন অ্যাংকর৷ সরাসরি জানিয়ে দিলেন, রিলায়েন্সের চ্যানেলে বসে ওই সংস্থার মালিকের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যাবে না
ক্লিপটি ভাইরাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ নেটিজেনরা গালাগালির বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন৷ সত্যি বলতে কী, প্রাক্তন সহকর্মীর ওই ধরনের মন্তব্য শুনে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমারও যে খুব ভালো লেগেছিল, এমন নয়৷ কিন্তু এ ছাড়া আর কি কোনো উপায় ছিল তার? আমি তার জায়গায় থাকলে কী করতাম?
ভেবেছি৷ ভাবতে বাধ্য হয়েছি৷ কারণ, আমাদের প্রত্যেককেই কখনো না কখনো এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়৷ পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ চ্যানেল এখন কোনো না কোনো কর্পোরেটের মালিকানাধীন৷ কর্পোরেটের সঙ্গে সরকারের এক আশ্চর্য সম্পর্ক আছে৷ নরেন্দ্র মোদীর সরকারের সঙ্গে রিলায়েন্স বা আদানির সংস্থার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গোপন নয়৷ সেই সংস্থার টাকায় তৈরি চ্যানেলে বসে যদি সেই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা হয়, তাহলে অ্যাংকরের পক্ষে থামিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী বা করার আছে! প্রাক্তন সহকর্মী যে ভাবে থামিয়ে ছিলেন, আমি হলে হয়তো তা করতাম না৷ প্রশ্ন ঘুরিয়ে দিয়ে বক্তাকে থামিয়ে দিতাম৷ কিন্তু থামাতাম৷ চাকরির স্বার্থেই থামাতাম৷
থামাতে হয়৷ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা এক সাংবাদিকতার শিক্ষানবিশকে তার প্রথম বস বলে দিয়েছিলেন মূলস্রোতের সাংবাদিকতার অর্থ৷ পলিসি মেনে কাজ করতে হবে৷ মালিক যা চাইছেন, সে ভাবেই সাজিয়ে ফেলতে হবে যুক্তি৷ একেই বলে পেশাদারত্ব৷
প্রায় ১৫ বছরের পেশাদার জীবনে পলিসির মারপ্যাঁচ কম দেখিনি৷ যে সংস্থা তিন বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে সমর্থন করেছিল, তিন বছর পর তারাই কীভাবে বিরোধী দলকে সমর্থনের পক্ষে চলে যেতে পারে, দেড় দশকে তার গাদা গাদা উদাহরণ দেখেছি৷ দেখেছি, সাংবাদিকতা জীবনের একেবারে গোড়া থেকেই৷
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন তখন পুরো দমে চলছে৷ ছাত্র জীবনের শেষ পর্বে আমরাও অংশ নিয়েছিলাম সেই আন্দোলনে৷ তার পর পরই প্রথম চাকরিতে যোগ দেওয়া৷ সেখানে শুনলাম, কোনো ভাবেই ওই আন্দোলনকে গুরুত্ব দেওয়া যাবে না৷ এমনই নির্দেশ৷ বুঝতে পারছি আন্দোলন বড় হচ্ছে৷ কিন্তু খবর করতে পারছি না৷ এর শেষ হয়েছিল নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর ঘটনায়৷ পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যুর পরে চ্যানেল মত বদলাতে বাধ্য হলো৷
এক দশক আগে চ্যানেল মত বদলাতো৷ ইদানীং বদলায় না৷ এক দশক আগে ব্যক্তিগত মালিকানায় অনেক বেশি গণমাধ্যম চলতো পশ্চিমবঙ্গে৷ শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমের ব্যবসাই যারা করতেন৷ এক দশক পরে কর্পোরেট ঢুকতে শুরু করেছে সেখানে৷ যে কর্পোরেটের মূল ব্যবসা তেলের অথবা বিদ্যুতের অথবা খনির৷ কিন্তু তারা একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমেও বিনিয়োগ করছে৷ খনির ব্যবসায়ীকে ব্যবসার স্বার্থেই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতে হয়৷ সরকারকে সুবিধা দিতে হয়, পাল্টা নিতেও হয়৷ আর সেই সম্পর্কের জের স্পষ্টভাবে এসে পড়ছে সংবাদমাধ্যমের উপর৷ প্রাক্তন সহকর্মীদের তাই সরাসরি বলে দিতে হয়, আম্বানির নামে কিছু বলা যাবে না৷ যদি তিনি তা না বলতেন, তা হলে চাকরিও চলে যেতে পারতো৷ কিছুদিন আগে বেশ কিছু সহকর্মী চাকরি হারিয়েছিলেন সিএএ বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে খবর করার জন্য৷
গোটা ভারতে সংবাদমাধ্যমে কর্পোরেট পুঁজি যেভাবে ঢুকেছে, পশ্চিমবঙ্গে তা এখনো ততটা প্রকট নয়৷ এখনো পুরনো সংস্থাগুলি পুরোপুরি গুরুত্ব হারায়নি৷ তবে কর্পোরেটের বাড়বাড়ন্ত যে বাড়ছে, তা অনস্বীকার্য৷
রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের প্রভাব বলয়ে বাংলাদেশের মিডিয়া
বাংলাদেশের মিডিয়া হাউজগুলোর বেশিরভাগ পৃষ্ঠপোষক বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান৷ এই প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ হয়েছে ‘হু ওনস দ্য মিডিয়া ইন বাংলাদেশ’ গবেষণা থেকে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বসুন্ধরা গ্রুপ
বসুন্ধরার ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের তিনটি সংবাদপত্র কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং ডেইলি সান৷ আছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম এবং টিভি চ্যানেল নিউজ ২৪৷ এছাড়া এফএম রেডিও স্টেশন রেডিও ক্যাপিটালও তাদের৷ এই মিডিয়া কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেক্সিমকো গ্রুপ
এই গ্রুপের টেলিভিশন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি৷ মালিক বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
স্কয়ার গ্রুপ
এই গ্রুপের টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা টেলিভিশন৷ এর কর্ণধার স্কয়ার গ্রুপের অধীনে থাকা স্কয়ার টয়লেট্রিজের ব্যবস্থা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইমপ্রেস গ্রুপ
টেলিভিশন চ্যানেল, চ্যানেল-আই এর মালিকানা ইমপ্রেস গ্রুপের৷ এর কর্ণধার ফরিদুর রেজা সাগর৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশান কোম্পানি
টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলা এবং এটিএন নিউজ এই কোম্পানির৷ এর কর্ণধার মাহফুজুর রহমান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইত্তেফাক গ্রুপ অফ পাবলিকেশনস লিমিটেড
সুপরিচিত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক এই কোম্পানির৷ এর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী৷ বর্তমানে ইত্তেফাকের সম্পাদক জাতীয় পার্টি নেতা, সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্ত্রী তাসমিমা হোসেন এবং প্রকাশক মঞ্জু-তাসমিমা দম্পতির কন্যা তারিন হোসেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
এইচআরসি গ্রুপ
বাংলা পত্রিকা যায় যায় দিন এবং ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউএজ এই গ্রুপের৷ এর মালিক আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর ভাই সাঈদ হোসেন চৌধুরী৷ সাবের হোসেন চৌধুরী কর্ণফুলি গ্রুপের মালিক৷ সেই সুবাদে দেশ টিভির কর্ণধার তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সিটি পাবলিশিং হাউজ লিমিটেড
এই কোম্পানির পত্রিকা দৈনিক দিনকাল৷ এর মালিক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হামিম গ্রুপ
চ্যানেল-২৪ টেলিভিশন এবং সমকাল পত্রিকার মালিক৷ এর কর্ণধার আওয়ামী লীগ নেতা একে আজাদ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ট্রান্সকম গ্রুপ
বাংলাদেশের জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের মালিক এই গ্রুপ৷ প্রয়াত শিল্পপতি লতিফুর রহমান এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা৷ প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের অনলাইন সংস্করণও রয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বেঙ্গল গ্রুপ
টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভির মালিক বেঙ্গল গ্রুপ৷ এর কর্ণধার মোর্শেদ আলম এমপি৷
ছবি: Rtv
এনটিভি
বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালু এর মালিক৷ তিনি একজন ব্যবসায়ী৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার
জনকণ্ঠ পত্রিকার মালিক এই শিল্প পরিবার৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
রূপায়ন গ্রুপ
দৈনিক পত্রিকা দেশ রূপান্তর এই গ্রুপের৷ রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুল৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সিটি গ্রুপ
সময় টেলিভিশনের মালিক এই গ্রুপ৷ সবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের ভাই এর কর্ণধার৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মেঘনা গ্রুপ
একাত্তর টেলিভিশন এই গ্রুপের৷ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রধান মোস্তাফা কামাল এই গ্রুপের কর্ণধার৷ তবে সাংবাদিক মোজাম্মেল হক বাবু’র শেয়ার রয়েছে এতে৷
ছবি: Sanjay Kumar
শ্যামল বাংলা মিডিয়া
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশন এই মিডিয়া কোম্পানির৷ এর কর্ণধার আবদুল হক৷ তবে নেপথ্যে মালিকানায় বিএনপির প্রয়াত সাংসদ সাদেক হোসেন খোকার নাম শোনা গেলেও নথিপত্রে তার নাম নেই বলে প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে জানা গেছে৷
ছবি: Ahasanul Haque
যমুনা গ্রুপ
দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা এবং যমুনা টেলিভিশন এই গ্রুপের৷ প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলের মৃত্যুর পর থেকে তার স্ত্রী সালমা ইসলাম এই গ্রুপের চেয়ারম্যান৷ সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য তিনি৷ (‘হু ওনস দ্য মিডিয়া ইন বাংলাদেশ’ গবেষণা প্রতিবেদনটির লেখক যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ এবং গবেষক মো. সাজ্জাদুর রহমান৷ প্রকাশক সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ,ঢাকা)