ইউরোপীয় ইউনিয়ন অভিমুখে উদ্বাস্তুর স্রোত একটি সুবিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ শুধু প্রশাসনিক বা আর্থিক চ্যালেঞ্জই নয়, এর ফলে ইউরোপীয়দের তাদের মহাদেশের প্রতি মনোভাবই প্রভাবিত হবে, বলে গ্রেহাম লুকাসের ধারণা৷
বিজ্ঞাপন
" রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বের মুখ্য এলাকাগুলির মধ্যে পড়ে৷
" ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলি এই নীতিতে বিশ্বাস করে যে, যারা গৃহযুদ্ধ বা রাজনৈতিক নিপীড়নের সম্মুখীন হচ্ছেন, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া উচিত৷
" কিন্তু ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা যে পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে, তা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে৷ এ বছর প্রায় দশ লক্ষ উদ্বাস্তু ইউরোপে আসবেন, বলে অনুমান করা হচ্ছে৷
" সকলে এই উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নন৷ অভিবাসন বিরোধী গোষ্ঠীরা জার্মানিতে উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন অভ্যর্থনা কেন্দ্র ও আবাসনে অগ্নিসংযোগ করেছে৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল স্বয়ং একটি উদ্বাস্তু আবাসন পরিদর্শন করতে গিয়ে চরম দক্ষিণপন্থি বিক্ষোভকারীদের রোষের পাত্র হয়েছেন৷
ইউরোপে শরণার্থী সংকট চরমে
অস্ট্রিয়ার মোটরওয়েতে পরিত্যক্ত হিমায়ন যুক্ত ট্রাকটি থেকে এ যাবৎ ৭০টির বেশি লাশ পাওয়া গিয়েছে; লিবিয়ার উপকূলে আবার নৌকাডুবি হয়ে উদ্বাস্তুদের মৃত্যু৷ কিন্তু ইউরোপ এখনও বিভক্ত, দ্বিধাগ্রস্ত৷
ছবি: DW/E. Numanovic
অভিবাসীর মৃত্যু
হাঙ্গেরি থেকে ভিয়েনাগামী মোটরওয়েতে বৃহস্পতিবার ফেলে রাখা অবস্থায় যে রেফ্রিজারেটেড ট্রাকটি পাওয়া যায়, তা থেকে ৭০টির বেশি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, বলে ভিয়েনার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে৷
ছবি: Reuters/H.P. Bader
সলিলসমাধি
লিবিয়ার উপকূল থেকে ইটালি পৌঁছনোর প্রচেষ্টায় আরো একটি উদ্বাস্তু বোট ডুবে যায় বৃহস্পতিবার৷ বোটটি পশ্চিম লিবিয়ার জুওয়ারা বন্দর থেকে যাত্রা করছিল৷ লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা দু’শোর বেশি যাত্রীকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন, কিন্তু আরো দু’শতাধিক যাত্রী জাহাজের খোলে আটকা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ বোটটিতে প্রধানত সাব-সাহারান আফ্রিকা, পাকিস্তান, সিরিয়া, মরক্কো ও বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীরা ছিলেন৷
ছবি: Reuters/H. Amara
যাত্রী বোঝাই
লিবিয়ার উপকূলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্ধারকার্যের দায়িত্বে রয়েছে ইটালির উপকূলরক্ষী বাহিনী৷ তাদের বিবৃতি অনুযায়ী শুধুমাত্র বৃহস্পতিবারেই প্রায় ১,৪৩০ জন মানুষকে বিভিন্ন নৌ-অভিযানে উদ্ধার করা হয়৷ লিবিয়ার উপকূলরক্ষী বাহিনীর সামর্থ্য সীমিত, কেননা তাদের কাছে ছোট ছোট রবারের বোট, টাগবোট কিংবা মাছ ধরার নৌকা ছাড়া অন্য কোনো জলযান নেই৷
ছবি: Reuters/Swedish Coast Guard
কাঁটাতারের বেড়া
পাকানো কাঁটাতার ফেলে রেখে আর বিপুল সংখ্যায় পুলিশ পাঠিয়ে বুদাপেস্ট সরকার উদ্বাস্তুর স্রোত সামাল দেবার চেষ্টা করছেন৷ সার্বিয়ার সঙ্গে ১৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে একটি চার মিটার উঁচু তারের বেড়া তৈরির কাজ আগামী সোমবার শেষ হবার কথা৷ তার আগে উদ্বাস্তুরা কাঁটাতার পেরিয়ে অভীপ্স পশ্চিম ইউরোপ অভিমুখে আরো এক ধাপ অগ্রসর হবার চেষ্টা করছেন৷
ছবি: Reuters/L. Balogh
সীমান্তের পর সীমান্ত
বিশেষ করে সিরীয় উদ্বাস্তুরা গ্রিস থেকে ম্যাসিডোনিয়া হয়ে পশ্চিম ইউরোপ যাবার চেষ্টা করছেন৷ শুধুমাত্র বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার অবধি ১,২৮৮ জন উদ্বাস্তু এ ভাবে ম্যাসিডোনিয়ায় আসেন বলে স্কোপিয়ে সরকার জানিয়েছেন৷ উদ্বাস্তুদের নথিভুক্ত করে তিন দিন সময় দেওয়া হচ্ছে, রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন পেশ করার কিংবা দেশ ছাড়ার জন্য৷
ছবি: Annette Groth
হাঁটাপথে
সার্বিয়া থেকে হাঙ্গেরি-তে ঢোকার আর কোনো পথ খোলা না থাকুক, রেলপথ তো রয়েছে! সেই পথেই পায়ে হেঁটে স্বপ্নের ইউরোপের দিকে চলেছেন উদ্বাস্তুরা৷
ছবি: Reuters/L. Balogh
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘‘ব্যর্থতা’’
বৃহস্পতিবার ভিয়েনায় পশ্চিম বলকান সংক্রান্ত সম্মেলনে নেতারা ট্রাকে উদ্বাস্তুদের লাশ পাবার ঘটনা শুনে স্তম্ভিত ও বিমূঢ় হয়ে যান৷ ‘‘আমাদের ইউরোপীয় মনোবৃত্তি, অর্থাৎ সংহতির মনোভাব নিয়ে শীঘ্র এই অভিবাসন প্রশ্নের সমাধান করতে হবে’’, বলেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল (বাম থেকে দ্বিতীয়)৷
ছবি: DW/E. Numanovic
7 ছবি1 | 7
" উদ্বাস্তুদের সঙ্গে উগ্র ইসলামপন্থিরাও ইউরোপে ঢুকবে, এই শঙ্কা ইউরোপ জুড়ে অভিবাসন বিরোধী মনোবৃত্তিকে উসকানি দিচ্ছে৷ সেই শঙ্কার কথা মনে রেখে জঙ্গি ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে আরো কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে৷
" অপরদিকে ইউরোপীয় নেতৃবর্গকে মনে রাখতে হবে যে, বাস্তবিক শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়াটা একটা নৈতিক কর্তব্য৷
" তার একটা সুবিধাও আছে৷ ইউরোপের জনসংখ্যা কমছে, যার ফলে মহাদেশের অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব ক্ষুণ্ণ হতে পারে৷
" তবে বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তু আসার ফলে ইউরোপকে শীঘ্র সিদ্ধান্ত নিতে হবে, শরণার্থীদের মধ্যে কে রাজনৈতিক আশ্রয় পাবার উপযোগী এবং কে নয়৷
" তথাকথিত নিরাপদ, অর্থাৎ ঝুঁকিবিহীন দেশ থেকে যারা এসেছেন, তাদের শীঘ্র ফেরৎ পাঠাতে হবে৷
" অপরদিকে যারা ইরাক, সিরিয়া অথবা আফগানিস্তানের মতো গৃহযুদ্ধ পীড়িত দেশ থেকে আসছেন, তাদের যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে, কেননা তাদের শীঘ্র স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নেই৷ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুরের প্রক্রিয়া চলাকালীন বছরের পর বছর উদ্বাস্তুদের রিফিউজি ক্যাম্পে আটকে রাখার কোনো মানে হয় না৷
" সবচেয়ে বড় কথা, তাদের যথাশীঘ্র ওয়ার্ক পারমিট দেয়া উচিত৷
" অ্যামেরিকা তথা পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন জরিপ থেকে দেখা গেছে, যে সব উদ্বাস্তুরা অভিবাসী হওয়ার সুযোগ পান, তারা কর এবং স্বাস্থ্যবীমা, অবসরভাতা ইত্যাদির অনুদানের মাধ্যমে সে'দেশের অর্থনীতি ও প্রশাসনে একটা বড় অবদান রাখেন৷
ওরা সবাই জার্মানি আসতে চায়
প্রাণ বাঁচাতে কিংবা আরও উন্নত জীবনের আশায় যাঁরা ইউরোপে আসার চেষ্টা করছেন তাঁদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য জার্মানি৷ ডয়চে ভেলে এমন ছয়জনের কথা জানাচ্ছে যাঁরা জার্মানি আসতে চান৷
ছবি: Reuters/O. Teofilovski
মোহাম্মদ, সিরিয়া
কুর্দি এই মানুষটি সিরিয়ায় ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন৷ ম্যাসিডোনিয়ার এক রেল স্টেশনে তাঁর সঙ্গে কথা হয় ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদকের৷ তাঁকে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘‘আচ্ছা, জার্মানিতে যাওয়ার পর কি ইংরেজিতে কাজ করা যাবে?’’
ছবি: Nemanja Rujevic
জামান, মরক্কো
হাসিখুশি এই মানুষটি গ্রিসে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই চার বছর কাটিয়েছেন৷ কিন্তু এখন তিনি জার্মানি যেতে চান৷ কারণ গ্রিসের পুলিশ নাকি বর্ণবাদী৷ জার্মানিতে পৌঁছে তিনি সৎভাবে জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখছেন৷
ছবি: Nemanja Rujevic
আহমেদ, ইরাক
বেলগ্রেডে ডয়চে ভেলের প্রতিবেদককে ১৭ বছরের এই তরুণ জানান, ইরাকে ইসলামিক স্টেট অনেক বড় সমস্যা তৈরি করছে৷ যাকেই পাচ্ছে তাকেই হত্যা করছে তারা৷ তাই তিনি জার্মানি যেতে চান৷ কারণ সেখানে তিনি নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারবেন বলে আশা করছেন৷ বেলগ্রেড আসার পথে বুলগেরিয়ায় তিনি পুলিশের প্রহারের শিকার হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন৷
ছবি: Nemanja Rujevic
মোহাম্মদ, আফগানিস্তান
বর্তমানে বেলগ্রেডের একটি সেবাকেন্দ্রে আছেন দুই সন্তানের জনক মোহাম্মদ৷ পরিবারের সবাইকে নিয়ে তুরস্ক থেকে গ্রিস পৌঁছাতে পাচারকারীকে অর্থ দিয়েছিলেন তিনি৷ যে নৌকায় করে তাঁরা গ্রিস যাচ্ছিলেন সেটি ডুবে যায়৷ প্রায় এক ঘণ্টা পর তাঁদের উদ্ধার করে তুরস্কের কোস্টগার্ডের সদস্যরা৷
ছবি: Nemanja Rujevic
মিলাদ, সিরিয়া
২৭ বছরের এই তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের লক্ষ্য জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে পৌঁছানো৷ কারণ সেখানে তাঁর আত্মীয়স্বজন থাকেন৷ কথা বলার সময় তিনি সার্বিয়ার এক শহরে এক ‘পাকিস্তানির’ জন্য অপেক্ষা করছিলেন যাকে তিনি সাড়ে চার হাজার ইউরো দিয়েছেন৷ এর মাধ্যমে মিলাদ তাঁর বাবা-মা সহ সার্বিয়া ও হাঙ্গেরির সীমান্ত পার হতে চান৷
ছবি: Nemanja Rujevic
ফালাত, আফগানিস্তান
২৫ বছরের এই যুবক তাঁর দেশ সম্পর্কে বলেন, ‘‘খারাপ অবস্থা, প্রতিদিন যুদ্ধ৷’’ মিলাদের মতো তিনিও সার্বিয়ার এক শহরে পাচারকারীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন যার মাধ্যমে তিনি জার্মানি পৌঁছাতে চান৷ এজন্য তিনি পাচারকারীকে ৫ হাজার ইউরো দিয়েছেন৷ হাঙ্গেরি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া প্রসঙ্গে তিবি বলেন, ‘‘সমস্যা নেই৷ যে করেই হোক আমরা জার্মানি পৌঁছাবোই৷ জার্মানি ভালো দেশ, যারা শরণার্থীদের গ্রহণ করছে৷’’