সত্যজিৎ তো স্পেশাল, তবে এখনো ভালো ছবি হচ্ছে: শর্মিলা ঠাকুর
শময়িতা চক্রবর্তী
১৫ মে ২০২৫
খুব ভালো চরিত্র না পেলে শর্মিলা ঠাকুর এখন আর সিনেমা করতে চান না । ডিডাব্লিউর সঙ্গে তার ভাবনার কথা জানালেন শর্মিলা ।
সেরকম ব্যতিক্রমী কোনো চরিত্র না পেলে আর সিনেমায় অভিনয় করতে চান না শর্মিলা ঠাকুর। ছবি: picture-alliance/dpa/Rana Sajid Hussain/Pacific Press
বিজ্ঞাপন
৭৮তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এবার রেড কার্পেটে হাঁটবেন শর্মিলা ঠাকুর। ১৯ মে স্যাল বুন্যুল প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হবে সত্যজিৎ রায়ের ১৯৭০-এর ছবি, অরণ্যের দিনরাত্রি। সেই উপলক্ষ্যেই শর্মিলা ঠাকুর. সিমি গারেওয়ালসহ এই ছবির সঙ্গে যুক্ত অন্যান্যরা রেড কার্পেটে হাঁটবেন। ফরাসি রিভিয়েরাতে রওয়ানা দেওয়ার আগে ডিডাব্লিউএর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে শর্মিলা জানালেন তার অরণ্যের দিনরাত্রির কথা, বাংলা সিনেমা নিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা এবং প্রিয় মাণিকদার কথা।
সত্যজিতের নায়িকা
১৯৫৯-এ অপুর সংসার দিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যাত্রা শুরু শর্মিলার। অরণ্যের দিনরাত্রির আগে দেবী এবং নায়কে অভিনয় করেছেন। তার পর সীমাবদ্ধ। নিজের চরিত্র নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শর্মিলা বলেন, "অপর্ণার চরিত্র নিয়ে আমি খুবই খুশি ছিলাম। মাণিকদা আমাকে সবময়েই খুব ভালো চরিত্র দিয়েছেন। নায়কে আমার চরিত্রটা বিবেকের মতো। এটাতেও মোটামুটি তাই। যদিও অপর্না খুবই মডার্ন লুকিং এবং তার কাপড় জামা আধুনিক। কিন্তু যেভাবে কথা না বলে অসীমকে (সৌমিত্র) তিনি তার বক্তব্য বোঝালেন সেটা খুবই পরিণত। অপর্না অসীমকে কিন্তু অপমান করেননি। কিন্তু বুঝিয়ে দিলেন যে তার দম্ভটা ঠিক নয়। কিছু না বলেই বললেন, "কীসের দম্ভ তোমার?" চরিত্রের সেই ম্যাচিওরিটিটা মাণিকদা তৈরি করেছিলেন। ওনার চরিত্রগুলিতে অভিনয় করতে এত ভালো লাগে। নায়ক আবার একদম আলাদা। দেবীও আলাদা।"
নায়কের শুটিং শুরুর আগে পরিচালক সত্যজিৎ রায়কে শর্মিলা ঠাকুর জিজ্ঞেস করেন তার চশমা দূরের দৃষ্টির জন্য, না কাছের জন্য? সেই স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শর্মিলা জানান যে তার কথা শুনে পরিচালক খুব হেসে ফেলেছিলেন। "মাণিকদা বলেছিলেন, 'তুমি ঠিক করে নাও।'" শর্মিলা জানিয়েছেন, সত্যজিৎ চরিত্র সম্পর্কে কোনো ব্রিফ দিতেন না। অভিনেত্রী বলেন, "বেশি করে বোঝাতেন না। একবার বলে দিতেন। অপুর সংসারের সময় আমি ফ্রক পরে গেছিলাম। মঙ্কুদি (বিজয়া রায়) আমাকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। চুল বেঁধে টিপ পরিয়ে দিলেন। আমাকে দেখতে অনেকটাই বদলে গেল। ১৩ বছর থেকে আমাকে ১৬/১৭ বছরের দেখালো। মানিকদা আমাকে জিজ্ঞাসাও করলেন আমি বাংলা বলি কিনা। আমি বললাম, 'নিশ্চয়ই বলি।' আমাকে বুঝিয়ে দিলেন আমার চরিত্রটা সদ্য বিয়ে করে বাবা মাকে ছেড়ে শহরে এসেছে। দ্যাটস ইট। ওটাই একমাত্র ইন্সট্রাকশান। আর কিছু বলেননি।"
শর্মিলা জানান পরিচালক সত্যজিৎ কখনোই খুব বেশি বোঝাতেন না। তিনি বলেন, "অরণ্যের দিনরাত্রিতে যে ছেলেটি বাচ্চা ছেলেটির চরিত্রে অভিনয় করেছিল তার সঙ্গে মাণিকদা মোড়ায় বসে, চোখে চোখ মিলিয়ে কিছু একটা বলতেন। এটা একান্তই ওর সঙ্গে মাণিকদার কথপোকথন। আমাদের শোনার বাইরে। বাচ্চাদের থেকে খুব ভালো অভিনয় উনি পেতেন। বাচ্চারা ভাবত মাণিকদা ওদের বন্ধু। সমবয়সী। আমাদের বেশি বোঝাতেন না। একবার স্ক্রিপ্ট পড়ে দিতেন। আর বলতেন, তোমরা ডায়লগ মনে রেখো না। সিনগুলো বুঝিয়ে দিতেন। কোথা থেকে কোথায় যাব, কখন কথা বলব এসব বলে দিতেন।"
সত্যজিৎ রায়: শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ
জন্ম ১৯২১ সালের ২ মে। মৃত্যু ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে এই মহান স্রষ্টাকে ডিডাব্লিউর শ্রদ্ধার্ঘ।
ছবি: Faget/AFP/Getty Images
সত্যজিতের পরিবার
ঠাকুর্দা উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী। শিশু সাহিত্যিক, চিত্রকর, বাংলা ছাপখানার পুরোধা, সুরকার। বাবা সুকুমার রায় ছিলেন শিশুসাহিত্যিক ও বাংলায় ননসেন্স ছড়া, কবিতা ও গদ্যের জনক। কাকা সুবিনয় বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। পিসি সুখলতা রাও ও পুণ্যলতা চক্রবর্তী শিশু সাহিত্যিক। সত্যজিতের বয়স যখন দুই বছর চার মাস, তখন সুকুমার মারা যান।
ছবি: DW/P. Samanta
স্কুল ও কলেজ
সত্যজিতের পৈত্রিক আদিবাড়ি ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের মসুয়া গ্রামে। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর থাকতেন কলকাতায় গড়পারে। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সত্যজিৎ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের গড়পারের বাড়িতে। তারপর মায়ের সঙ্গে চলে আসেন মামাবাড়ি ভবানীপুরে। সেখানে থেকেই সাড়ে আট বছর বয়সে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ভর্তি হন। স্কুল শেষ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইকনমিক্স নিয়ে পড়া।
ছবি: DW/Prabhakar Mani Tewari
রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন
সুকুমার রায়কে অসম্ভব ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। সত্যজিৎ মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে পৌষমেলায় যান বছর দশেক বয়সে। রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে আসেন অটোগ্রাফের খাতা। রবীন্দ্রনাথ তাতে লিখে দেন আট লাইনের বিখ্যাত কবিতা 'বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে..'। কলেজের পরে মায়ের জোরাজুরিতে শান্তিনিকেতনে পড়তে যান। সেখানে নন্দলাল ও বিনোদবিহারীর সান্নিধ্য ভারতীয় চিত্রকলা সম্পর্কে তার চোখ খুলে দেয়।
ছবি: picture-alliance/dpa
চাকরির সূত্র ধরে
১৯৪৩ সালে শান্তিনেকতন থেকে কলকাতা এসে তিনি চাকরি নেন ব্রিটেনের বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমার-এ। জুনিয়ার ভিসুয়ালাইজার। বেতন ৮০ টাকা। কিন্তু পরে তিনি যোগ দেন সিগনেট প্রেসে, যেখানে তার কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। বিভূতিভূষণের 'আম আঁটির ভেপু'-র অলঙ্করণ করতে গিয়ে তিনি আকৃষ্ট হন পথের পাঁচালির প্রতি। ঠিক করেন, সিনেমা করলে প্রথম ছবি হবে পথের পাঁচালি'।
ছবি: Ronald Grant Archive/Mary Evans/picture-alliance
রেনোয়ার সঙ্গে পরিচয়
বন্ধু চিদানন্দ দাশগুপ্তের সঙ্গে সত্যজিৎ তৈরি করেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। প্রচুর বিদেশি ছবি দেখার সুযোগ হয় তার। ১৯৪৯ সালে রেনোয়া কলকাতায় আসেন তার 'দ্য রিভার' শুটিং করার জন্য। সত্যজিতের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। রেনোয়ার সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হন সত্যজিৎ। ঝোঁকেন পরিচালনার দিকে। পরে 'বাইসাইকেল থিফ' দেখার পর সিদ্ধান্ত নেন পরিচালক হবেন। উপরের ছবিতে রেনোয়া ডানদিকে।
ছবি: AFP/Getty Images
কেন পথের পাঁচালি
১৯৫৭ সালে অমৃত বাজারে একটা লেখায় সত্যজিৎ লিখেছিলেন, ''আমায় হামেশাই এই প্রশ্ন শুনতে হয়, কেন পথের পাঁচালি? সত্যি ও সহজ উত্তর হলো, বাংলা উপন্যাসের মধ্যে এটই সিনেমা করার সব চেয়ে উপযুক্ত বই।'' সত্যজিতের মতে, ''অনেকে অভিযোগ করেন, আমার সিনেমায় ছবি ও ডকুমেন্টারির দিকটা বেশি। আমার জবাব, দুইটিই আমি বিভূতিভূষণের কাছ থেকে পেয়েছি।''
ছবি: Faget/AFP/Getty Images
পথের পাঁচালি তৈরির গল্প
প্রায় তিন বছর ধরে তৈরি হয়েছিল পথের পাঁচালি। কারণ অর্থাভাব। ১৯৫২ সালের শেষদিকে সত্যজিৎ নিজের জমানো টাকা দিয়ে শুরু করেন পথের পাঁচালি তৈরির কাজ। সঙ্গে আনকোরা ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র ও শিল্প নির্দেশক বংশীচন্দ্র গুপ্ত। যখন অর্থ জোগাড় করতে পারতেন, তখনই শুটিং হতো। অবশেষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্যে ১৯৫৫ সালে পথের পাঁচালি তৈরি শেষ হয়। উপরের ছবিটি বোড়াল গ্রামের, যেখানে পথের পাঁচালির শুটিং হয়।
ছবি: DW/P. Samanta
শুধু ইতিহাস
পথের পাঁচালির দৌলতে ভারতের চলচ্চিত্র চলে গেল বিশ্বের আঙিনায়। সারা বিশ্ব জানলো, বাংলা ভাষায় বিশ্বমানের সিনেমা তৈরি করেছেন ছয় ফুটের উপর লম্বা এক বাঙালি পরিচালক। আর ভারতীয় সিনেমায় আইকন হয়ে গেল একটা দৃশ্য, মাঠের উপর দিয়ে কাশবনের পাশ দিয়ে ছুটছে অপু ও দুর্গা ট্রেন দেখবে বলে। অবশেষে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন আসা। ভাই-বোনের অবাক চোখে ট্রেন দেখা। এই সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রবিশঙ্কর।
ছবি: Harper Collins/Ray Society
আন্তর্জাতিক সম্মান
পথের পাঁচালি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অসংখ্য অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। ১৯৫৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল, রোমে ভ্যাটিকান পুরস্কার, ম্যানিলায় গোল্ডেন কারবাও, বার্লিনে গোল্ডেন লরেল। তাছাড়া এডিনবরা, নিউ ইয়র্ক, স্টুটগার্ট, স্যান ফ্র্যান্সিসকো সহ অনেক উৎসবে পুরস্কার পায় পথের পাঁচালি।
ছবি: AFP
অপরাজিত ও অপুর সংসার
দুই বছর পর সত্যজিৎ করলেন পথের পাঁচালির পরের পর্ব 'অপরাজিত'। ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পেল এই ছবি। সত্যজিৎ প্রথমে ট্রিলজির কথা ভাবেননি। ভেনিসে এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এই ভাবনা আসে। তার ফসল 'অপুর সংসার'। বড় অপুর ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপর্ণার ভূমিকায় এলেন শর্মিলা ঠাকুর। সত্যজিতের সিনেমায় সব চেয়ে বেশি অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন সৌমিত্র।
ছবি: Everett Collection/picture alliance
জলসাঘর, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা
এই তিনটি ছবিই সত্যজিৎ করেছিলেন ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে। তিনটি তিন ধরনের ছবি। জলসাঘরের পড়ন্ত জমিদার, দেবীতে কুসংস্কারগ্রস্ত শ্বশুর যিনি তার পুত্রবধূর পুজো করেন কালী-জ্ঞানে এবং কাঞ্চনজঙ্ঘায় উচ্চবিত্ত পরিবারের কর্তা। কাঞ্চনজঙ্ঘার পরিচালক ও প্রযোজক এবং লেখক সত্যজিৎ রায়। উপরের ছবিটি দেবীর।
ছবি: Everett Collection/picture alliance
চারুলতা
রবীন্দ্রনাথের নষ্টনীড় উপন্যাস সত্যজিতের হাতে হলো চারুলতা। উনিশ শতকের এক বাঙালি বউয়ের নিঃসঙ্গতা ও তার ঠাকুরপো অমলের সঙ্গে সম্পর্কের কাহিনি। চারুলতার ভূমিকায় মাধবী এবং অমল হলেন সৌমিত্র। সত্যজিৎ বলেছেন, চারুলতায় তিনি সব চেয়ে কম ভুল করেছেন। আবার বানাতে হলে ঠিক ওইভাবেই বানাতেন।
ছবি: Everett Collection/picture alliance
নায়ক
মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে মাত্র দুইটি সিনেমা করেছেন সত্যজিৎ। নায়ক এবং চিড়িয়াখানা। অনেকের মতে, নায়কেই জীবনের সেরা অভিনয় করেছিলেন উত্তম। এক সিনেমার নায়কের এক দিনরাতের কাহিনি। তার আশা, আকাঙ্খা, ভয়, উদ্বেগ, ভাবনার গল্প। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অন্য ধারার অনবদ্য ছবি। এখানে উত্তম কুমারকে কোনো মেক আপ নিতে দেননি সত্যজিৎ।
ছবি: RDB Entertainments
গুগাবাবা
ঠাকুর্দার লেখা, নাতির পরিচালনায় সিনেমা। গুপী গায়েন বাঘা বায়েন। ছোটদের জন্য সত্যজিতের মজার ছবি। তার সব চেয়ে হিট ছবি। এরপরের পর্বে তিনি 'হীরক রাজার দেশে' করেছিলেন। যার ছত্রে ছত্রে রয়েছে স্বৈরচারী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে রঙ্গব্যাঙ্গের কষাঘাত।
ছবি: DW/P. Samanta
হিন্দিতে সত্যজিৎ
সত্যজিৎ বাংলাতে ছবি তৈরি করতে পছন্দ করতেন। তার পছন্দের শহর ছিল কলকাতা। চিরজীবন কলকাতার ভাড়াবাড়িতে কাটিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি হিন্দিতে একটি সিনেমা ও একটি টিভির জন্য ছোট ছবি করেছিলেন। দুইটিই মুন্সি প্রেমচন্দ্রের কাহিনি। সতরঞ্জ কি খিলাড়ি এবং সদগতি। উপরের ছবিতে কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাঙালির পোশাকে সত্যজিৎ।
ছবি: RALPH GATTI/AFP
ফেলুদাকে নিয়ে
নিজের লেখা গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদাকে নিয়ে দুইটি সিনেমা করেছেন সত্যজিৎ। সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ। বাংলা সিনেমায় গোয়েন্দা কাহিনি কেমন করে করা যায়, তা তিনি দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। তবে সন্তোষ দত্ত মারা যাওয়ার পর তিনি ফেলুদার সিনেমা আর করেননি। সত্যজিৎ চলে যাওয়ার পর কবীর সুমন ফেলুদার গান লেখেন, জটায়ুকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন সত্যজিৎ।
ছবি: DW/P. Samanta
শেষ পর্ব
ঘরে বাইরে ছবি করার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হন সত্যজিৎ। তার পরের নয় বছর অনেক কম কাজ করেছেন। সেটাও ছেলে সন্দীপের সহযোগিতায়। এরপর গণশত্রু, শাখা প্রশাখা ও আগন্তুক। তখন তিনি আউটডোরে বেশি যেতে পারেন না। স্টুডিওর সেট নির্ভর সিনেমা। তাই কিছু দুর্বলতা ছিল। কিন্তু বিষয় বৈচিত্রে শেষ দুইটি ছবিতে দেখা গেছে প্রতিবাদী সত্যজিৎকে। উপরে ছবিতে বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ি, যেখানে থাকতেন সত্যজিৎ।
ছবি: DW/P. Samanta
লেখক সত্যজিৎ
তার ফেলুদা ও শঙ্কু চরিত্র বাঙালি ছেলেমেয়েদের কাছে অন্যতম প্রিয় চরিত্র। তিনি সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘকাল। সেখানে প্রচুর লিখেছেন। তার লেখা গল্প বিষয়বৈচিত্রে অনন্য। তাছাড়া সিনেমা নিয়ে প্রচুর লেখালিখি করেছেন।
ছবি: DW/P. Samanta
অস্কার
মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি হিসাবে অস্কার পান সত্যজিৎ রায়। পেযেছেন ভারতে সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নও। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি প্রয়াত হন।
উপরের ছবিতে সত্যজিৎকে শ্রদ্ধার্ঘ পুত্র সন্দীপের।
ছবি: DW/P. Samanta
19 ছবি1 | 19
অরণ্যের দিনগুলি
অরণ্যের দিনরাত্রির শুটিং হয় পালামৌ- এর কাছে। শর্মিলা বলেন, সেই সময় খুবই গরম ছিল ওখানে। "আমরা খুব কম বাজেটে ছবি করতাম। এই ছবির শুটিংয়ের সময় খুব গরম ছিল। আমরা বেশি সময় পেতাম না। সকালে দুই-তিন ঘণ্টা আর বিকেলে দুই-তিন ঘণ্টা শুটিং হতো। কম সময় ছিল। কম বাজেট ছিল। তার মধ্যেই মানিকদা খুব মেপে মেপে ছবি করতেন। এয়ার কন্ডিশান ছিল না তখন। কোথাও ছিল না।"
তবে শুটিং-এর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শর্মিলা বলেন, সেই সময় তারা খুবই ভালো সময় কাটিয়েছেন। তিনি জানান, "আমরা খুব আড্ডা মারতাম কারণ দুপুরে আমাদের কোনও কাজ ছিল না। রবিদা, সমিত, শুভেন্দু, সৌমিত্র -- সবাই আড্ডা মারতাম। বংশীদাও (শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত) চলে আসতেন। আমরা বনের মধ্যে সাঁওতাল গ্রামে যেতাম গান শুনতে। নাচও করতাম ওদের সঙ্গে। আড্ডা মারতাম। অপূর্ব ছিল সেই দিনগুলো।"
আজকের মূলধারার ছবিতে গ্রাম-শহরের সেতু তৈরি হয়না বলে মনে করেন শর্মিলা। "কোথাও নেই। গৌতম ঘোষ 'পার' বানালেন। তখন গ্রামের ছবি উঠে এসেছে। এখন তো শহরের গল্পই হয় বেশিরভাগ।"
বড় পর্দার ম্যাজিক
সম্প্রতি সত্যজিতের মহানগর এবং নায়ক রিস্টোর করে বড় পর্দায় মুক্তি পেয়েছে। শর্মিলার আশা, অরণ্যের দিনরাত্রির নতুন প্রিন্ট এদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে। বড়পর্দায় দেখা যাবে। তিনি বলেন, "ছবি ছোট পর্দায় দেখা যায় না। মানে, নিশ্চয়ই হয়তো দেখা যায়। কেউ কেউ উপভোগও করেন। তবে বড় পর্দার মজাই অন্যরকম। বড় পর্দায় দেখব বলে আমি খুবই উত্তেজিত।"
সত্যজিতের পাঁচটি ছবিতে অভিনয় করেছেন শর্মিলা। স্বাভাবিক কারণেই পরিচালকের গুণমুগ্ধ এই অভিনেত্রী। অরণ্যের দিনরাত্রি প্রসঙ্গে শর্মিলা বলেন, "কী রোম্যান্টিক ছিল আমার আর সৌমিত্রর দৃশ্যগুলো! কী সুন্দর! নায়কের একাধিক দৃশ্যও অপূর্ব।"
আজকের ছবিতে কি সেই সংবেদনশীলতা দেখতে পাওয়া যায়? শর্মিলা বলেন, "হচ্ছে তো ভাল ছবি। আমাদের আগের ছবিটি (সুমন ঘোষের পুরাতন) খুব সংবেদনশীল। খুব ভালো সংলাপ। আমি সব বাংলা ছবির কথা বলতে পারব না। তবে যা দেখেছি তা তো ভালোই লেগেছে। মানিকদার মতো অত ভালো হতে পারে না। উনি খুবই স্পেশাল।"
সত্যজিতের ছবির নানা দৃশ্যাংশ এখন ইন্সটাগ্রামের মতো সোশাল মিডিয়ায় রিলসের মাধ্যমে জনপ্রিয় হচ্ছে। শর্মিলা বলেন, "গ্রামের ধারণাই তো আসতে আসতে মুছে যাচ্ছে। এখন তো কেবলই শহর। আমরা যে গ্রাম দেখেছি তা খোঁজার জন্য অনেক দূর যেতে হয়। এখন সবার কাছে টিভি আছে, মোবাইল ফোন আছে। ওটিটিতে ছবি দেখেন মানুষ। তবে যে ছবি বড় পর্দার জন্য বানানো তা বড় পর্দাতেই দেখতে ভালো লাগে। ছোট স্ক্রিনে সেই আনন্দ পাওয়া মুশকিল। তবে নিঃসন্দেশে অনেক বেশি সুবিধাজনক। অত দূরে গিয়ে টিকিট কেটে একবারে বসে অতখানি সময় দেওয়া খুব সহজ নয়।"
সুমন ঘোষের পুরাতনের পরে কি আর বাংলা ছবি করবেন না শর্মিলা? জানালেন, তিনি অবসর গ্রহণের কথা ভেবেছেন। অভিনেত্রী জানান, "শুধু বাংলা ছবির কথা বলিনি। আমি বলেছি আমি আর কোনো ছবিই করব না। আমার আর শরীরে কুলোচ্ছে না। তবে যদি তেমন ভালো স্ক্রিপ্ট হয় আর যদি তারা আমার স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য বিষয়ের কথা খেয়াল রাখে তাহলে করতে পারি। আমি এখন ক্লান্ত হয়ে যাই। বাংলা ছবি তো করতেই পারি। তবে খুব ভালো চরিত্র পেতে হবে। নাহলে আমার কোনো উৎসাহ নেই।"
ওয়েস অ্যান্ডারসনকে কৃতজ্ঞতা
অরণ্যের দিনরাত্রি রিস্টোর হওয়ায় খুবই খুশি শর্মিলা। তিনি বলেন, "আমি খুবই খুশি এতদিন পরে ছবিটা রিস্টোর করা হয়েছে। যারা রিস্টোর করেছেন তাদের প্রতি আমার অনেক কৃতজ্ঞতা। রিস্টোর না করলে পুরনো ছবিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। শব্দ, দৃশ্য সব খারাপ হয়ে যায়। ছবিটি আর দেখতে ভালো লাগে না।" পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসন প্রসঙ্গে বলেন, "উনি মাণিকদার খুবই ভক্ত। উনিও এই রেস্টোরেশানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। উনি যদি বিষয়টাকে এভাবে না দেখতেন তাহলে এই ছবিটা কানে দেখানো হয়ত সম্ভব হত না।"
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের উপর ১৯৭০-এ নির্মিত এই ছবিটিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, রবি ঘোষ, সমিত ভঞ্জ, সিমি গারেওয়াল, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, কাবেরি বসুসহ অন্যান্যরা। ১৯৭০-এর বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বিয়ারে মনোনীত হয় ছবিটি। শর্মিলা বার্লিনে যাননি। কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চে ছবিটির প্রশংসা দেখেছেন। তিনি বলেন, "আমি বার্লিনে যাইনি। কিন্তু আমি এই ছবির সঙ্গে যেখানে গেছি সেখানেই লোকেদের এই ছবি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে দেখেছি। আমার মনে হয়ে কলকাতার দর্শকদের থেকে এই ছবিটা বাইরের লোকেরা বেশি ভালো বুঝেছেন। যখনি রবিদা (ঘোষ) স্ক্রিনে আসতেন সবাই হাততালি দিতেন। উনি কিন্তু সকলের ফেভারিট ছিলেন।"