সংবিধানে তিন মূলনীতি বাদ, রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব
১৫ জানুয়ারি ২০২৫
কমিশনগুলো হলো সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন৷ বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এখনও প্রতিবেদন দেয়নি৷
তবে বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘‘আগামী ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ছয়টি কমিশনেরই পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে৷ এরপর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ এসব প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে৷''
রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের অংশ হিসেবে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার৷ বাকি পাঁচটি কমিশনের মেয়াদ আরো এক মাস বড়িয়ে দেয়া হচ্ছে৷
চার কমিশনের প্রতিবেদনের চুম্বক অংশ
সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানে পাঁচটি নতুন মূলনীতির প্রস্তাব করেছে৷ এগুলো হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র৷
১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার চার মূলনীতির মধ্যে তিনটি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন৷ শুধুমাত্র গণতন্ত্র বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ' করার সুপারিশ করেন সংস্কার কমিশনের প্রধান৷
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন৷ তিনি জানান, তারা সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের সুপারিশ করেছেন৷
ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরির জন্য আইন, বিচার ও প্রশাসনের মধ্যে একটি কাঠামোগত ভারস্যাম্য তৈরি করার প্রস্তাবও করেছে কমিশন৷ এছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও দায়িত্বের ভারসাম্যের প্রস্তাব করা হয়েছে৷
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর সুপারিশ করা হয়েছে৷ এই সংসদে আসনসংখ্যা হবে ৫০৫ আসন৷ এরমধ্যে উচ্চকক্ষে ১০৫ আসন এবং নিম্নকক্ষে ৪০০ আসন থাকবে৷ নিম্নকক্ষের ৪০০ আসনের মধ্যে ১০০ আসন নারীদের জন্য৷ এই আসনগুলোতে সরাসরি নির্বাচন হবে৷
বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম আলোচিত অংশ ৭০ অনুচ্ছেদ৷ এই অনুচ্ছেদ সংসদ সদস্যদের ফ্লোর ক্রসিং নিষিদ্ধ করেছে৷ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে কেউ নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না৷ এটাও সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে৷
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সেক্রেটারিয়েট বা সচিবালয় তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে৷ বিচার বিভাগে আর্থিক বরাদ্দ সরাসরি কনসোলিডেটেড ফান্ড (স্বতন্ত্র তহবিল) থেকে নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হয়েছে৷
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে নির্বাচনি আইন পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে৷ নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্বাচন কমিশন বা ইসির নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা, প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইনে সংশোধন, ইসির ক্ষমতা বাড়ানো ও জবাবদিহিতা তৈরি, নির্বাচনি শাস্তি ও ব্যবস্থা নেওয়ার বিধানগুলো কিছু ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট করা, হলফনামার ছকে পরিবর্তন, হলফনামার তথ্য যাচাই বাধ্যতামূলক করার কথা রয়েছে৷ নির্বাচনে ‘না' ভোটের সুযোগ যুক্ত করা, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়ন পদ্ধতিতে কিছু পরিবর্তন আনা, ন্যূনতম ভোটার ছাড়া নির্বাচন বাতিল, জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবা ইসির অধীনে রাখা, দুই কক্ষের পার্লামেন্ট ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রণয়নসহ বেশ কিছু সুপারিশ আছে৷ তারা মোট ১৫০টি সুপারিশ করেছে৷ তারমধ্যে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ২১ বছর এবং গণভোটের বিধানের প্রস্তাবও আছে৷
পুলিশ সংস্কার কমিশন একটি সমীক্ষা করেছে৷ সেই সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৮.৭ শতাংশ মানুষ এ বাহিনীকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত' করার ওপর জোর দেন৷ তাই বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি, বেতনভাতা ও পদোন্নতি, বৈষম্য নিরসনসহ নানা বিষয়ে তারা সুপারিশ করেছে৷ রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির বাইরে গিয়ে পুলিশকে স্বতন্ত্র কমিশনের অধীনে রাখার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সুপারিশে৷
বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চেয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন৷
এছাড়া বাহিনী সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে এই কমিশন৷
দুদক সংস্কার কমিশন দুদককে স্বাধীন ও কার্যকর করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে ৪৭ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছে৷
কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন বলেন, ‘‘আমাদের সুপারিশের মূলে রয়েছে একটা স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিতামূলক দুর্নীতি দমন কমিশন৷ আমরা চাইছি যাতে যে কারুর দুর্নীতি তারা তদন্ত করতে পারে৷ আবার তাদের জবাবদিহিতাও যাতে থাকে৷ তারা যাতে কাউকে ছাড় না দেয়৷ আবার কাউকে অযথা হয়রানি না করে৷ এজন্য আমাদের প্রস্তাবে কাঠামোগত দিকও থাকছে৷ আবার তারা জবাবদিহিতা কোথায় করবেন, নিয়োগ কীভাবে হবে তারও প্রস্তাব থাকছে৷''
প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসের প্রিন্স বলেন, ‘‘কার্যত কমিশনগুলো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়নি৷ তারা আরো সময় বাড়িয়ে দিয়েছে৷ রাজনেতিক দলগুলোর সঙ্গে এটা নিয়ে সংলাপের কথা বলা হচ্ছে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে৷ আসলে এগুলো সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ আমরা আগেই বলেছিলাম কমিশনগুলো যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে সংস্কার প্রস্তাব দিতো তাহলে কাজটি সহজ হতো৷ সময় আরো কম লাগত৷''
‘‘এখন মধ্য ফেব্রুয়ারিতে সংলাপ করবে৷ তাতে কত সময় লাগবে আমরা জানি না৷ প্রধান উপদেষ্টা যে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের কথা বলছেন আসলে তার কোনোটাই স্পষ্ট নয়৷ কী সংস্কার প্রয়োজন, কতটুকু করা যাবে সেই বিষয়ে এখনো কিছু ঠিক হয়নি৷ আসলে এই সব সংস্কারের নামে সময় কাটানো ছাড়া আর কিছুই করা হচ্ছে না,'' বলেন তিনি৷
আর প্রতিবেদনগুলো ওয়েবসাইটে দেখে তারপর প্রতিবেদনের ব্যাপারে মন্তব্য করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সংস্কার তারা কত প্রকারে করতে চায় তা দেখতে চাই৷''
আর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘আমরা জুন-জুলাইয়ের মধ্যেই নির্বাচন চাই৷ প্রয়োজনীয় সংস্কারও করতে হবে৷ কিন্তু সংস্কারের নামে এখন সময় পার করা হচ্ছে৷ ১৫ বছর দেশে স্বৈরশাসন ছিল৷ কিন্তু এখন যদি আবার এভাবে সময় পার করা হয় তাহলে অশুভ শক্তি সুযোগ নেবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তারা আসলে সংস্কারের বিষয়টি এখনো স্পষ্ট করতে পারছে না৷ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে না৷ আসলে তারা কী চায় তাই স্পষ্ট নয়৷''
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেন, ‘‘তারা সংস্কারের নামে অপ্রয়োজনীয় কাজ করে সময় পার করছেন৷ তাদের উচিত ছিলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেটুকু প্রয়োজন ততটুকু করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা৷''
তিনি বলেন, ‘‘তারা যে সংস্কারই করুন না কেন তা পরবর্তী নির্বাচিত সংসদে অনুমোদন প্রয়োজন হবে৷ পরবর্তী সংসদ অনুমোদন না করলে এই সংস্কার বাস্তবায়ন হবে না৷ তাই আগে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে ঠিক করে নেয়া দরকার ছিল৷''
ইকতেদার আহমেদ জানান, ‘‘ওয়ান ইলেভেন সরকার ১২২টি অধ্যাদেশ করেছিলো তার মধ্যে পরের নির্বাচিত সরকার ৪৬টি আইনে পরিণত করেছে, ৭৮টি বাতিল করেছে৷ ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর তিন জোটের রূপরেখা মেনে ৩৬টি কমিশন করা হয়েছিল তাও কোনো কাজে আসেনি৷ আর এখন যারা এই সংস্কারের প্রস্তাব দিচ্ছে তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে৷ আসলে সরকারের দায়িত্ব হলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের সেটা তাদের করা উচিত৷''