বিশ্বায়নের এই যুগে কি শ্রমিকরা নায্য মজুরি পাচ্ছেন? কেন এখনো তাঁদের দাবি আদায়ে রাজপথে নামতে হচ্ছে? শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সংকট কোথায়? এসব বিষয়েই এবার ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন শ্রমিক নেত্রী ও সংসদ সদস্য শিরিন আক্তার৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসটা যদি একটু ছোট করে বলেন...৷
শিরিন আক্তার: শ্রমিকদের শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস অনেক লম্বা৷ বাংলাদেশের জন্মের আগে, ব্রিটিশ আমলে শ্রম আন্দোলন শুরু হয়৷ সেটা ছিল মূলত রেল ও নৌ শ্রমিকদের আন্দোলন৷ এর পাশাপাশি ছিল পাটকল-সূতাকলের শ্রমিকরা৷ বিশেষ করে আদমজী ও বাওয়ানীর শ্রমিকদের আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে৷ তখন আমরা দেখেছি, আদমজী বা বাওয়ানীর টাকা দিয়ে পশ্চিম পকিস্তানের উন্নতি করা হচ্ছিল৷ আমরা তখন স্লোগান দিতাম, ‘‘পূর্ব বাংলা শাসন কেন?'' রেল-নৌ শ্রমিকদের পাশাপাশি পাটকলের শ্রমিকরা আন্দোলন করেছেন সে সময়৷ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিকদের একটা বিশাল ভূমিকা আছে৷ ১৯৬৬ সালে এই শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে আমরা ছ'দফার আন্দোলন শুরু করেছিলাম৷ ফলে বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
আগের যে শ্রমিক আন্দোলন আর এখনকার শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে তফাৎ কী?
তখনকার কথা বলি, দেশ স্বাধীনের পর আমাদের সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হয়ে যায়৷ ফলে শ্রমিকের অধিকার আইন দ্বারা সুরক্ষা হয়৷ তখন আন্দোলন অনেক জোরালো ভূমিকা রাখে৷ ১৯৮০ বা ৮২ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে আমাদের জাতীয়করণ করা শিল্প-কলকারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণ হতে থাকে৷ একদিকে সামরিক শাসন আর অন্যদিকে বিরাষ্ট্রীয়করণের ফলে শ্রমিক আন্দোলন দূর্বল হতে থাকে৷ শ্রমিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে থাকে, ক্ষুণ্ণ হতে থাকে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারও৷ আগে কিন্তু অনেক বেশি অধিকার ছিল৷ এই পাটকল বা সূতাকল যখন বন্ধ হতে শুরু করল, তখন বাংলাদেশে আরেকটি শিল্পের বিস্তার শুরু হলো৷ সেটা হলো পোশাক শিল্প৷ এই শিল্পের কারণে শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকদের দৃশ্যমানতা দেখা যায়৷ ২০০৬ সালে গার্মেন্টস শিল্প শ্রমিকদের আন্দোলন বিশাল ভূমিকা রাখে৷ আর তখন থেকেই এই শিল্পের শ্রমিকরা বড় একটা জায়গা নিয়ে নেয়৷ এই সেক্টরে ৮০ ভাগ শ্রমিকই কিন্তু নারী৷
‘আন্দোলন ছাড়া দাবি বাস্তায়নের পরিবেশ কখনোই হয়নি’
এখন তো শ্রমিকদের আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে৷ আগেও কি তাই হতো? তাহলে এই দুই আমলের আন্দোলনের মধ্যে তফাৎ কী?
২০০৬ সালে বড় একটা সহিংস আন্দোলন হয়েছিল৷ তবে এরপর আর বড় আন্দোলন হয়নি৷ এর মূল কারণ ট্রেড ইউনিয়নকে স্বীকৃতি না দেয়া, শ্রমিকদের অধিকারকে স্বীকৃতি না দেয়া৷ গার্মেন্ট পুরোপুরি ব্যক্তিখাত ছিল৷ আমরাও তখন চাইনি এখানে কোনো গণ্ডগোল হোক৷ ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে এই সেক্টর বড় কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ুক, আমরা সেটা চাইনি৷ কারণ, এটা একটা বড় কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছিল৷ বিশেষ করে এই খাত নারী শ্রমিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল৷ অবশ্য ট্রেড ইউনিয়ন করতে না দেয়া, কথা বলতে না দেয়ার কারণেই কিন্তু তখন এই ঘটনা ঘটেছিল৷ পরবর্তীতে, ২০১৩ সালে, শ্রমিক-মালিক-সরকার একসঙ্গে বসে আমরা সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি৷
এখন অনেক প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে, আবার অনেক জায়গায় এখনো করতে দিচ্ছে না৷ বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়নের জায়গা কতটা প্রসারিত হয়েছে?
ঐতিহাসিক কয়েকটি শ্রম আন্দোলন
মে দিবসের চেতনা শ্রমিকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মে দিবস পালনের সূচনা হয়৷ ছবিঘরে দেখে নিন বিশ্বের অন্যতম কয়েকটি শ্রম আন্দোলনের কথা৷
ছবি: picture alliance / Tass/dpa
হে মার্কেটের শ্রমিকদের আন্দোলন
১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা নেমেছিলেন তুমুল আন্দোলনে৷ তাঁদের দাবি ছিল, উপযুক্ত মজুরি এবং দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ নয়৷ মে মাসের প্রথম দিনেই শ্রমিকরা ধর্মঘটের আহ্বান জানায়৷ প্রায় তিন লাখ শ্রমিক যোগ দেয় সেই সমাবেশে৷ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের রুখতে মিছিলে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়৷ বহু শ্রমিক হতাহত হন৷
ছবি: picture-alliance/KPA/TopFoto
মে দিবস
পরে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় গ্রেপ্তারকৃত ছয় শ্রমিককে৷ কারাগারে বন্দিদশায় এক শ্রমিক নেতা আত্মহত্যাও করেন৷ পরের বছর প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিনটিকে মে দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস
বর্তমানে মে মাসের প্রথম দিনটিকে পুরো পৃথিবীতে পালন করা হয় ‘মে দিবস’ হিসেবে৷ পৃথিবীর সব শ্রমিকের লড়াই-সংগ্রাম-পরিশ্রমের প্রতি সম্মান জানানো হয় এই দিনে, শ্রদ্ধা জানানো হয় তাঁদের আত্মত্যাগের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশ্যে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. U. Zaman
শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন
অ্যামেরিকা স্বাধীন হওয়ার আগে শ্রমজীবী মানুষের প্রথম সংগঠন গড়ে ওঠে ১৬৮৪ সালে৷ ঠেলাগাড়ির চালকরা প্রথম ঠেলা শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলেন৷ ১৮৪২ সালে অ্যামেরিকায় শ্রমিক শ্রেণি ট্রেড ইউনিয়ন ধর্মঘট করার অধিকার পায়৷ বিশ্বের প্রথম নারী শ্রমিকদের ধর্মঘট পালিত হয় অ্যামেরিকায় ১৮২৩ সালে৷ বিশ্বের শিল্প-কারখানাগুলোয় শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় ১৮২৮ সালে৷
ছবি: M. Cardy/Getty Images
আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংগঠন
ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণি নিজ নিজ দেশে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলে৷ ১৮৬৪ সালে মার্কস- এঙ্গেলসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি৷ ইতিহাসে এটাই প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সংগঠন নামে খ্যাত৷
ছবি: AP
প্যারিস কমিউন
১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ প্যারিসের শ্রমিকরা শহর থেকে বুর্জোয়া শাসকদের হটিয়ে নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নেয়৷ দশ দিন পরে ২৮ মার্চ তারিখে শ্রমিকরা গঠন করেছিল পৃথিবীর প্রথম প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্র প্যারিস কমিউন৷
অক্টোবর বিপ্লব
অক্টোবর বিপ্লবকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত অঞ্চলগুলোয় বলা হয় ‘মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’৷ ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করে, শুরু হয় ‘লাল’ আর ‘সাদা’-দের মধ্যে গৃহযুদ্ধ৷ অক্টোবর বিপ্লবের বিজয় রাশিয়াকে রাজনৈতিকভাবে একটি অগ্রসর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্তি
এই বিপ্লব জনগণকে পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছিল৷ এই বিপ্লব শ্রমিক শ্রেণি ও মেহনতি কৃষকের জন্য শুধু সামাজিক মুক্তিই আনেনি, রাশিয়ার গণতান্ত্রিক সমস্যাগুলোও সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিল৷ লেনিন স্বয়ং ১৯২৪ সালে পরলোকগমন করেন, কিন্তু রুশ বিপ্লব, সোভিয়েত রাশিয়া বা কমিউনিজম, এ সবের সঙ্গে তাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷
ছবি: picture-alliance/akg
তেভাগা আন্দোলন
১৯৩০ সালে বাংলার কয়েকটি জেলায় কৃষকরা তেভাগার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন৷ তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, ভাগচাষিকে ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ দিতে হবে৷ এই আন্দোলনটি ছিল সম্পূর্ণ বর্ণ হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমান ও নমঃশূদ্র চাষিদের অসহযোগ আন্দোলন৷ এ আন্দোলনে জমিদারদের পাইক-বরকন্দাজদের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করতে হয়েছিল কৃষকদের৷ ১৯৪৬ সালেও আর এক দফা আন্দোলন হয়েছিল৷
ছবি: AFP/Getty Images/R. Gacad
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার খনি শ্রমিকদের ওপর নানা নির্যাতন, মজুরি বৃদ্ধি, থাকা-খাওয়া ও জীবনমান উন্নয়ন ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং ১৯৪৬ সালে ৭০ হাজার শ্রমিকের অংশগ্রহণে ধর্মঘট পালিত হয় কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে৷ এএনসি এই আন্দোলনে যোগদানের বিষয়ে নীরব থাকলেও ম্যান্ডেলা পরিচিত কয়েকজনকে নিয়ে কমিউনিস্ট নেতা জেবি মার্কসের সঙ্গে দেখা করে এই আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন৷
ছবি: dapd
জার্মানির শ্রমিক আন্দোলন
১৯৫৩ সালের ১৭ জুন তৎকালীন পূর্ব জার্মানির সরকারের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল শ্রমিকসহ সাধারণ জনগণ৷ বড় কোম্পানিগুলো জাতীয়করণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পূর্ব জার্মান সরকার, যার প্রতিবাদে ১৬ জুন থেকে আন্দোলন শুরু করেছিল কয়েকশ’ শ্রমিক৷ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় ৭০০ শহরে৷ ১৭ জুন আন্দোলন থেকে সরকারের পদত্যাগ, স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠান ও দুই জার্মানির একত্রীকরণের দাবি ওঠে৷ সেনাদের গুলিতে নিহত হয় ৫০ জন৷
ছবি: Getty Images
শ্রমিক বিক্ষোভে উত্তাল ইউরোপ
স্পেন ও পর্তুগালে ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর বুধবার পালিত হয়েছিল সাধারণ ধর্মঘট৷ কর্মবিরতি পালন করেছিলেন গ্রিস ও ইটালির শ্রমিকরা৷ এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানায় বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ডসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো৷ এতে বিভিন্ন দেশের শিল্প-কারখানা অচল হয়ে পড়ে৷ বাতিল হয় ইউরোপের অনেক ফ্লাইট৷ চার দেশে একযোগে ধর্মঘট পালনের ঘটনা ইউরোপে এটিই প্রথম৷
ছবি: Reuters
ফ্রান্সে শ্রমিক আন্দোলন ২০১৬
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ফ্রান্সে সর্ববৃহৎ শ্রমিক বিদ্রোহ দেখা গিয়েছে ২০১৬ সালে৷ শ্রম আইন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে অসন্তোষের জের ধরে জেনারেল কনফেডারেশন অব লেবার (সিজিটি) ইউনিয়নের ডাকে ধর্মঘটে ফ্রান্সের প্রায় সব বিভাগের শ্রমিকরাই অংশ নিয়েছিলেন৷ এ ধর্মঘটের একপর্যায়ে প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসেন৷ তাদের সঙ্গে শামিল হয় ছাত্র ও তরুণরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সর্বভারতীয় সাধারণ ধর্মঘট
হয়েছিল ১৯৮২ সালের ১৯শে জানুয়ারি সেই ধর্মঘট ছিল বৃহৎ, ঐতিহাসিক এবং সবদিক দিয়ে সফল৷ পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরালায় সর্বাত্মক বন্ধ পালিত হয়েছিল৷
ছবি: Reuters/D. Siddiqui
ভারতে শ্রমিক বিক্ষোভ
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৮ হাজার রুপি করা এবং শিল্প-কারখানার বেসরকারিকরণ ঠেকানোসহ ১৪ দফা দাবিতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট পালন করেন সেবা খাতের লাখ লাখ শ্রমিক৷ ১৫ কোটির বেশি শ্রমিক এ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন বলে সংগঠনগুলোর দাবি৷
ছবি: AP
15 ছবি1 | 15
অনেকটাই প্রসারিত হয়েছে৷ তবে আমি মনে করি, শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নের ব্যাপারে সচেতনতা আরো বৃদ্ধি করতে হবে৷ আবার মালিকদের মধ্যে স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের ব্যাপারে যে অনিচ্ছা, সেটা বাদ দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দিতে হবে৷ একটা হলো মালিকের ট্রেড ইউনিয়ন গড়া আর আরেকটা হলো শ্রমিকের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন গড়া৷ এই দু'টোর মধ্যে তফাৎ আছে৷ এখন স্বীকৃতি দেয়ার ফলে অনেকগুলো ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হয়েছে ঠিকই, তবে কারখানার ফ্লোরে শ্রমিক প্রতিনিধিদের স্বাভাবিকভাবে কাজ করা এবং তাঁদের দাবিনামা পেশ করার সুযোগ দেয়ার ব্যাপারে আমাদের এখনো অনেক কাজ করতে হবে৷ ভবিষ্যতে একটি নতুন মজুরি কাঠামো হবে, এ ব্যাপারে কমিটি হয়েছে৷ দু-একটি মিটিংয়ে তারা বসেছে ইতিমধ্যেই৷ তারা ১৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দাবি করেছে৷ এখন এটা নিয়ে সরকার-মালিক-শ্রমিক সবার মনোনিবেশ করতে হবে, যাতে এগুলোকে কেন্দ্র করে কোনো সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়৷ এবার আলোচনার মাধ্যমে সুন্দর সুচিন্তিত মজুরিকাঠামো তৈরি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি৷
বাংলাদেশে এখন শ্রমিকরা যে মজুরি পাচ্ছেন, সেটা কি যৌক্তিক?
অবশ্যই যৌক্তিক না৷ অনেক কম মজুরি পান তাঁরা৷ সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে কম মজুরি পায় আমাদের শ্রমিকরা৷ এটা বাড়াতে হবে৷ আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশের দিকে এগোচ্ছি৷ তাই এখন বেশি করে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে৷
শিল্প প্রতিষ্ঠানে তো নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, তাই না?
শুধু শিল্প প্রতিষ্ঠান না, সংগঠিত বা অসংগঠিত ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ এখন প্রায় সমান সমান৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশিও৷
নারী শ্রমিকদের মজুরি আমরা কতটা নিশ্চিত করতে পারছি?
মজুরি এখনো অনেক কম পাচ্ছেন নারীরা৷ কোথাও অর্ধেক পাচ্ছেন, কোথাও এক তৃতীয়াংশ পাচ্ছেন৷ তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সমান সমান পাচ্ছেন৷ গার্মেন্টসেও ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে সমান পাচ্ছেন৷ যেমন ধরুন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে মেয়েরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পাচ্ছেন ছ'মাস৷ কিন্তু শিল্প প্রতিষ্ঠানে পাচ্ছেন চার মাস৷ অনেক প্রতিষ্ঠানে তো মাতৃত্বকালীন কোনো ছুটিই নেই৷ এটা একটা বড় বৈষম্য৷
আন্দোলন ছাড়া কি কখনও শ্রমিকদের দাবি বাস্তবায়ন হয়েছে?
নতুন কোনো দাবি আন্দোলন ছাড়া বাস্তায়নের পরিবেশ কখনোই হয়নি৷ তবে মজুরি বৃদ্ধি বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দরকষাকষির মাধ্যমে সমাধান হয়েছে৷ এক্ষেত্রে আমাদের কৃষি শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে৷ কৃষি শ্রমিকদের কিছুদিন আগে শ্রম আইনে শ্রমিক হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে৷ মজুরি প্রশ্নেও আমরা দেখেছি, যেখানে নারীদের সচেতন করা গেছে সেখানে তাঁরা পুরুষের পাশাপাশি আন্দোলন করে সফল হয়েছেন৷
আপনি তো সংসদ সদস্য ,আবার শ্রমিক নেতাও, আপনারা তো সরকারের সঙ্গে শ্রমিকদের সেতুবন্ধনে ভূমিকা রাখতে পারেন...
আমরা তো সেই কাজটাই করি৷ আমরা চেষ্টা করি সংসদে এই বিষয়গুলো উত্থাপন করতে৷ শ্রম আইন বাস্তবায়নের জন্য সংসদীয় কমিটিতে আমরা আলাপ-আলোচনা করি৷ সংসদে তো শ্রমিক নেতা কম৷ যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন৷ কিন্তু অনেকেই মালিকদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কাজ করে থাকেন৷ ফলে সেখানে একটা সংকট আছে৷
শ্রমিকদের দাবি বাস্তবায়নে এখনো কেন রাস্তায় নামতে হয়?
রাস্তায় নামতেই হবে৷ যতক্ষণ পর্যন্ত শ্রমিকবান্ধব আইন ও প্রশাসন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রাস্তায় নামতেই হবে৷ এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই৷ জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ন্যূনতম মজুরি রয়েছে৷ ভারতের অনেক রাজ্যেও রয়েছে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি৷ ফলে সেই লড়াইটা হচ্ছে৷ এই যে আমরা আনন্দের সঙ্গে বলি, বছরের শুরুতে ৩৫ কোটি বই আমরা দিচ্ছি, এই বইগুলো যাঁরা বাধাঁই করেন, তাঁদের ন্যূনতম মজুরি আমরা ঠিক করতে পারিনি৷ এমন অনেকগুলো বিষয় আছে৷ আসলে আইন আছে৷ কিন্তু সেই আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যাঁদের কাজ করবার কথা, তাঁরা সঠিকভাবে কাজ করছেন না৷ অন্যদিক শ্রমিকরাও সচেতন না৷ কীভাবে এই আইন বাস্তবায়ন করতে হবে, তাঁরা সেটা জানেন না৷ ফলে সেখানে তাঁদের প্রশিক্ষণ খুব জরুরি৷
শ্রমিকদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
সচেতন হও, সংগঠিত হও, রুখে দাঁড়াও৷ নিজের অধিকার নিজে আদায় করে নাও৷
নিজেদের অধিকার সম্পর্কে শ্রমজীবী মানুষদের কথা
বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খেটে খাওয়া মানুষরা পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রম অধিকার থেকে৷ কয়েকটি ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের অধিকারসচেতনতা এবং এ প্রসঙ্গে তাঁদের মতামত জেনে নিন এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ঝর্ণা আক্তার, পোশাক শ্রমিক
শ্রম অধিকার বলতে আমার কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়াকে বুঝি, কিন্তু সেটা আমি পাই না৷ মাসে বেতন পাই ছয় হাজার টাকা, ওভার টাইম নিয়ে সেটা নয় হাজার টাকার মতো হয়৷ এই টাকা দিয়ে বহু কষ্টে খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি৷ অনেক সময় বেতন বকেয়া রেখেই চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মুকুলি বেগম, গৃহকর্মী
শ্রম অধিকার কী জিনিস তা বুঝি না৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে যাই৷ সপ্তাহে কোনো ছুটির দিন নেই৷ ছোটখাট অসুখ-বিসুখ হলেও কাজে যেতে হয়৷ এর বাইরে পদে পদে খারাপ ব্যবহার পেতে হয় বাড়ির মালিকের কাছ থেকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ রিপন, নির্মাণ শ্রমিক
শ্রম অধিকার বুঝি না৷ দিন শেষে পারিশ্রমিক পেলেই খুশি৷ সপ্তাহে সাতদিনই কাজ করি৷ কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ নূরুদ্দিন, দিনমজুর
শ্রম অধিকার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই৷ সারাদিন খেটে ৩০০-৪০০ টাকা পাই৷ এ টাকা একটু বাড়লে ভালো৷ এই বাজারে এই টাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাশেদ, বাস চালক
শ্রম অধিকার নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই৷ দিনে ১৬ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাই৷ মালিকের টার্গেট পূরণ হওয়ার পর যা পাই, সেটা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
জসিম উদ্দীন, বাসের হেলপার
শ্রম অধিকার হলো কাজের সঠিক পারিশ্রমিক পাওয়া৷ সেটা আমি পাই না৷ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা কাজ করি৷ সপ্তাহে একদিনও ছুটি পাই না৷ বাড়ি গেলে কাজ ছেড়ে যেতে হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
আসাদুল, রিকশা-ভ্যান চালক
শ্রম অধিকার কী বুঝি না৷ কাজ করলে টাকা পাই, না করলে পাই না৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মোহাম্মদ রাজু, অটো রিকশা চালক
শ্রম অধিকার হলো আমার কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়া৷ আমি সেটা পাই না৷ গাড়ির মালিকের জমা, পুলিশের অযথা হয়রানি, পথে পথে যাত্রীদের দুর্ব্যবহার – এ সব নিয়েই দিন চলে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
সোহেল হাওলাদার, রিকশা চালক
আমাদের আবার অধিকার কী? মানুষ আমাদের মানুষই মনে করে না৷ সবাই ভাড়া কম দিতে চায়৷ অনেক যাত্রীই খারাপ ব্যবহার করে, অনেকে গায়ে হাত তোলে৷ কিন্তু আমাদের কথা বলার কোনো জায়গা নেই৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বাবলু মিয়া, রং মিস্ত্রী
শ্রম অধিকার কী জিনিস বুঝি না৷ কাজ শেষে টাকা পেলেই খুশি৷ সেটা পাইও৷ তবে অনেক ঝুঁকি নিয়ে বড় বড় বিল্ডিংয়ে কাজ করি৷ কোনো রকম দুর্ঘটনা হলে কোথাও থেকে কোনো সাহায্য পাই না৷ কাজ না থাকলে না খেয়ে থাকতে হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
10 ছবি1 | 10
বাংলাদেশে শ্রমিকবান্ধব আইন ও প্রশাসন কি আছে? মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷