‘সদিচ্ছা থাকলে নারী কমিশনের সব সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব'
২৫ এপ্রিল ২০২৫
বাতিল দাবির যৌক্তিকতাসহ সংস্কার প্রস্তাবের নানা দিক নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক।
ডয়চে ভেলে : নারী সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব?
শিরীন পারভিন হক : বর্তমান ও পরবর্তী সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে, তাহলে সবগুলোই বাস্তবায়ন সম্ভব। আমাদের সুপারিশগুলোকে তিনটা ভাগে ভাগ করে দিয়েছি। যেগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সম্ভব, সেগুলোকে নিয়ে একটা গুচ্ছ করেছি। দ্বিতীয় গুচ্ছ করেছি, পরবর্তী যে নির্বাচিত সরকার, সেটা ৫ বছরের জন্য হোক বা যতদিনের জন্যই হোক, তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে। এটা আমরা আশা করি। আর তৃতীয় গুচ্ছ হলো নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের, অর্থাৎ, গত ৫০ বছরের বা ৫৩ বছরের যে আকাঙ্খা, যে আকুতি বা স্বপ্ন, সেগুলোকে আমরা একত্রিত করেছি। এগুলো আমার জীবদ্দশায় দেখে যাবো বলে মনে হয় না। কিন্তু একদিন না একদিন হবে।
কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে বাধা কোথায়?
বাধা একটাই- সেটা সদিচ্ছা। সদিচ্ছা যদি থাকে, তাহলে তো কোনো বাধা নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়ত বলা হতে পারে যে, অত বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব না। অর্থায়ন নিয়ে কেউ কথা বলতে পারেন। কিন্তু আমরা যে সুপারিশ করেছি, সেখানে যে অনেক অর্থ লাগবে, তেমন না।
কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ কী?
কতগুলো সুপারিশ আছে, সেগুলো নিয়ে এখনই কথা-বার্তা হচ্ছে। অনেক সমালোচনা হচ্ছে। আমরা সেটার জন্য প্রস্তুত। আমরা জানতাম, আমাদের সব সুপারিশ সবাই সাদরে গ্রহণ করবে না। সবাই একমত হবে না, দ্বিমত হবে। আমরা চেয়েছি, আমাদের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হোক, সমালোচনা হোক, বিতর্ক হোক। কারণ, এই ইস্যুগুলোকে আলোচনার জন্য কেউই সামনে নিয়ে আসছে না। আমরা মনে করি, এই যে আলোচনা হচ্ছে, সমালোচনা হচ্ছে, বিরোধিতা হচ্ছে এটাও এক ধরনের সুস্থ চর্চা। যেটা আমরা গত ১৫ বছরের সরকারের আমলে নির্দ্বিধায় বলতে পারিনি। মুখ খুলতে পারি নাই। সেই চর্চাটা এখন হচ্ছে। এখন যারা বিরোধিতা করছে, তাদেরও যুক্তি আছে। তাদের একটা বিশ্বাসের জায়গা থেকে তারা বিরোধিতা করছে। আমরা সেই বিশ্বাসে আঘাত করতে চাই না। আমরা সেজন্য বলেছি, কতগুলো জিনিস হবে ঐচ্ছিক। যে ধর্মমতে বিয়ে করতে চায় বা ধর্মমতে বিচ্ছেদ ঘটাতে চায়, ধর্মমতে সন্তানের অধিকার রাখতে চায় সেগুলো তার ব্যাপার। যে ধর্মমতে করতে চায়, করুক। সেটা মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ ধর্ম হোক। কিন্তু আমরা বলছি যেটা, যে ধর্মমতে করতে চাই না, বরং নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ভিত্তিতে বিবাহের চুক্তিতে যেতে চায়, তাদের কী হবে? সেজন্য আমরা বলছি, তাদের জন্য একটা ঐচ্ছিক বিধান রাখা বা সিভিল অপশন রাখা। যেটা কোনো ধর্ম দ্বারা পরিচালিত হবে না। কিন্তু নারী-পুরুষের সমতার যে নীতি, সেই নীতির উপর দাঁড়িয়েই একটা ব্যবস্থা করা হোক।
অনেকেই বলছেন, কিছু সুপারিশ আপনারা করেছেন আলোচনায় আনার জন্য। এমন কিছু কি আছে?
শুধু কিছু না, সব সুপারিশই তো আমরা করেছি, আলোচনায় আনার জন্য। আমাদের ৪৩৩টা প্রস্তাব, সবগুলোই আলোচনার জন্য। আলোচনা ছাড়া তো হবে না, আলোচনা তো হবেই। শুধু আলোচনা কেন, সমালোচনা হবে, বিতর্ক হবে, তর্ক হবে- এটাই তো স্বাভাবিক।
ধর্মীয় দলগুলোর বাধা কিভাবে মোকাবিলা করা যেতে পারে? ইতিমধ্যে তো ধর্মীয় দল থেকে প্রতিবাদ এসেছে?
হ্যাঁ, আমরা দেখেছি। এটা আসা তো স্বাভাবিক। এটাতে আমরা আশ্চার্য হইনি। তারা তাদের বিশ্বাসের জায়গা থেকে বিরোধিতা করছে। করুক। তাদের তো সেই স্বাধীনতা আছে। তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। এটা তো আর স্বৈরাচারি বন্দোবস্ত না। সুতারাং, তাদের অধিকার আছে বিরোধিতা করার, তারা করুক। আমাদের অধিকার আছে, আমাদের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে বলার। আমরা বলেছি। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, সরকার সেটা কিভাবে মোকাবেলা করবে, সেটা সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আপনাদের সুপারিশ পিছিয়ে পড়া নারীদের ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হতে পারে?
অনেক। পিছিয়ে পড়া, বা পিছিয়ে রাখা নারীদের জন্য অনেক রকমের সুপারিশ আছে। সামাজিক অঙ্গনের সুপারিশ আছে, অর্থনৈতিক অঙ্গনের সুপারিশ আছে, রাজনৈতিক অঙ্গনের সুপারিশ আছে। আমরা চাই তৃণমূলের নারীর কন্ঠস্বর যেন জাতীয় পর্যায়ে আসে। সেজন্য আমরা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছি। আমরা পিছিয়ে পড়া বা পিছিয়ে রাখা নারীদের আর্থিক উপার্জন আরো কিভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে সে ধরনের সুপারিশ রেখেছি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা কিভাবে আরেকটু শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে সেইসব সুপারিশ আছে। এই ধরনের অনেক সুপারিশ আছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল হচ্ছে এই কমিশনগুলো। সেজন্য বৈষম্যটাকেই আমরা প্রাধান্য দিয়েছি। যেখানে যেখানে নারীর প্রতি বৈষম্য আছে, আমরা সেগুলোর বিলুপ্তি চেয়েছি। বৈষম্যের শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে তৃণমূলের নারী।
স্বাধীনতার এত বছর পরও কেন নারী-পুরুষের সমতা বা নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে?
এটাই হচ্ছে সবচেয়ে দুঃখজনক যে, এখনো আমাদের এগুলো নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। আমরা তো আন্দোলন করছি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে, মহিলা পরিষদ আন্দোলন করছে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। তারপরও তো বলতে হচ্ছে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী আছে? তার মানে, এ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক সরকার বা অরাজনৈতিক সরকার কেউই সাহস করে এগুলো নিয়ে সামনে আসেনি। হয় সাহসের অভাবে, না হয় এটাকে প্রাধান্য দেয়নি, অবহেলা করেছে। এই দুটোর একটা বা এই দুইটা মিলে একটা। জানি না আমি কোনটা। তবে অবশ্যই কেউ এগুলো নিয়ে মোকাবেলা করতে চাইনি।
উন্নত দেশগুলোর নারীদের চেয়ে আমাদের দেশের নারীরা কোথায় পিছিয়ে? বা আদৌ কি পিছিয়ে?
আমি কোনোদিনও এই ধরনের তুলনা করিনি। আমরা অন্য কোথায় কী হচ্ছে সেটা নিয়ে চিন্তা করিনি। আমরা চিন্তা করেছি, আমার দেশে আমাদের নারীরা কিভাবে আগাবে, কিভাবে সমতা হতে পারে এবং কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, নিগ্রহ, নিপীড়ন বন্ধ হতে পারে।
এমন কিছু কি আছে যেগুলো রিপোর্টে আপনারা উল্লেখ করতে পারেননি বা পরে মনে হয়েছে উল্লেখ করা উচিৎ ছিল?
না, এখন পর্যন্ত সেটা মনে হয়নি। সামনের সপ্তাহে রিভিউ মিটিং আছে, তখন আমরা এগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।