সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল সংসদের হাতে তা চূড়ান্তভাবে বাতিল করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ এই ক্ষমতা আবারো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরে গেল বলে জানিয়েছেন আইনজীবী৷
বিজ্ঞাপন
১৯৭২-এর সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণে বা অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের হাতেই ছিল৷ ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা দেয়া হয় রাষ্ট্রপতিকে৷ ১৯৭৮ সালে জিয়উর রহমান সামরিক ফরমানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে এই ক্ষমতা দেয়, যা সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হয়৷ বর্তমান সরকারের আমালে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচাপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবার সংসদ সদস্যদের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়৷
কিন্তু ওই বছররে ৫ নভেম্বর সংশোধনী বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়৷ শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রাষ্ট্রপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে সোমবার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্ব সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে৷
আপিল বিভাগ শুনানিকালে মোট ১০জন অ্যামিকাস কিউরির মতামত নেয়৷ তাঁদের মধ্যে ৯ জন ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে মত দেন৷ তাঁরা হলেন ড. কামাল হোসেন, এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টি এইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল এবং এ জে মোহাম্মদ আলী৷ শুধুমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দিয়েছেন৷
মনজিল মোরসেদ
সোমবারে রায়ের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘বিচারপতিদের অপসারণে সামরিক সরকারের করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আদালত কেন সাংঘর্ষিক মনে করছেন না, তা আমার বোধগম্য নয়৷ বিচারপতি অপসারণের বিষয়ে সংসদের হাতে যে ক্ষমতা ছিল, সেটি ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত৷ আপিল বিভাগ একটি সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়ে আমাদের আপিল খারিজ করে দিয়েছেন৷ এখনও আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় পায়নি৷ রায় পেলে আমাদের করণীয় নির্ধারণ করবো৷''
সাবেক আইনমন্ত্রী এবং বিএনপি নেতা ব্যাস্টিার মওদুদ আহমেদ সংবাদমাধ্যমেকে বলেন, ‘‘সরকার বিচার বিভাগের ওপর যে হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিল, তা এই রায়ের মধ্য দিয়ে ধূলিসাৎ হয়েছে৷ এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল সরকার৷''
এদিকে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে গেল৷ এই রায় ঘোষণার পর থেকেই কাউন্সিল আবার কার্যকর হলো৷''
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কিভাবে কাজ করে এবং এর গঠন কী জানতে চাইল মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘কোনো বিচারপতির অদক্ষতা, দুর্নীতি বা বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে বলবেন৷ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে এই কাউন্সিলে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিসহ মোট তিন সদস্যের কাউন্সিল হবে৷ এই কাউন্সিলই অভিযোগের তদন্ত করবে, শুনানি করবে৷ আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেবে৷ এরপর তারা সিদ্ধান্ত দেবে যে অভিযোগটি সঠিক কিনা৷ তারপর রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মতামতের ভিত্তিতে ওই বিচারকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন৷''
সংসদের হাতে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা থাকায় অসুবিধা কী ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি হতো৷ তারা পুরো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারতেন না৷ কারণ বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা শুধু আইন প্রণয়নই করেন না, তাঁরা নিজের নির্বাচনি এলকায় উন্নয়নমূলক কাজসহ নানা কাজে জড়িত৷ তাছাড়া উচ্চ আদালতে যত রিট বা মামলা হয়, তার অধিকাংশই এইসব কাজ নিয়ে৷ একজন সংসদ সদস্য চান যে রায় যেন তাঁর পক্ষে আসে৷ ফলে তা বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করতো৷ অথবা রায় কারুর বিপক্ষে গেলে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হতো৷ সংসদে অভিযোগ তুলে আলোচনাও শুরু হতো৷ ফলে বিচারকের স্বাধীনভাবে বিচার করা কঠিন হয়ে পড়তো৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এই রায়ের মধ্য দিয়ে সংসদের সার্বভৌমত্ব কোনোভাবেই ক্ষুণ্ণ হয়নি৷ এছাড়া সংসদের সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই৷ বাংলাদেশের সংবিধান অনুয়ায়ী সার্বভৌম হলো জনগণ৷ অর্থাৎ স্বার্বভৌমত্ব জনগণের৷ সংসদ আইন প্রণয়ণ করবে আর সংবিধানের রক্ষক হলো সুপ্রিমকোর্ট৷ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বা যে কোনো আইনই সুপ্রিমকোর্ট বাতিল করে দিতে পারে৷''
বিচার পাওয়ার আশা যেন দুরাশা
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বাংলাদেশে এখন একটি অতি উচ্চারিত শব্দযুগল৷ বিচার হচ্ছে না কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছে এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: dapd
ব্লগার হত্যা
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এরপর একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচারে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি না হওয়ায় সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান৷
ছবি: Privat
সাংবাদিক দম্পতি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়৷ গত চার বছরে এই মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হয়ে র্যাব-এর হাতে পৌঁছেছে৷ গত মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যেক হত্যাকাণ্ড তদন্তের মাধ্যমে তার বিচার করতে পেরেছি৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড অন্য কথা৷ ওটা এখানে না আসাই ভালো৷’’
ছবি: DW
ধর্ষণের বিচার
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬০ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অথচ কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যা করা হয়৷ হত্যার দুদিন পর শীতলক্ষ্যার একটি খালে তার লাশ পাওয়া যায়৷ রাষ্ট্রের অনিহা থাকায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার থমকে আছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেন রফিউর রহমান রাব্বি৷ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমানের পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Facebook/Taqi.Mancha
তনু হত্যা
চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছিল৷ দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ তবে তদন্তকাজ চলছে৷
ছবি: Twitter
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারশ’র বেশি মানুষের প্রাণ যায়৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক ছিল৷ তিন বছরেরও বেশি সময় পর গত জুলাইতে এই ঘটনায় করা হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়৷ ঢাকার এক অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ বছরে উল্লেখ্যযোগ্য শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮টি৷ এর কোনোটিরই বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি৷ প্রতিবেদনটি পড়তে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নীচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ঘটনার দিনই তাঁর ভাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন৷ এই অভিনেতা খুন হওয়ার পর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও এখনও মামলার বিচার শুরু করা যায়নি৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন৷ এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা – দু’টিই হবিগঞ্জে দায়ের হলেও পরে সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়৷
ছবি: Facebook/Justice-for-Shah-AMS-Kibria
হতাশ রামুর ক্ষতিগ্রস্তরা
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালিয়ে ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক৷ ঐ ঘটনার চার বছর পরও মামলা গতিশীল না হওয়ায় হাতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা৷ পিপি মমতাজ আহমদ সম্প্রতি বলেন, এই হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৯টি মামলায় ইতোমধ্যেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: AFP/Getty Images
নারী নির্যাতনের মামলা ৫,০০৩টি, রায় ৮২০টির
২০১৫ সালে প্রকাশিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ বলছে, গত নয় বছরে দেশের নয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷