হঠাৎ করে বেড়ে গেছে শিশু ধর্ষণ৷ আসলেই কি বেড়েছে? নাকি খবরগুলো বেশি করে প্রচার পাচ্ছে? যদি বেড়েই থাকে তাহলে প্রতিকার কি? আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এই বিকৃত যৌনাচার নিয়ে কি করছে?
বিজ্ঞাপন
এসব নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম৷
ডয়চে ভেলে : হঠাৎ করে বিকৃত যৌনচারের কিছু ঘটনা সামনে আসছে, এর কারণ কী? এটা কি বেড়েছে? না-কি খবরগুলো বেশি করে প্রচার পাচ্ছে?
শেখ নাজমুল আলম : ঠিকই বলেছেন৷ বেশ কিছুদিন শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা আমাদের সামনে আসছে৷ এসব ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আমরাও শিউরে উঠছি৷ এই ধরনের অপরাধ আগেও ছিল, এখনও আছে৷ আমাদের ফেসবুক, প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার কারণে এই খবরগুলো দ্রুত আমাদের সামনে আসছে৷ সামাজিক অবক্ষয় ও নানাবিধ কারণে এই ধরনের অপরাধগুলো আগের থেকে একটু বেড়েছে৷
‘এই ধরনের অপরাধ আগেও ছিল, এখনও আছে’
নারীদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কি কমে যাচ্ছে?
দেখেন, ধর্ষণ আদিমকাল থেকে আছে৷ ভবিষ্যতেও বাড়বে বা কমবে৷ আগে শিশুদের ব্যাপারে এই হার এত বেশি ছিল না৷ নারীদের সচেতনতা বেড়েছে৷ আগের চেয়ে শিক্ষিতের হার বেড়েছে৷ ফলে এই ধরনের অপরাধীরা বয়স্ক নারীদের চেয়ে শিশুদের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে৷ কারণ শিশুদের প্রতি এই অপরাধ করতে গেলে বাধা বিঘ্ন কম আসে৷ এবং সহজেই তারা এই অপরাধটি করতে পারে৷
এই বর্বরতা থেকে শিশুদের রক্ষা করা যাচ্ছে না, প্রতিকার কী?
সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে৷ ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ ৫০টি থানাকে ৩০০ বিটে ভাগ করেছে৷ প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি বিটে উঠান বৈঠক হয়৷ সেখানে নারী নির্যাতন, বাল্য বিবাহ, জঙ্গিবাদ, মাদক নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে থাকি৷ প্রতি মাসেই আমাদের পুলিশ হেড কোয়ার্টার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলে প্রতিটি মামলার অগ্রগতি জানাতে হয়৷ এই ধরনের ঘটনার তদন্ত করে আমরা দ্রুত চার্জশিট দাখিল করি৷ এগুলোর যদি দ্রুত বিচার হয় এবং মানুষ যদি দেখে অপরাধীর বিচার হচ্ছে তাহলেও অপরাধ কমে আসবে৷ বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা ও অপরাধীর জামিনে বের হয়ে আসার কারণে মানুষের কাছে বিচারের প্রতি অনাস্থা তৈরী হচ্ছে৷ পুলিশের কাজ আসামী গ্রেফতার করে বিচারে সোপর্দ করা৷ চাঞ্চল্যকর ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা অতি দ্রুত সেই কাজটি করছি৷ এরপর বিচার হবে৷ সেখানেও সাক্ষীদের হাজির করা পুলিশের দায়িত্ব৷ দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অপরাধটা হয়তো কিছুটা কমতে পারে৷
যৌন লালসার বিকৃত রূপ
পাঁচ-ছয় বছরের শিশু থেকে শত বছরের বৃদ্ধা, কেউ বাদ যাননি ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে৷ ঘর, গণপরিবহন আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- সব জায়গাতেই ঘটেছে এসব ঘটনা৷ ছবিঘরে দেখে নিন যৌন লালসার এমন বিকৃত রূপের চিত্র৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mannan
লালসার শিকার ছয় বছরের সায়মা
রাজধানীর ওয়ারীতে প্রতিবেশীর ফ্ল্যাটে খেলতে গিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে ছয় বছরের শিশু আফরিন সায়মা৷ সম্প্রতি এই ঘটনা ব্যাপক আলোচনা ও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে৷ ধর্ষককে গ্রেপ্তারের পর তার বাবার আবেগধর্মী বক্তব্যে আলোড়িত হয়েছেন সবাই৷
এমন ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, নিজের প্রতিবেশও কতোটা অনিরাপদ নারী ও শিশুর জন্য৷
ছবি: bdnews24.com
১২ ছাত্রীর ধর্ষক মাদ্রাসা অধ্যক্ষ
নারায়ণগঞ্জে ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আল আমিন৷ গ্রেপ্তার আল আমিন ১২ ছাত্রীকে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে র্যাব৷
ছবি: bdnews24.com
শত বছরের বৃদ্ধাকে ধর্ষণ!
মে মাসে টাঙ্গাইলে শত বছর বয়সি অন্ধ বৃদ্ধাকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে ১৫ বছর বয়সি এক কিশোরের বিরুদ্ধে৷ ওই কিশোর বৃদ্ধার ঘরে ঢুকে মুখ বেঁধে তাঁকে ধর্ষণ করেছে বলে জানায় পুলিশ৷ গ্রেফতার কিশোর সোহেল ধর্ষণের অভিযোগ স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ৷
আগুনে পুড়ল নুসরাত
ফেনীতে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার জেরে আগুনে পুড়তে হলো নুসরাত জাহান রাফিকে৷ অধ্যক্ষের পক্ষ নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ কয়েকজন ওই কাণ্ড ঘটায়৷ নুসরাতকে হত্যার আগে নিপীড়ক অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে মানববন্ধনও হতে দেখা গেছে৷ নারায়ণগঞ্জ আর ফেনীর ঘটনা প্রকাশ করছে, ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও অনিরাপদ নারীরা৷
ছবি: picture-alliance/M. Rashid
রাজনীতির বিরোধে ধর্ষণ!
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ভোটের রাতে ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়৷ এরপর নোয়াখালীতেই আরেকটি ভোট কেন্দ্র করে ছয় সন্তানের জননীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে৷ ধর্ষণে রাজনীতির সংযোগ নারীর জন্য সমাজকে ঝুঁকিপূর্ণই করছে৷ এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধর্ষণের ঘটনায় ব্যাপক প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ছয় মাসে ভিকটিম ৩৯৯ শিশু
মানবাধিকার সংগঠন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৩৯৯ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে৷ এর মধ্যে আটজন ছেলে শিশু রয়েছে৷ ধর্ষণের পর ১৫জন মেয়ে শিশু ও এক ছেলে শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে৷ অন্যদিকে, ছয় মাসে ৬৩০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য৷
ছবি: Bilderbox
পাঁচ মাসে ৩০০ মামলা
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে সারা দেশে শিশু ধর্ষণের মামলা হয়েছে ৩০০-এর কিছু বেশি৷ আর গত পাঁচ বছরে মোট শিশু ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৩ হাজারের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
কিনারা হয়নি তনু হত্যার
কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্ত তিন বছরেও শেষ হয়নি৷ তনুর পরিবারের অভিযোগ, স্থবির হয়ে আছে তদন্তকাজ৷ ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ ঘটনার সঙ্গে সেনাসদস্যরা জড়িত বলে অভিযোগ তনুর পরিবারের৷
ছবি: Twitter
আলোচিত রূপা হত্যা
২০১৭ সালের আগস্টে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে কলেজছাত্রী জাকিয়া সুলতানা রূপাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়৷ ওই মামলায় চারজনকে ফাঁসি ও একজনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
ক্রসফায়ার কি সমাধান?
ধর্ষককে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে৷ ধর্ষককে ক্রসফায়ারে পক্ষে রাস্তায় দাঁড়াতেও দেখা গেছে৷ এমনকি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে একাধিকবার ধর্ষককে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যার কথা বলেছিলেন জাতীয় পার্টির সংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ৷ আইনের শাসনের প্রতি আস্থাহীনতার প্রমাণ হিসাবে দেখা দিয়েছে এসব ঘটনা৷
ছবি: Getty Images/N. Seelam
10 ছবি1 | 10
সমাজে ধর্ষণের ঘটনা হঠাৎ বাড়ল কেন?
১৭ কোটি মানুষের একটি ছোট্ট দেশ৷ এখানে ঢাকা শহরে কোন অপরাধ হলে আমরা দ্রুত জানতে পারি৷ গ্রামগঞ্জে এমন অপরাধ অহরহ হচ্ছে৷ সেটা বেশি প্রচার পায় না৷ আমাদের সমাজবিজ্ঞানীদের এগুলো নিয়ে রিসার্স করার সময় এসেছে৷ সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে, কিছু মামলার রায় দ্রুত হলে অপরাধ কমে আসতে পারে৷ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে দ্রুত এই বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে৷ শিশুদের উপর যারা এই ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে তারা মানসিক রোগী৷ আর মাদকসেবীদের মধ্যেও এই ধরনের প্রবণতা আমরা দেখছি৷
বিকৃত যৌনাচার নিয়ে পুলিশ কি কোন কাজ করছে? আর আইনগত কোনো সমস্যা আছে?
এখানে কোন আইনগত সমস্যা নেই৷ কয়েকদিন আগে ওয়ারীতে একটি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷ পরদিনই আমরা আসামীকে গ্রেফতার করেছি৷ সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে৷ এখন মেডিকেল রিপোর্ট পেলেই আমরা চার্জশিট দেব৷ এখানে আমরা আমাদের কাজটি সাফল্যের সঙ্গে শেষ করেছি৷ এই মামলাটির যদি দ্রুত বিচার হয় তাহলে মানুষের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি পাবে৷
এটা প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নাকি সচেতনতা কোনটা দরকার?
এই ধরনের অপরাধ যদি আমরা কমাতে চাই তাহলে সচেতনতা বাড়াতেই হবে৷ পাশাপাশি আইনের প্রয়োগ ও দ্রুত বিচার- এই তিনটি কাজই একসঙ্গে করতে হবে৷ তাহলে হয়ত এই অপরাধ কমতে পারে, তা না হলে সম্ভব না৷