যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি স্থগিতের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে শাস্তি হিসেবে বিবেচনা না করে বরং সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে৷ সঠিক সময়ে যদি তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিশ্চিত করা যায় তাহলে জিএসপি ফিরে আসবে৷
বিজ্ঞাপন
শাস্তি নয়, জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে বাংলাদেশকে শ্রম পরিবেশ উন্নয়নে একটি সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে জিএসপি স্থগিতের একদিন পর জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ শুক্রবার মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র প্যাট্রিক ভেনট্রেল এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে একথা জানান৷ সেই সঙ্গে শ্রম পরিবেশ ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে বলেও জানান তিনি৷
বাংলাদেশের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদও মনে করেন তাই৷ তাঁর মতে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের মালিক এবং সরকারে উচিত এখন সময়কে কাজে লাগান৷ যে প্রক্রিয়া সরকার এবং গার্মেন্টস মালিকরা শুরু করেছেন, তা অব্যাহত থাকলে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং অধিকার নিশ্চিত হবে৷
তিনি মনে করেন, আর তা নিশ্চিত করা গেলে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে৷ তখন বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে৷
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
নাজনীন বলেন, ক্রেতাদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে বাংলাদেশের পোশাক মালিকদের৷ কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের কারণে ইউরোপ এবং অন্যান্য যে সব দেশ বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকে জিএসপি সুবিধা দেয় তারা তা বাতিল করলে সেখানে পোশাকের দাম বেড়ে যাবে৷ সেখানকার ভোক্তারা বাড়তি দামে পোশাক কিনতে পারবেন কিনা সেটা তখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেবে৷ তাই ক্রেতাদের সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার অবস্থার উন্নতি করতে হবে৷ সেখানে মুনাফা ছাড় দেয়ার প্রশ্নও উঠবে৷ এই ছাড় শুধু বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকরা নয় বিদেশি ক্রেতাদেরও দিতে হবে৷ কম দামে পোশাক চাইলে লাভও কম করতে হবে৷
বাংলাদেশে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগ আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে৷ বছরে গড়ে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানির মাধ্যমে আয় করে ২২ থেকে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ জিডিপিতে তৈরি পোশাকের অবদান শতকরা ১০ ভাগ৷ আর গবেষণায় দেখা গেছে পোশাক খাতে কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বছরে খরচ হয় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার৷
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘পোশাক কারখানার মালিকরা মাত্র এক বছর তাদের মুনাফা আংশিক ছাড় দিলেই পোশাক কারখানার চোহারা বদলে যাবে৷''
তিনি জানান, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন অনেক পোশাক কারাখানা আছে৷ আর সেই কারখানাগুলো ব্যবসাও ভাল করে৷ মালিকরা এই বিষয়টি মাথায় রাখলেই বুঝতে পারবেন যে শেষ পর্যন্ত ভাল কারখানাই টিকে থাকে৷ এর জন্য প্রয়োজন মুনাফা কম করে শ্রমিকদের নিয়মিত বেতন বোনাস দেয়া৷ তাদের সঙ্গে ভাল আচরণ করা৷
ড. নাজনীন মনে করেন, বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত পোশাক শিল্পের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে৷ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ সব শর্ত পূরণ করেই সবচেয়ে কমদামে পোশাক সরবরাহ করতে পারবে৷ আর কারুর পক্ষে তা সম্ভব হবেনা৷ তবে সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে৷ আর এখনই সময় পোশাক শিল্পের কর্ম পরিবেশ উন্নয়নের৷