ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সংসদের অধিবেশনে কাটছাঁট করে ব্রেক্সিটের আগে বিরোধীদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করলেও তারা হাল ছাড়তে প্রস্তুত নন৷ ৩১শে অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদের নির্ধারিত তারিখের আগেই তারা চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের সম্ভাবনা দূর করতে বদ্ধপরিকর৷ এই লক্ষ্যে সময় নষ্ট না করে আগামী সপ্তাহে সংসদের অধিবেশন শুরু হলেই বিরোধী লেবার দল আপদকালীন বিতর্ক শুরু করতে চায়৷ দলের নেতা জেরেমি কর্বিন বলেন, প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রীর বেপরোয়া উদ্যোগ থামানোর চেষ্টা করা হবে৷ পরে লেবারসহ পাঁচটি বিরোধী দল এক যৌথ ঘোষণাপত্রে সংসদ মুলতুবির পদক্ষেপ নিয়ে ভোটাভুটির উদ্যোগের ঘোষণা করেছে৷
বরিস জনসন জানিয়েছেন, তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ব্রেক্সিটের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ সেপ্টেম্বরে প্রতি সপ্তাহে দুই দিন করে দুই পক্ষের আলোচনা হবে বলে তিনি ঘোষণা করেন৷ তবে ৩১শে অক্টোবর যে কোনো মূল্যে ব্রেক্সিটের অঙ্গীকার থেকে তিনি সরে আসতে প্রস্তুত নন৷
বুধবার ব্রাসেলসে জনসনের ব্রেক্সিট বিষয়ক মধ্যস্থতাকারী ডেভিড ফ্রস্ট ও ইইউ কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকে কোনোরকম অগ্রগতি হয়নি বলে জানিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টেফান ব্লক৷ উল্লেখ্য, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ গত সপ্তাহে জনসনকে এক মাসের মধ্যে ব্যাকস্টপ ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্য বিকল্প পেশ করার ডাক দিয়েছিলেন৷ জনসন ব্রেক্সিট চুক্তি থেকে এই শর্ত দূর করার দাবি জানিয়ে আসছেন৷ ব্যাকস্টপ ছাড়াও শুল্ক, নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা, বাণিজ্য নীতি বিষয়েও দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে৷
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সংসদ মুলতুবি রাখার পদক্ষেপ ইউরোপীয় ইউনিয়নেও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে৷ এই অবস্থায় আলোচনায় জনসনকে কোনো ছাড়ের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে৷ জার্মান সংসদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রধান নর্বার্ট ব়্যোটগেন বলেছেন, চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের পথে সংসদকে পথের কাঁটা হিসেবে দূর করে ইইউ-কে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে থাকলে সেই চাপের মুখে নতি স্বীকার করা হবে না৷ এমন হুমকির মুখে ইইউ ব্রেক্সিট চুক্তিতে কোনো রদবদল করবে না৷ তাঁর মতে, ‘‘কোনো সরকার প্রধান সংসদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করলে ইইউ সেই আচরণকে পুরস্কৃত করতে পারে না৷''
দলের মধ্যে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থিদের সহায়তায় নিজের লক্ষ্য পূরণে অবিচল থাকলেও সংসদে বরিস জনসন কতটা সমর্থন পাবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে৷ আগামী সপ্তাহ থেকে বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটসহ অন্যান্য উদ্যোগ শুরু করলে টোরি দলের মধ্যে ঐক্যের পরীক্ষা হবে৷ মাত্র একটি আসনের ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় বিষয়টি জনসনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷ বৃহস্পতিবার স্কটল্যান্ডে টোরি দলের প্রধান হিসেবে রুথ ডেভিডসন পদত্যাগ করায় জনসনের কর্তৃত্ব কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে৷ জনপ্রিয়তার বিচারে ডেভিডসনের বিকল্প পাওয়া কঠিন৷ তাঁর পথ অনুসরণ করে টোরি দলের হাতে গোনা কিছু সংসদ সদস্যও যদি জনসনের সঙ্গ ত্যাগ করেন, সে ক্ষেত্রে তিনি বিপাকে পড়বেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/কেএম (রয়টার্স, এএফপি)