‘ঘর নাই, খাবার নাই, ঈদ হবে কীভাবে?’
২ সেপ্টেম্বর ২০১৭বাংলাদেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের চৈতার খামার গ্রাম৷ ধরলা নদীর তীরে এই গ্রামের মোটামুটি সম্পন্ন কৃষক মোহাম্মদ ইব্রাহিম৷ ছয় বিঘা কৃষি জমি ছাড়াও তাঁর নিজের বাড়ি ছিল৷ গত ঈদ উল-আজহায় কোরবানি দিয়েছেন৷ কিন্তু এবার তিনি নিঃস্ব৷ কোরবানি তো দূরের কথা, সামনের সংকট কীভাবে সামাল দেবেন সেই চিন্তায় দিশেহারা তিনি৷ ‘‘আমার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি না৷ ওরা তো আর বোঝে না৷ গতবারও গরু কোরবানি দিয়েছি৷ এবার তো ঘরে খাবারই নাই৷ কোরবানি দেব কীভাবে?'' আহাজারি ইব্রাহিমের৷
তিনি জানালেন যে, তাঁর জমির সব ফসল ভেসে গেছে৷ এতদিন বাঁধের ওপর ছিলেন৷ পানি কমার পর ফিরেছেন বাড়িতে৷ কিন্তু ভাঙা ঘর মেরামত করতে পারছেন না৷ জমিতে নতুন ফসল বুনতে বীজ লাগবে, সেটা কেনার টাকা নেই৷ ধার দেনা করে দু'মুঠো খাবার জোগাড় করছেন৷ কিন্তু সরকারের কোনো সহায়তা নেই৷ অনেকে ধারও দিতে চায় না৷ কেননা তাঁর মতো অনেক মানুষই বন্যায় সব হারিয়েছে৷ কত মানুষকে আর ধার দেবে তারা! ইব্রাহিমের কাছ থেকে জানা গেল তাঁদের গ্রামের শতাধিক পরিবার বন্যায় নিঃস্ব হয়ে গেছে৷ এখানে ঈদের আনন্দ নাই৷ আছে কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস৷
ঘোগাদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান শাহ আলম জানালেন, ‘‘বন্যায় এই এলাকার চরম ক্ষতি হয়েছে৷ অনেক অবস্থাপন্ন পরিবারও পথে বসে গেছে৷ আমরা আমাদের সাধ্যমত তাদের সহায়তার চেষ্টা করছি৷ সরকারও কিছু ত্রাণ সামগ্রী দিয়েছে৷ তবে যে ক্ষতি হয়েছে, এই সামান্য সহায়তা তার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল৷ অনেক পরিবারেই এবার ঈদের আনন্দ নেই৷''
উত্তরের আরেক জেলা নীলফমারীর ডিমলা উপজেলার ধানিসেন চরের হামিদুল ইসলাম এখনো বাঁধের ওপর বসবাস করছেন৷ বন্যায় ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ায় সেই যে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন পরিবার পরিজন নিয়ে এখনো সেখানেই থাকতে হচ্ছে তাঁকে৷ বললেন, ‘‘পানি কমে গেছে৷ কিন্তু ফিরবো কোথায়? বাড়ি-ঘর তো আর নাই৷ বাঁধের ওপর কত দিন থাকতে হবে তাও জানি না৷ ঘর তুলবো তার জন্য টাকা কোথায় পাব?''
কোরবানির কথা জিজ্ঞেস করতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠেন, ‘‘খাবারই জুটছে না, আবার কোরবানি! এই বাঁধে প্রায় ৫০টি পরিবার আমরা৷ আমাদের কেউ খোঁজও নেয় না৷ চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দেখা নাই৷ ঈদ যে এসেছে, তা-ও আমাদের মাথায় নাই৷''
হামিদুল ছোটখাট ব্যবসা করতেন৷ বন্যায় সেই ব্যবসাও বন্ধ৷ দোকান ঘরটিও বন্যায় ভেসে গেছে৷ বললেন, ‘‘পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোই ছিলাম৷ কিন্তু এখন সামনে শুধু অন্ধকার দেখছি৷ কোরবানির মাংস এবার আমাদের কপালে নাই৷ সন্তানরাও বুঝে গেছে৷ তাই ওরাও কিছু বলে না৷''
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে ৩০শে আগস্ট রাত ৮টা পর্যন্ত দেশের মোট ৬৪ জেলার মধ্যে ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ ৩২ জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে৷ এ সব জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মোট সংখ্যা ৭৪ লাখ ৮২ হাজার ৬৩৭ জন৷ বন্যার পানিতে ১০ হাজার ৫৮৩ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ এবং ৬ লাখ ৫৮৭ হেক্টর জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এবারের বন্যায় ১৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ ৬ লাখ ৬২ হাজার ১৫৬টি বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এর মধ্যে ৭৫ হাজার ৩৩১টি ঘর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে৷
মজুদ সংকটের কারণে এবার ঈদ উল-আজহায় ভিজিএফ (ভার্নারেবল গ্রুপ ফিডিং) কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে৷ ফলে এই কর্মসূচির আওতায় তালিকাভুক্ত দেশের ৮৮ লাখ গরিব পরিবার এবারের কোরবানির ঈদে সরকারি এই সহায়তা পাচ্ছেন না৷ সরকারের এই কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারকে বিনা মূল্যে প্রতি ঈদের সময় বছরে দু’বার ২০ কেজি করে চাল সহায়তা দেয়া হত৷
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল ভিজিএফ কর্মসূচি বন্ধের কথা স্বীকার করেন বলেন, ‘‘এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়৷ খাদ্য মন্ত্রণালয় যদি চাল বরাদ্দ না দেয় তাহলে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে কীভাবে? তবে অন্য কর্মসূচি যথানিয়মে চলবে৷''
সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষের অবস্থাও করুন৷ তাহেরপুর বাদাঘাট এলকার জয়পুর স্কুল-এর শিক্ষক নূরে আলম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এবার ঈদে ওই এলাকার দরিদ্র মানুষ ভিজিএফ-এর চাল পাচ্ছে না৷ ঈদের সময় কিছু নগদ টাকা দেয়ার কথা বলেছিল সরকার৷ কিন্তু তা দেয়নি৷ এখানকার মানুষ শুধু আটা খেয়ে বেঁচে আছে৷ কোরবানি দেয়ার প্রশ্নই আসে না৷ পুরো গ্রামে মাত্র একটি গরু কোরবানি হচ্ছে৷''
ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘‘আমিসহ কয়েকজন মিলে একটি গরু ভাগে কোরবানি দিচ্ছি ধর্মীয় নিয়ম পালনের কারণে৷ কিন্তু আমাদেরও কোরবানি দিতে ভালো লাগছে না৷ এই মাংস আমরা খেতে পারব না৷ আমাদের চারপাশে এত অভুক্ত মানুষ৷ অনেকেই খাবার পায় না৷ এমনিতেই হাওর এলাকার মানুষ দরিদ্র৷ আর বন্যার কারণে তারা এখন বলতে গেলে নিঃস্ব৷ সরকারি কোনো সহায়তাও নেই৷ এরা বড় কষ্টে আছে৷ এখানে ঈদের আনন্দ নেই, বেঁচে থাকাই দায়৷''
আপনারা কীভাবে এই মানুষগুলোকে সহায়তা করতে চান? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷