সংলাপে কি গলবে বরফ?
৭ জানুয়ারি ২০২২গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশনও এখন বাংলাদেশে সোনার পাথরবাটি৷ ভালো হোক, খারাপ হোক নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার গঠিত হয়৷ কিন্তু নির্বাচন কমিশন কীভাবে গঠিত হবে? নির্বাচন কমিশন গঠনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির৷ কিন্তু কীভাবে তিনি সেটি গঠন করবেন, তা সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, ''প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন৷''
নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ অনুসরণ করেন; কিন্তু পুরোটা নয়, আংশিক৷ তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কিছু করার নেই৷ আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে নিয়োগ করার কথা থাকলেও আইনটাই যে করা হয়নি৷ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তি পালন করেছি আমরা৷ এই ৫০ বছরে ১১টি সংসদে এবং সংসদ না থাকা সময়ে অধ্যাদেশ আকারে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় অনেক আইন প্রণীত হয়েছে৷ কিন্তু দেশের জন্য, নির্বাচনের জন্য, রাজনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে উল্লেখ করা আইনটিই প্রণীত হয়নি৷ আরো মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো ব্যক্তি কখনো নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নে বিরোধিতা করেনি৷ সবাই প্রয়োজনীয়তাটা মানলেও কেউই আইনটি প্রণয়ন করেনি৷
টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আছে বলে আওয়ামী লীগের দায় বেশি৷ কিন্তু বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিও বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল৷ তারাও আইনটি করেনি৷ জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসনের আমল না হয় বাদই দিলাম৷ স্বৈরাচার পতনের পর গণতান্ত্রিক আমলেও বিএনপি তিন দফায় ক্ষমতায় ছিল৷ তাই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন না হওয়ার দায় সবাইকে নিতে হবে৷ ক্ষসতাসীন আওয়ামী লীগ আইনের বিরোধিতা করছে না৷ তারপরও আইনটি হয়নি৷ এ ক্ষেত্রে একটি মজার ঘটনা ঘটে৷ পাঁচ বছর পর আমাদের রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের এই আইনটির কথা মনে পরে৷ সবাই সরব হন৷ কিন্তু তখন আর আইনটি করার সময় থাকে না৷
এবারও আইন মন্ত্রী বলছেন, আইন প্রণয়নের সময় নেই৷ অথচ বাস্তবতা হলো, আন্তরিকতা থাকলে এ্কটি আইন প্রণয়নে সময় কোনো বাধা নয়৷ এবারও কোনোরকমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়ে গেলে পরের পাঁচ বছর আমরা সবাই আইনটির কথা ভুলে যাবো৷ যথারীতি আবার নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে আগে মনে পরবে এবং পর্যাপ্ত সময় না থাকায় আইনটি হবে না৷
তবে আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই৷ বিড়াল সাদা না কালো, সেটা ব্যাপার নয়; বিড়ালটি ইঁদুর মারে কিনা, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ৷ আইনের মাধ্যমে হোক, সার্চ কমিটির মাধ্যমে হোক বা রাষ্ট্রপতি সরাসরি করুন; নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে পারছে কিনা; সেটাই গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু এই মূল দায়িত্বে নির্বাচন কমিশন চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে৷ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১২টি নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালন করেছে৷ কিন্তু কোনো নির্বাচনই পুরপুরি গ্রহণযোগ্য হয়নি৷ কারণ নির্বাচন যেমনই হোক, পরাজিত প্রার্থী বা দল কারচুপির অভিযোগ আনেনই৷ এতকিছুর পরও স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯১, ৯৬, ২০০১, ২০০৮ সালের নির্বাচন সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল৷ এই নির্বাচনগুলো যে নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই কমিশনও কিন্তু আইন ছাড়াই হয়েছিল৷ বাংলাদেশের ১২টি নির্বাচন কমিশনের মধ্যে প্রধম ৬টির নেতৃত্ব দিয়েছেন বিচারপতিরা৷ পরের ৬টির নেতৃত্বে ছিলেন আমলারা৷ কিন্তু আমলা বা বিচারপতি- গুণগত পার্থক্য কিছুই হয়নি৷
কোনো আইন না থাকায় রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা বলে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতেন৷ তবে গত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলেছেন, সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন৷ কোনো আলোচনা না হওয়ার চেয়ে সংলাপ হওয়া বা সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনকে মন্দের ভালো বলা যেতো৷ কিন্তু সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে দুটি নির্বাচন গঠিত হয়েছে, সে দুটি কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন দুটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে নির্বাচনের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে৷ তার মানে সার্চ কমিটিও ভালো নির্বাচন কমিশন বা ভালো নির্বাচনের গ্যারান্টি দিতে পারে না৷
আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করছেন৷ সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে দিয়ে সংলাপ শুরু হয়েছে, তবে এখনও আওয়ামী লীগ-বিএনপির মত মূল দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি৷ ধাপে ধাপে সবাইকেই আমন্ত্রণ জানানো হবে হয়তো৷ কিন্তু রাষ্ট্রপতির এই সংলাপ রাজনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি৷ ইতিমধ্যে আমন্ত্রণ পাওয়া দলগুলোর মধ্যে বাসদ, সিপিবি এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংলাপে অংশ নেয়নি৷ সিপিবি জানিয়ে দিয়েছে, তাদের বলার কিছু নেই৷ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রপতির সংলাপকে ‘প্রহসন' বা ‘তামাশা' বলে অভিহিত করছে৷
অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারস্পরিক সম্পর্ক, বিশ্বাস, সৌহার্দ্য, আলোচনা অনুপস্থিত৷ রাজনীতি এখন ভারসাম্যহীন, একতরফা নৌকায় সওয়ার৷ রাষ্ট্রপতির সংলাপ তাতে কিছু ভারসাম্য আনতে পারতো৷ কিন্তু অর্থহীন সংলাপ শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে কোনো উত্তাপ আনতে পারবে বলে মনে হয় না৷ যেভাবে এগুচ্ছে, তাতে এবারও হয়তো সংলাপ শেষে একটি সার্চ কমিটি গঠিত হবে৷ যাদের সুপারিশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন৷ কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, তাতে রাজনীতির অনড় বরফ গলবে না৷ গত মেয়াদে বিএনপি সংলাপে অঙম নিয়েছিল৷ তাদের সুপারিশে মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনার হতে পেরেছিলেন৷ কিন্তু তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজেদের কমিশনের কর্মকান্ড এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা ছাড়া আর কিছু করতে পারেননি৷ সেই অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি এবার সংলাপে অংশ না নিলে তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যাবে না৷ তবে শঙ্কাটা হলো, নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে কোনো ঐকমত্য না হওয়া রাজনৈতিক সঙ্কট আগামী ২০২৩ বা ২৪ সালে অনুষ্ঠেয় পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত জিইয়ে থাকা৷
সবাই যেভাবে আইনের কথা বলছেন, মনে হচ্ছে, আইন হলেই সকল সমস্যা মিটে যাবে, নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে, সবাই দলে দলে ভোট কেন্দ্রে যাবে৷ তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, এবার আইন প্রণয়ন করেই নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে৷ তাতেই কি আগামী নির্বাচন ভালো হওয়ার গ্যারান্টি মিলবে? আইন না হয় হলো, কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার কারা হবেন৷ এই বিচারপতি রউফ, বিচারপতি আজিজ, কাজী রকিব, নুরুল হুদারাই তো নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্ব দেবেন৷ চাঁদ বা মঙ্গলগ্রহ থেকে তো আর কমিশনার আনা যাবে না৷ বিচারপতি বলেন আর আমলা বলেন, ফারাক তো কিছু দেখিনি, যেই লাউ সেই কদু৷ আইন করলেই তো আর বাংলাদেশে টি এন শেসন পয়দা হবে না৷ আইন করে বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানালেও তো যিনি যা করার তাই করতেন৷ আইন তো আর বিচারপতি রউফ বা বিচারপতি আজিজের মেরুদণ্ড শক্ত করে দিতো না৷
কমিশন গঠনের আইন না হলেও সংবিধানে কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে৷ সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন৷‘ এছাড়া নির্বাচনের সময় সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ক্ষমতা কমিশনের হাতেই থাকে৷ কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন কখনোই নিজেদের এই স্বাধীনতা বা ক্ষমতা প্রয়োগ করে না৷ আসলে তারা যে স্বাধীন, সেটাই বোধহয় তারা ভুলে যান৷ বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনগুলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগের অধীনের কোনো প্রতিষ্ঠানের বেশি কিছু মনে হয়নি কখনো৷
সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা আমলাদের মধ্য থেকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া হয় এবং এরপর তারা আর কোনো দায়িত্ব পালনের যোগ্য থাকেন না৷ তারমানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারই একজন ব্যক্তির জীবনের সর্বোচ্চ ও শেষ পদ৷ নির্বাচন কমিশনাররা বড় জোর প্রধান নির্বাচন কমিশনার হতে পারেন৷ যদিও বাংলাদেশে এখনও কোনো নির্বাচন কমিশনার পদোন্নতি পেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হননি৷ তার মানে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজের ক্ষমতার পরিপূর্ণ প্রয়োগ করে জাতির কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন৷ সরকার নির্বাচন কমিশনকে তাদের পক্ষে নির্বাচন পরিচালনার নির্দেশ দেন কিনা জানি না৷ আচ্ছা প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি সরকারের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশনা, ইশারা-ইঙ্গিত উপেক্ষা করে নিজেদের সর্বোচ্চ ক্ষমতার প্রয়োগ করে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করে; তাহলে কী হবে? সরকারি দল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কী করবেন? কিসের আশায়, কিসের লোভে নির্বাচন কমিশনারেরা নিজেদের সরকারের ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার করে ফেলেন, আমি জানি না৷ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে যারা জাতির কাছে বীর হয়ে থাকতে পারতেন, তারাই কিনা নিক্ষিপ্ত হন ইতিহাসের আস্তাকুড়ে৷ বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নামই মানুষ স্মরণ করে ঘৃণার সাথে৷
ধরুন বিচারপতি আব্দুর রউফ যদি মাগুরা থেকে পালিয়ে আসার আগে সেই উপনির্বাচনটি বাতিল করে দিতেন, যে ক্ষমতা তার ছিল, তাহলে পাল্টে যেতে পারতো বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস৷ বিচারপতি রউফ হতে পারতেন বাংলাদেশের মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় ব্যক্তি৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারতেন কাজী রকিব বা ২০১৮ সালের অস্বাভাবিক নির্বাচনের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে পারতেন নুরুল হুদা৷ তাতে তাদের কী ক্ষতি হতো৷ বড় জোর আওয়ামী লীগ কায়দা-কানুন করে মেয়াদের আগেই তাদের পদত্যাগে বাধ্য করতো৷ এর বেশি তো কিছু নয়৷ কিন্তু রউফ, রকিব বা হুদা কেউই তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি বা নিজেদের ক্ষমতার ব্যাপারে তারা সচেতনই নন৷
বিচারপতি রউফ, বিচারপতি আজিজ, কাজী রকিবরা গণমানুষের ঘৃণা ছাড়া বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কারো কাছ থেকে কিছু পাননি৷ কেন জানি মনে হয়, সাবেক বিচারপতি বা আমলারা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বকে চাকরির এক্সটেনশনের বেশি কিছু মনে করেন না৷ তাই আগের চাকরির মত সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করেন না তারা৷ সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিভক্ত রাজনীতির বিষ ছড়িয়ে পরেছে৷ হয় আপনি আওয়ামী লীগ, নয় আপনি বিএনপি৷ এর বাইরে ভাবনার ক্ষমতাও নেই কারো৷
তাই ব্যক্তির সততা, দৃঢ়তা নিশ্চিত করতে না পারলে আইন বলুন, সার্চ কমিটি বলুন; কিছুতেই কিছু হবে না৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার পদটি যে দলীয় আনুগত্যের দলিল নয়, শেষ বয়সে দেশকে সেবা করার পবিত্র সাংবিধানিক দায়িত্ব; এটা তারা না বুঝলে কোনোদিনই সমস্যার সমাধান হবে না৷
নির্বাচন কমিশন যখন বলে, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে না এলে আমরা কী করবো, তখন তাদের অসহায়ত্বটা আমরা টের পাই৷ সত্যিই তো তাদের কিইবা করার আছে৷ রাজনৈতিক দলগুলোই তো নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রেখেছে৷ সব দায় নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে দিলে হবে না৷ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দায় নিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেও৷ বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলেই ২০১৪ সালে নির্বাচন হওয়ার আগেই সরকার গঠনের মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ৷ সংবিধানে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে৷ তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থি৷ আবার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগও সংবিধানেই আছে৷
সংবিধানে যত সুযোগই থাকুক, ১৫৩ জনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়া অবশ্যই সংবিধানের মুল চেতনার পরিপন্থি৷ আবার চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার যে হিড়িক চলছে, তা নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই হাস্যকর করে তুলেছে৷ ২০১৮ সালে বিএনপি এলে আওয়ামী লীগ যেভাবে কৌশলে নির্বাচনে জিতে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে; তার দায়ও আওয়ামী লীগকে নিতে হবে৷ এখন মানুষ ভোট দিতে যায় না, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপারেও মানুষের আগ্রহ কমে গেছে৷
নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা, মানুষকে ভোট কেন্দ্রে আসতে অনুপ্রাণিত করা, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপারে আগ্রহী করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে৷ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো সবার জন্য মাঠটা সমান রাখা৷ রাজনৈতিক দলগুলোকেই বসে ঠিক করতে হবে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কেমন হবে৷
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অচলাবস্থার যে বরফ, তা গলানোর কোনো উদ্যোগ নেই৷ পর্দার সামনে বা পেছনে কোনো আলাপ-আলোচনা, সমঝোতার চেষ্টা নেই৷ বিএনপি গণঅভ্যুত্থান বা রাজপথে ফয়সালার দাবি করলেও সেই সক্ষমতা যে তাদের নেই, সেটা তারাও জানে৷ রাষ্ট্রপতির সংলাপ হতে পারতো, সেই বরফ গলানোর একটা শুরু৷ রাষ্ট্রপতির সংলাপকে অর্থহীন বলে উপেক্ষা না করে, এখান থেকেই সমাধানের একটা সূত্র খোঁজার শুরুটা হতে পারে৷