সোমবার সকাল থেকে বাংলাদেশে আবারো বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের টানা তিন দিনের হরতাল শুরু হয়েছে৷ গত সপ্তাহের ৬০ ঘণ্টা হরতালের পর, সংলাপ শুরু হবে – এমন একটা ধারণা করা হচ্ছিল৷ কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি৷
বিজ্ঞাপন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোনে হরতাল প্রত্যাহার করে সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গত ২৬শে অক্টোবর৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দিষ্ট করা সময়ে সংলাপে না গিয়ে বিরোধী দল ২৭শে অক্টোবর থেকে টানা তিন দিনের হরতাল পালন করে৷ সেই হরতালের পর সংলাপের আশা করা হলেও, শেষ পর্যন্ত তা হয়নি৷ বরং দুই নেত্রীর ফোনালাপ এবং তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক করেই সময় কেটে গেছে৷ যার অনিবার্য পরিণতি আবারো তিন দিনের হরতাল৷
সোমবার হরতাল শুরুর আগেই রবিবার রাতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন যানবাহনে আগুন দেয়া হয়েছে৷ গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ছোড়া হয়েছে ককটেল বোমা৷ বিআরটিসি-র দোতলা বাসসহ অন্তত ১০টি যানবাহনে আগুন ও ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে৷ এদিকে এই হরতালের কারণে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা পিছিয়ে গেছে৷ সোমবার এই পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল৷ এতে প্রায় ২০ লাখ পরীক্ষার্থী বিপাকে পড়েছে৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, এবার হরতাল প্রত্যাহার না করলে সরকার আর বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসবে না৷ তিনি বলেন, হরতাল আর সংলাপ একসঙ্গে হয় না৷ তবে শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারো হরতাল প্রত্যাহার করে বিরোধী দলকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
তবে এর জবাবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকার সংলাপের নামে নাটক করছে৷ তিনি বলেন, সরকার আসলে সংলাপের নামে কৌশল করছে৷ তারা আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করে একতরফা নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে৷ সরকারের এই নীলনক্সা প্রতিহত করতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই৷ তাঁর কথায়, সরকার যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের প্রস্তাব মেনে নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চায় তাহলে বিরোধী দল আলোচনায় বসবে৷ নয়ত আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করা হবে৷
সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, সরকার ও বিরোধী দল এখন কার্যত যুদ্ধে নেমেছে৷ তাই সংলাপের আর কোনো সম্ভাবনা তিনি আপাতত দেখছেন না৷ সরকারি দল যেমন তাদের অধীনে নির্বাচনের জন্য এগিয়ে যাচ্ছে, বিরোধী দলও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য মাঠে নেমেছে৷ তাঁর মতে, আলোচনা বাদ দিয়ে মাঠে সমাধান চাইলে তাতে সংঘাত-রক্তপাত অনিবার্য৷