ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের সেনা ক্যাম্পে হামলায় ১৮ জন ভারতীয় সৈনিক নিহত হওয়ার পর, পাকিস্তানকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঘোষণার জন্য মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে৷ ভারত স্বাভিকভাবেই চাইছে পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে৷
বিজ্ঞাপন
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, দেশটির পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করকে এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে৷ বলা হয়েছে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে৷ ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের একটি অধিবেশনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের পাকিস্তান কীভাবে সন্ত্রাসীদের উসকানি দিচ্ছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন৷
কাশ্মীরের উড়িতে হামলার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বার্তা পাঠিয়েছেন৷ তাতে তিনি বলেছেন, ‘‘সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের প্রশ্নে বাংলাদেশের নীতি হলো ‘জিরো টলারেন্স'৷ তাই এই কঠিন সময়ে ভারতের পাশে থাকবে বাংলাদেশ৷''
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।
ছবি: Reuters
19 ছবি1 | 19
তিনি আরও বলেন, ‘‘ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ এই অঞ্চলের সব বিপদ ও হুমকির মোকাবিলায় একযোগে কাজ করবে৷''
ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলি জানাচ্ছে যে, সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই-কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেছেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের অবদান বাংলাদেশ ভুলতে পারে না৷ তাই ভারতের কঠিন সময়ে বাংলাদেশও প্রকৃত মিত্রের পরিচয় নিয়ে পাশে থাকবে৷ ভারত যে ব্যবস্থাই নিক না কেন, বাংলাদেশ তার পাশে থাকবে৷''
হুমায়ুন কবির
এই প্রেক্ষাপটে নভেম্বর মাসে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনিশ্চিত হয়ে পরতে পারে৷ ভারত বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে সম্মেলন বয়কটের দিকে যেতে পারে৷
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দু'জন পার্লামেন্ট সদস্য পাকিস্তানকে ‘জঙ্গি রাষ্ট্র' ঘোষণার প্রস্তাব দিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে একটি বিল উত্থাপন করেছেন৷ টেক্সাসের কংগ্রেস সদস্য টেড পো এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ডানা রোহরাবেকার ঐ বিল উত্থাপন করেন৷ ‘পাকিস্তান স্টেট স্পন্সর অফ টেররিজম ডেজিগনেশন অ্যাক্ট' নামের এই বিলটির নম্বর এইচ.আর ৬০৬৯৷'
এ নিয়ে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক হুমায়ুন কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের প্রশ্নে ভারত বাংলাদেশের পূর্ণ সমর্থন পাবে৷ কাশ্মীরে হামলার পর বাংলাদেশ থেকে সে বার্তাই দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু বাকিটা নির্ভর করছে ভারত তার পদক্ষেপের ব্যাপারে কতটা সক্ষমতা দেখাতে পারে, তার ওপর৷''
শান্তনু মজুমদার
তিনি বলেন, ‘‘এখানে কাশ্মীর নিজেই একটা ইস্যু৷ কাশ্মীর প্রশ্নে বাংলাদেশ সাধারণত কথা বলে না৷ এবারও বলেনি৷ তবে যারা হামলার জন্য দায়ী, তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে, এটাই বলেছে৷ কিন্তু বিষয়টি কাশ্মীর প্রশ্নের সঙ্গে এক করে ফেলা কঠিন হয়ে যাবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘কাশ্মীরে সাম্প্রতিক হামলার পর অনেক বিষয়ই এখন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে৷''
ওদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু কাশ্মীরে সেনা হত্যার ঘটনা নয়, উপ-মহাদেশে অনেকে সন্ত্রাসের ঘটনাতেই পাকিস্তান তার অবস্থান স্বচ্ছ রাখতে পারেনি৷ ফলে পাকিস্তান একটা বড় চাপে পড়তে যাচ্ছে এটা বোঝা যায়৷ কিন্তু চীনের ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে এই চাপ কতটা প্রবল হবে বা পাকিস্তান কতটা সামলাতে পারবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ভারতেও উগ্রবাদী গোষ্ঠী রয়েছে৷ সেটাও বিবেচনার বিষয়৷''
মোহাম্মদ জামির
আর সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাকিস্তানের যেসব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এইসব হামলার অভিযোগ আছে, তাদের সমর্থন দেয় পাকিস্তান সরকার৷ বাংলাদেশ পাকিস্তানের এই ভূমিকা মেনে নেবে না৷''
তাঁর কথায়, ‘‘বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আলোচনার মাধ্যমে সামাধান না খুঁজে পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসী এসে হামলা চালাবে, এটা মানতে পারে না বাংলাদেশ৷''
বাংলাদেশের এই অবস্থান কি আপনি সমর্থন করেন? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷