পুলওয়ামার বিস্ফোরণ পশ্চিমবঙ্গের ভোটপ্রচারের স্লোগান হয়৷ এটাই ভারতের রাজনীতির চরিত্র৷ ট্র্যাডিশন সমানে চলছে৷
বিজ্ঞাপন
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা হয়েছিল৷ নিহত হয়েছিলেন বহু সেনা জওয়ান৷ সেই ঘটনার কিছু মাসের মধ্যেই লোকসভা নির্বাচন শুরু হয় গোটা ভারত জুড়ে৷ পুলওয়ামার ঘটনা এবং পরবর্তী 'সার্জিকাল স্ট্রাইকে'র উত্তেজনা হাতিয়ার করে গোটা দেশজুড়ে প্রচারে নেমে পড়ে বিজেপি৷ এখনো মনে পড়ে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে, যেখানে পুলওয়ামা নামই শোনেননি মানুষ, সন্ত্রাসবাদ এবং তার প্রেক্ষিতে সরকারের কড়া অবস্থান নিয়ে একের পর এক বক্তৃতা করতেন নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ৷ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিজেপির অবস্থান কতটা লৌহকঠিন, এটাই ছিল মোদী-শাহের স্লোগান৷
তাতে কী ফল মেলেনি? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেন, ২০১৯ সালের ভোটে পুলওয়ামার ঘটনা বিজেপিকে ভোট বৈতরণি পার করতে অনেকটাই সাহায্য করেছে৷ কিন্তু তাতে কি সন্ত্রাসবাদের চেহারার পরিবর্তন ঘটেছে? কঠিন প্রশ্ন৷ উত্তর আরো কঠিন৷
সংসদে এবং সংসদের বাইরে কেন্দ্রীয় সরকার বার বার দাবি করেছে, বিশেষ করে কাশ্মীর থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে নেওয়ার পর সন্ত্রাসবাদী হামলা কমেছে৷ শুধু তা-ই নয়, ৯০ এর দশকে যে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকা ছেড়ে পালাতে হয়েছিল, তাদেরও অনেককে ফেরত পাঠানো গেছে৷ সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে জম্মু কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল ৪১৭টি৷ ২০২১ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২২৯টি-তে৷ শুধু তা-ই নয়, কাশ্মীরী যুবকরা সন্ত্রাসী সংগঠনে কম যুক্ত হচ্ছেন বলে সরকারের দাবি৷ সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, লস্কর কিংবা হিজবুলের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনে ২০১৮ সালে যে পরিমাণ কাশ্মীরি যোগদান করতো, ২০২১ সালে এসে সেই সংখ্যা অনেকটা কমেছে৷
আলোচিত কয়েকটি জঙ্গি হামলা
১৯৯৯ সালে উদীচী দিয়ে শুরু৷ এরপর বেশ কয়েকটি আলোচিত হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা৷ ছবিঘরে থাকছে সেসব কথা৷
ছবি: bdnews24.com
উদীচীর সমাবেশে হামলা
১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ যশোরে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়েছিলেন৷ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে৷ হরকাতুল জিহাদ (হুজি) উদীচীর সমাবেশে হামলা করেছিল বলে পুলিশের ঐ ইউনিট জানিয়েছে৷ উপরের ছবিটি প্রতীকী৷
ছবি: bdnews24.com
বাংলা বর্ষবরণে হামলা
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের সকালে ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিলেন৷ এই ঘটনায় শতাধিক আহতের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন৷ এই হামলার মধ্য দিয়ে হুজি তাদের শক্ত অবস্থানের জানান দিয়েছিল৷ হামলার দায়ে ২০১৪ সালে হুজি নেতা মুফতি হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: bdnews24.com
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২৫ মে সিলেটে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলা হয়েছিল৷ এতে পুলিশের দুই কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত হয়েছিলেন৷ আনোয়ার চৌধুরীসহ অর্ধশত মানুষ আহত হন৷ হামলার দায়ে ২০০৮ সালে হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ (ছবি) তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুইজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ২০১৭ সালের এপ্রিলে মুফতি হান্নানসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
ছবি: A.M. Ahad/AP/picture alliance
আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন প্রাণ হারান৷ ২০১৮ সালে মামলার রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়৷ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের জঙ্গিরা হামলায় অংশ নেয়৷ তবে ষড়যন্ত্রের পেছনে ছিল তখনকার জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ‘ইন্ধন’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Munir
৬৩ জেলায় বোমা হামলা
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)৷ এই হামলায় দুজন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হয়েছিলেন৷
ছবি: DW/H. U.R.Swapan
ব্লগার হত্যা
জঙ্গি হামলায় বেশ কয়েকজন ব্লগার ও মুক্তমনা নিহত হয়েছেন৷ ২০১৩ সালে আহমেদ রাজিব হায়দার হত্যা দিয়ে শুরু৷ এরপর ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন হত্যার শিকার হন৷ ২০২১ সালে অভিজিৎ হত্যার মামলার রায়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়৷ তারা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য৷
ছবি: Robert Richter
হোসেনি দালানে হামলা
২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর আশুরা উপলক্ষ্যে হোসেনি দালানের শোক মিছিলে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা৷ এ ঘটনায় একজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ চলতি বছরের মার্চে দেয়া রায়ে জেএমবির দুই সদস্যকে দশ ও সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
শিয়া মসজিদে হামলা
২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর বগুড়ার এক শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ হামলার প্রায় ১৪ মাস পর আদালতে দাখিল করা মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল জেএমবি এবং ইসলামি ছাত্রশিবির হামলায় অংশ নেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোলি আর্টিজানে হামলা
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ ২২ জন নিহত হন৷ পাঁচজন জঙ্গি অস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে বেকারিতে ঢোকার পর সবাইকে জিম্মি করেন৷ এরপর পুলিশ ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশের দুই কর্মকর্তা জঙ্গিদের গুলি ও বোমার আঘাতে মারা যান৷ কয়েকজনকে ছেড়ে দিলেও জঙ্গিরা অন্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে৷ জঙ্গিরা সবাই সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত হয়৷ ইসলামিক স্টেট এই হামলার দায় স্বীকার করেছিল৷
ছবি: bdnews24.com
জাফর ইকবালের উপর হামলা
২০১৮ সালে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক তরুণ ছুরি নিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালায়৷ এই ঘটনায় এ বছরের এপ্রিলে ফয়জুল হাসান নামের একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ফয়জুল কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য কিনা তা প্রমাণিত হয়নি৷ তবে তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট থেকে জিহাদি প্রবন্ধ ও বই ডাউনলোড করে পড়ে, উগ্রবাদী বক্তাদের বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন৷
ছবি: bdnews24.com
10 ছবি1 | 10
পরিসংখ্যান আর বাস্তবতা
পরিসংখ্যান আর বাস্তবতা সবসময় একই ছবি তৈরি করে না৷ কাশ্মীরের এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ করা যাবে না, এই শর্তে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, যে যুবকরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে অংশ নিচ্ছেন না বলে সরকার দাবি করছে, তারা কী তাহলে মূলস্রোতে মিশে যাচ্ছেন? তার বক্তব্য, গত আড়াই বছরে কাশ্মীরের ভিতরেই একাধিক সংগঠন এবং গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে৷ বাইরে থেকে ঘুরপথে তাদের কাছে ফান্ডও পৌঁছাচ্ছে৷ ফলে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীতে কাশ্মীরী যুবকরা যোগ দিচ্ছেন না বলে, কাশ্মীরে বিক্ষোভ, হত্যা বন্ধ হয়ে গেছে, এমন সরল সমীকরণে পৌঁছানো যায় না৷ তার পরিসংখ্যান বলছে, লোকাল রিক্রুটমেন্ট বা স্থানীয় 'সন্ত্রাসী' সংগঠনে কাশ্মীরী যুবকদের অংশ নেওয়ার পরিমাণ তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে৷ ২০১৪ সালে যা ছিল ৫৩, ২০২০ সালে তা ১৬৭-তে গিয়ে পৌঁছেছে৷
সরকার কিন্তু বাকি ভারতের ভোটের ক্ষেত্রে সরকারি হিসেবকেই সামনে রাখছে৷ এবং তার ভিত্তিতে জনমত গঠনও করছে৷ বাকি ভারত সরকারের এই সংখ্যাতত্ত্বে আন্দোলিত হচ্ছে৷
পণ্ডিত পরিসংখ্যান
সম্প্রতি কাশ্মীরে পণ্ডিতদের অবস্থান নিয়েও বিস্তর বিতর্ক হয়েছে৷ সরকার দাবি করেছে, সরকারি সাহায্যে পণ্ডিতরা আবার উপত্যকায় ফিরছে৷ পাঁচ হাজার ৫০২ জন পণ্ডিতকে জম্মু কাশ্মীরে সরকারি কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে৷ আবার পাশাপাশি বাস্তব বলছে, গত একবছরে কাশ্মীরে পণ্ডিত হত্যার একাধিক ঘটনা ঘটেছে৷ খোদ শ্রীনগরে এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে৷ নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পণ্ডিত ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ভয়ে, আতঙ্কে তারা উপত্যকা ছেড়ে ফিরে যেতে চেয়েছেন৷ কিন্তু সরকার তাদের ফিরতে দেয়নি৷ যা নিয়ে পণ্ডিত বিক্ষোভও হয়েছে কিছুদিন আগে৷ কিন্তু মূলস্রোতের ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সেই ন্যারেটিভ সেভাবে তুলে ধরেনি৷ বরং পণ্ডিতরা ফের কাশ্মীরে ফিরছেন, এই ন্যারেটিভকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷
সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারি অবস্থান-ভারতীয় রাজনীতিতে বরাবরই এই দুই কাউন্টার ন্যারেটিভ সমান্তরাল ভাবে থেকেছে৷ ভারতের নির্বাচনকে তা প্রভাবিত করেছে৷ রাজনৈতিক ন্যারেটিভই সেখানে গুরুত্ব পয়েছে, বাস্তবতা নয়৷ বাস্তবে যা-ই ঘটুক না কেন, রাজনীতি সেই ঘটনার ন্যারেটিভ কীভাবে তৈরি করছে, সেটাই বড় হয়ে উঠেছে বরাবর৷ কংগ্রেসের আমলে হয়েছে, জোট সরকারের আমলে হয়েছে, এখনো তা-ই হচ্ছে৷ অর্থাৎ, সুযোগ এবং সুবিধা মতো রাজনীতি সন্ত্রাসবাদের তথ্য নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে৷
রাজনীতি কি তবে পরোক্ষে মদতও দিচ্ছে সন্ত্রাসবাদকে? অ্যাকাডেমিক মহলে এই প্রশ্নও উঠেছে একাধিকবার৷ স্বাভাবিকভাবেই বিতর্কও হয়েছে অনেক৷ এ বিতর্ক থামার নয়৷ মূল স্রোতের রাজনীতির প্রবাহমানতার সঙ্গে এই বিতর্কও সমান্তরালভাবে চলতে থাকবে৷