ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে পরষ্পর সংযুক্ত বিশ্ব নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে আজ মরিয়া৷ কিন্তু এ বিচ্ছিন্নতার পরিণতিতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে সংকট দেখা দেওয়া আশঙ্কা করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে লড়াই আরো কঠিন হবে৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের কলামিস্ট আলেক্সান্ডার গোয়ালাখ এ বিষয়ে জানিয়েছেন তার মতামত৷
এই মুহূর্তে আমাদের এক সঙ্গে বড় দুইটি সংকটের মধ্যদিয়ে যেতে হচ্ছে৷ এক, করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর রূপ নেওয়া; দুই, এর ফলে বিশ্বজুড়ে আর্থিক ও অর্থনৈতিক যে দুর্যোগ ঘনিয়ে উঠেছে তা৷ বলা যায়, করোনা ভাইরাস সংকট কেটে যাওয়ার পর অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার লড়াই হবে আরো কঠিন৷
যদিও এই দুই সংকটের মধ্যে তুলনা করা বা কোনটি বেশি ভয়ঙ্কর সেটা বলা কোনো কাজের কথা না৷ কারণ এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রায় দুই লাখ মানুষ করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন, মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ হাজার ছুঁইঁছুঁই৷
বৈশ্বিক মহামারী বর্ণান্ধ
বৈশ্বিক মহামারী সীমান্ত, বর্ণ, ধর্ম, সংস্কৃতি বা ভাষা কিছু চেনে না৷ রোগ ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এই পুরানো প্রবাদ আবারও সঠিক প্রমাণিত হয়েছে৷
চীনের উহান থেকে প্রাদুর্ভাব হওয়া করোনা ভাইরাস এখন ইটালি, ইরান, ফ্রান্স, স্পেন,অ্যামেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়ার মারাত্মক কামড় বসিয়েছে৷ দেশগুলোতে হাজার হাজার মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন, একই গতি বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা৷
মাস দুয়েক আগে চীনের দিকে বাঁকা চোখে তাকানো বাকি বিশ্ব আজ একই অবস্থার মুখোমুখি৷ এই দেশে-দেশে ভেদাভেদ খুব একটা নেই৷ তাই বিচ্ছিন্ন না হয়ে দেশগুলো বরং নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করে সবাই মিলে একযোগে করোনা সংকটের মোকাবেলা করতে পারে৷
করোনা আতঙ্ক: জার্মানিও বন্ধ করেছে দুয়ার
করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টার এখন ইউরোপ৷ বৈশ্বিক মহামারীর রূপ নেওয়া করোনার বিস্তার ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মঙ্গলবার ৩০ দিনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Silz
ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশের নাগরিকদের বুধবার সকাল থেকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Silz
একদিনেই ১২০ ফ্লাইট
ইইউর এ সিদ্ধান্তের কারণে একদিনেই শুধু ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে ১২০টি ফ্লাইটের প্রায় নয় হাজার যাত্রীকে বাড়তি পর্যবেক্ষণের মধ্যদিয়ে যেতে হবে৷
ছবি: Reuters/R. Orlowski
ঢুকতে না পারা যাত্রীদের দায়িত্ব নিচ্ছে এয়ারলাইন
নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে যারা ফ্রাঙ্কফুর্টে আটকে গেছেন তাদের যেখান থেকে যাত্রা করেছেন সেই বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে নিজ নিজ এয়ারলাইন৷
ছবি: picture-alliance/empics/The Canadian Press/D. Dyck
কারা ঢুকতে পারছেন?
জার্মান নাগরিক ও তাদের পরিবার এখনো বিনাবাধায় দেশে ফিরতে পারবেন৷ এছাড়া জার্মানিতে যাদের বসবাসের অনুমতি (রেসিডেন্স পারমিট) আছে তারা ছাড়াও ইইউ সদস্যরাষ্ট্রের নাগরিক, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, লিশটেনস্টাইন ও সুইজারল্যান্ডের নাগরিক ও তাদের পরিবার৷ যাদের দীর্ঘমেয়াদী জার্মান ভিসা আছে (যেমন ছাত্ররা) তারাও ঢুকতে পারবেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Silz
কারা পারছেন না?
মূলত পর্যটক বা ব্যবসার কাজে স্বল্প সময়ের ভিসা নিয়ে আসা ব্যক্তিদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷ তবে ট্রানজিট যাত্রীদের বিমানবন্দরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে৷ তবে নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করতে হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Schreiber
জরুরি প্রমাণে বিশেষ ছাড়
সব কিছুর পরও যদি কেউ জরুরি প্রয়োজন প্রমাণ করতে পারেন তাকে বিশেষ বিবেচনায় প্রবেশ করে দেওয়া হতে পারে৷ সেক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Silz
6 ছবি1 | 6
তৃতীয় সংকট
করোনার কারণে তৃতীয় আরেকটি সংকটও তৈরি হয়েছে৷ যেটা অবশ্যই আগের দুইটির সঙ্গে সংযুক্ত৷ সেটা হলো ‘সামাজিক দূরত্ব' বজায় রাখতে পারা৷ করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে সব দেশই জনগণকে ভিড় এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছে৷ যেখানে বিস্তার ভয়াবহ সেখানে ‘লকডাউন‘ করা হচ্ছে৷ ভাইরাস বিস্তারের গতি কমিয়ে দিতে বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বের হলে জেল-জরিমানাও করছে কোনো কোনো দেশ৷ পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম স্বাধীন চালাচলে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে৷
করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে লোকজন বাড়ির চার দেয়ালে নিজেকে আটকে রাখছে বা অচেনা পরিবেশে কোয়ারান্টিনে আছে৷ প্রতিবেশী, নগর, রাজ্য বা দেশ সবার থেকে আলাদা হয়ে আছে৷ এমনকি এক দেশ আরেক দেশ থেকে আলাদা হচ্ছে৷ যুক্তরাষ্ট্র আগেই সীমান্তে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নও এখন একই পথে চলছে৷ কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো ইউরোপে স্বাধীন চলাচল বন্ধের ঘোষণা আসবে৷
বিচ্ছিন্নতায়ও একত্র থাকার চেষ্টা
সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মানুষ অসহায়বোধ করে৷ এ অবস্থা কাটাতে নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে৷ যে বই পড়বো পড়বো বলে পড়া হয়ে উঠেনি সেগুলো পড়া, সিনেমা দেখাসহ নানাভাবে অস্বস্তিকর এ সময় পার করতে বলা হচ্ছে৷
ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কয়ার, বা সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনা, সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে৷ আক্রান্ত প্রায় সবদেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে৷
অবরুদ্ধ এ অবস্থায় যখন সবাই নিজ নিজ ঘরে বন্দি তখন একে অন্যকে সাহস যোগাতে আমরা বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে পারি৷ যেমন গত সপ্তাহে ইতালীয়রা নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বা জানালা খুলে গান গেয়ে একে অন্যকে উৎসাহিত করেছেন৷
গতকাল কয়েকটি দেশে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইরত চিকিৎসাকর্মীদের সমর্থন ও সাহস যোগাতে এক যোগে হাতহাতি দেওয়া হয়৷
ফিরছেন নাগরিকরা, আবারও বাড়ছে এশিয়ার ঝুঁকি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইউরোপকে করোনা ভাইরাসের বর্তমান এপিসেন্টার ঘোষণা করেছে৷ এশিয়ার দেশগুলোর নাগরিকরা দলে দলে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরছেন৷ এশিয়া তাই নতুন করে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে৷
ছবি: bdnews24.com
লড়াইয়ে সফল যারা
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়া হংকং, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান করোনা ভাইরাস ঝড় অনেকটাই সামলে উঠেছে৷ সেখানে প্রতিদিনই নতুন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা কমছে৷
ছবি: picture-alliance/Xinhua/S. Bohan
আবারও বাজছে বিপদের ঘণ্টা
সম্প্রতি চীনে নতুন সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুই আবার বাড়তে শুরু করেছে৷ হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ক্যারি লাম বলেন, ‘‘কয়েকটি দেশে করোনা ভাইরাস রীতিমত বিস্ফোরণ আকারে ছড়িয়েছে৷ যদি আমরা কিছু কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করি তবে হয়তো গত দুই মাসে আমরা যে লড়াই করেছি তা ভেস্তে যাবে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Ibrahim
ভাইরাস নিয়ে ফিরছেন বাসিন্দারা
চীনে সোমবার নতুন করে ২১ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়৷ তাদের মধ্যে ২০ জনই বিদেশ থেকে ফিরেছেন এবং বেশিরভাগই দেশটির নাগরিক৷
ছবি: Getty Images/AFP/Str
হংকং-তাইওয়ানেও একই অবস্থা
হংকংয়ে গত দুই সপ্তাহে যে কয়জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে তারা সবাই বিদেশ থেকে ফিরেছেন৷ তাইওয়ানে মঙ্গলবার পর্যন্ত নতুন পাওয়া আক্রান্তদের সবাইও বিদেশ ফেরত৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
সিঙ্গাপুরে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ
সিঙ্গাপুরে সোমবার নতুন করে ১৭ জন করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে৷ যাদের ১১ জনই বিদেশ থেকে ফিরেছেন৷ দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন শনাক্ত ৪৪ জনের বেশিরভাগই ভ্রমণে ছিলেন৷
ছবি: DW/L. Yunzhong
আতঙ্কে ইউরোপ ছাড়ছেন অনেকে
এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বৈধ-অবৈধ পথে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে ইউরোপে বিশেষ করে ইটালিতে বসবাস করা লোকজন আতঙ্কে যে যেভাবে পারছেন ইউরোপ ছাড়ছেন৷ অনেক বাংলাদেশিও ইটালি থেকে ফিরেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
বাংলাদেশেও প্রথম রোগী বিদেশ ফেরত
বাংলাদেশেও করোনা আক্রান্ত প্রথম তিন জনের দুই জন ইটালি থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন৷ তাদের মাধ্যমে অন্য একজন করোনায় আক্রান্ত হন৷ এখন পর্যন্ত দেশটিতে ১০ জনের করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে৷ যাদের সবাই হয় বিদেশ থেকে ফিরেছেন বা বিদেশ ফেরত কারো সংস্পর্শে এসেছেন৷