জলবায়ু পরিবর্তনে সন্তান জন্মদানে ভীতি
১৮ মে ২০১৯অন্য সব মায়ের মতো সন্তান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মনের কোণে পোষণ করেন জার্মানির স্কুল শিক্ষিকা ফেরেনা ব্রুনশভাইগার৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সন্তানের অনাগত ভবিষ্যতের ঝুঁকি তাড়িত করছে তাঁকে৷
এ বিষয়টিকে সামনে রেখে যেসব নারী ও তরুণ-তরুণী সন্তান না নেওয়ার আন্দোলেন শুরু করেছেন, এখন তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের এই বাসিন্দা৷
ব্রুনশভাইগার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘‘আমরা এটা নিয়ে দীর্ঘ সময় গভীরভাবে চিন্তা করেছি৷ ঘটনাচক্রে জলবায়ু পরিবর্তনই আমার কাছে (সন্তান না নেওয়ার) প্রধান কারণ হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছে৷ অবশ্য আমি অনেক সংগ্রাম করেছি এটা নিয়ে৷ কারণ, আমরা শিশুদের ভালোবাসি৷ আমার স্বামীও একজন স্কুল-শিক্ষক৷ বোধ করি, আমরা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি৷''
এভাবে পৃথিবীব্যাপী তরুণ সমাজের একটা অংশের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন৷ সর্বোপরি, বিশ্বব্যাপী বন্যা, খরা ও ঝড় থেকে শুরু করে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য চিন্তায় ফেলছে তাঁদের৷
বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে সতর্ক করেছেন, গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে অভূতপূর্ব কোনো পদক্ষেপ না নিলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের আরো শত শত মিলিয়ন মানুষ বিপদের সম্মুখীন হবে৷
কম সন্তান নেওয়া, বিমানে কম চড়া এবং উদ্ভিদ জাতীয় খাবার খেয়ে উন্নত বিশ্বের মানুষ ব্যক্তিগতভাবে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে পারেন বলে বিজ্ঞানীদের ভাষ্য৷
স্কুল-শিক্ষিকা ব্রুনশভাইগারের মতো অন্যরাও মনে করেন, এমতাবস্থায় পৃথিবীর জনসংখ্যা আর বাড়ানো এক ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা৷ কারণ, ২০১৭ সালের ৭৬০ কোটি থেকে ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ১০০০ কোটি হতে চলেছে, যা কার্বন নিঃসরণ ও সম্পদের সমস্যা বাড়ানোর বড় কারণ হবে৷
আবার কেউ বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপদের সম্মুখীন করবে৷ মিউজিশিয়ান ও অ্যাক্টিভিস্ট ব্লাইথ পেপিনোরও তাই মত ৷ সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা গভীরভাবে পোষণ করলেও দুই বছর আগে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন পড়ার পর মত পাল্টে যায় তাঁর৷
যেসব নারী সন্তান জন্ম না দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন, এখন তাঁদের নিয়ে ‘বার্থস্ট্রাইক' নামে বিশ্বব্যাপী একটি ক্যাম্পেইন গ্রুপ চালু করেছেন পেপিনো৷ ‘জীববৈচিত্র্যে সংকটের ভয়াবহতা এবং সরকারি উদ্যোগের অভাবের' ফলে নারীরা এরকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে তাঁর ভাষ্য৷
পেপিনো রয়টার্সকে বলেন, ‘‘আমরা নিরাপদ ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি না৷ এটা যখন ভাবি, তখন আমি বুঝতে পারি সন্তান নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷''
যদিও এটাকে মায়েদের জন্য এক ধরনের অবিচার বলে মানছেন তিনি৷ কারণ, সন্তান না নেওয়া ‘বড় ধরনের একাকীত্বেরই' ব্যাপার৷ পেপিনো বলেন, ‘বার্থস্ট্রাইক' প্রচারাভিযানের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সহজে ‘দৃষ্টিগ্রাহ্য' বার্তাই দিতে চাচ্ছেন তাঁরা, যা তাঁদের আন্দোলনে আবেগের সংযোগও তৈরি করছে৷
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উদ্বেগ জন্মহারে কতটা প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো উপাত্ত পাওয়া যায়নি৷ তবে ২০১৭ সালের এক হিসেব থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি নারীর গড় সন্তানের সংখ্যা ১ দশমিক ৮-এ নেমে এসেছে, যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন৷ অন্য উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে জন্মহার স্থিতিশীল থাকতে কিংবা কমতে দেখা গেছে৷
জনসংখ্যার ওঠানামার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা কষ্টকর হলেও জলবায়ু পরিবর্তন যে এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে তা স্পষ্ট৷ কারণ, একটা বড় অংশের মানুষ এর ফলে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে ভীতি কিংবা অনীহার কথা বলছেন৷
যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার লোকের মধ্যে চালানো এক জরিপে দেখা যায়, ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সিদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি নারী সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় নিচ্ছেন৷ আরেক গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্বেগ থাকলেও ৩৩ শতাংশ বলছেন, এরপরও তাঁরা সন্তান নেবেন এবং পরিবার চালু রাখবেন৷
জনসংখ্যা বিতর্ক
মায়েদের এমন উদ্বেগ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জনসংখ্যার সম্পর্ক নিয়ে পুরোনো বিতর্ককে নতুন করে সামনে আনছে৷ কেউ কেউ দুটোকে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করলেও অনেকে আবার থোড়াই কেয়ার করছেন৷
কম-সন্তান জন্মদানকে উন্নত বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে একটি সফল উদ্যোগ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল ২০১৭ সালের এক গবেষণায়৷ ওই গবেষণায় দেখানো হয়, একটি সন্তান কম জন্ম দিলে, ভবিষ্যতে তিনি এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের হাত থেকে বিশ্ব প্রতিবছর ৫৮ টন কার্বন ডাই অক্সাইড রক্ষা পাবে৷
‘‘এটা একটা ভীতিকর বিষয়,'' বলেছেন টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক পরামর্শক ক্যারেন হার্ডি৷ ‘‘অনেকে বলতে চান, ‘জনসংখ্যা আর জলবায়ু পরিবর্তনকে' মেলানোর কিছু নেই৷ কিন্তু আমার মনে হয়, এমনটা বলা বালির মধ্যে মাথা লুকানোর মতো৷ আমি দেখেছি, তরুণরা এমন কুসংস্কার ভাঙতে চাইছেন৷''
তবে তিনি এ-ও বলেন, জনসংখ্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক বোঝা খুব সহজ নয়৷ কারণ, কার্বন নিঃসরণের হিসাব বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়৷
এক্ষেত্রে আফ্রিকার দেশ নাইজারের উদাহরণ টানেন হার্ডি৷ জন্মহারের দিক থেকে পৃথিবীর শীর্ষ ওই দেশ এটি৷ সে দেশে প্রতিজন নারী গড়ে সাত সন্তানের জন্ম দিয়েছেন বলে ২০১৬ সালের হিসাবে দেখা যায়৷
তবে কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন অবস্থানেই আছে নাইজার৷ বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে দেখা যায়, সেখানে প্রত্যেকে প্রতি বছর গড়ে মাত্র দশমিক ১ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ করে থাকেন৷ এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিজন গড়ে কার্বন নিঃসরণ করে থাকেন ১৬ দশমিক ৫ মেট্রিক টন৷
‘‘এটি নিছক কোনো সংখ্যা নয়,'' বলেছেন জন্মদানের অধিকার ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা ‘কনসিভেবল ফিউচার' সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মেগান কালম্যান৷ তাঁর মতে, ‘‘অ্যামেরিকার মধ্যবিত্ত মানুষ যে পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য ও অন্য জিনিস গ্রহণ করে, অন্যান্য দেশে সেটা করতে হলে পৃথিবীকে প্রায় পাঁচ গুণ বড় করতে হবে৷''
এমবি/এসিবি (রয়টার্স)