তিনজন আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর বোমাবাজি ও গুলিচালনায় আতাতুর্ক বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক এলাকায় ৩৬ জন নিহত ও প্রায় দেড়শ' মানুষ আহত হবার পর আবার বিমান নামছে ও উঠছে৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ন'টা নাগাদ তিনজন আততায়ী তাদের আক্রমণ শুরু করে৷ একজন আততায়ী টার্মিনালের অভ্যন্তরে একটি সিকিউরিটি চেক-এ বিস্ফোরণ ঘটায়; অপর এক আততায়ী টার্মিনালের বাইরে বোমা ফাটায়; তৃতীয়জন বিস্ফোরণ ঘটায় একটি গাড়ি রাখার জায়গায়৷
তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম মঙ্গলবার রাত্রেই ইস্তানবুল বিমানবন্দর পরিদর্শন করেন এবং ঘোষণা করেন যে, আতাতুর্ক বিমানবন্দরে আবার বিমান নামতে ও উঠতে পারবে৷ তিনি জানান যে, আততায়ীরা একটি ট্যাক্সিতে করে বিমানবন্দরে আসে ও প্রথমে গুলি চালানোর পর বোমা ফাটায়৷ এক চতুর্থ আক্রমণকারীর পলায়ন সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো খবর নেই, বলে ইলদিরিম জানান৷ তবে নিহতদের মধ্যে কিছু বিদেশি আছেন, বলে তাঁর খবর৷ এই আক্রমণের পিছনে ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত আছে, বলে সন্দেহ করা হচ্ছে – বলেন ইলদিরিম৷
বুধবার সকালে বিমানবন্দরে ক্ষয়ক্ষতির একটা আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা করছেন কর্মকর্তারা৷ বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলা হচ্ছে৷ দেখা যাচ্ছে, টার্মিনালের ছাদের প্যানেলগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ আতাতুর্ক বিমানবন্দরে আক্রমণ ঘটার পর ইস্তানবুল থেকে যুক্তরাষ্ট্র অথবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইস্তানবুল অভিমুখে উড়াল কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখা হয় – পরে তা আবার চালু করা হয়েছে৷ হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জশ আর্নেস্ট বলেছেন, এ বছরেই আক্রান্ত ব্রাসেলস বিমানবন্দরের মতো ইস্তানবুল বিমানবন্দরও যে সব আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিভিন্ন দেশকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত রাখে, তার প্রতীক৷ ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইটারে মন্তব্য করেছেন, ‘‘আবার একটি সন্ত্রাসী আক্রমণ, এবার তুরস্কে৷ বিশ্ব কি কোনোদিন উপলব্ধি করবে, কী ঘটে চলেছে? খুবই দুঃখের কথা৷''
আইএস কী, কোথায় এবং কেন?
প্রতিদিনই খবরে আইএস৷ কোনোদিন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য, কোনোদিন হয়তো ইরাক বা সিরিয়ায় কোনো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য৷ আইএস বলছে, ইসলামি খেলাফত কায়েম করার জন্য যুদ্ধে নেমেছে তারা৷ ছবিঘরে আইএস সম্পর্কে কিছু তথ্য....
ইসলামিক স্টেট বা আইএস আসলে কী?
আল কায়েদা থেকে তৈরি হওয়া সুন্নি মুসলমানদের জঙ্গি সংগঠন আইএস৷ সাদ্দাম পরবর্তী সময়ে ইরাকে এবং বাশার আল আসাদের আমলে সিরিয়ায় সুন্নিদের হতাশা থেকেই জন্ম সংগঠনটির৷ আইএস-এর পতাকায় লেখা থাকে, ‘মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নবী’ এবং ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই৷’
ছবি: AP
আইএস কোথায় সক্রিয়?
শরিয়া আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে এমন রাষ্ট্র, বা ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় আইএস৷ সিরিয়া এবং ইরাকেই প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় তারা৷ দুটি দেশেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে বেশ বড় অঞ্চল দখল করে নিয়েছে আইএস৷
আইএস কেন আলাদা?
মূলত নিষ্ঠুরতার জন্য৷ শত্রুপক্ষ এবং নিরীহ মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াতে তারা এমন বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে যা আগে কেউ করেনি৷ জবাই করে ভিডিও প্রচার, পুড়িয়ে মারা, বাবার সামনে মেয়েকে জবাই করা এবং তার তার ভিডিও প্রচার, মেয়েদের যৌনদাসী বানানো আর পণ্যের মতো বিক্রি করা – এসব নিয়মিতভাবেই করছে আইএস৷ কোনো অঞ্চল দখলে নেয়ার পর সেখানে শাসন প্রতিষ্ঠায় মন দেয় আইএস৷
ছবি: gebphotography - Fotolia.com
অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক
আইএস যদিও শুধু সিরিয়া এবং ইরাকেই সক্রিয়, তবে বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়৷ নাইজেরিয়ার জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম কয়েকদিন আগেই জানিয়েছে, আইএস-কে তারা সমর্থন করে৷ দুটি সংগঠনের মধ্যে একটি জায়গায় মিলও আছে৷ আইএস-এর মতো বোকো হারামও নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতার প্রতিভূ হয়ে উঠেছে৷ অন্য ধর্মের নারীদের প্রতি দুটি সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণই মধ্যযুগীয়৷
ছবি: Getty Images/A. Katib
আইএস-এর অনুসারী কারা?
অনুসারী সংগ্রহের সাফল্যেও আইএস অন্য সব জঙ্গি সংগঠনের চেয়ে আলাদা৷ এ পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজার বিদেশী যোদ্ধা আইএস-এ যোগ দিয়েছে৷ তাদের মধ্যে ৪ হাজারই পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর অ্যামেরিকার৷
আইএস-কে রুখতে অন্য দেশগুলো কী করছে?
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বেশ কিছু পশ্চিমা এবং আরব দেশ সিরিয়া ও ইরাকে আইএস ঘাঁটির ওপর বিমান থেকে বোমা হামলা চালাচ্ছে৷ বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সিরিয়ায় ১৪২২ এবং ইরাকে ২২৪২ বার হামলা হয়েছে৷ কোনো কোনো সরকার দেশের অভ্যন্তরেও কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ সিরিয়া ফেরত অন্তত ৩০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির বিচার শুরু করবে জার্মানি৷ গত মাসে সৌদি পুলিশও ৯৩ জন সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
6 ছবি1 | 6
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক-ভাল্টার স্টাইনমায়ার মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি সর্বধর্ম সম্বলিত ইফতারে আমন্ত্রিত ছিলেন৷ তিনি ইস্তানবুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসের খবরে বিমূঢ়তা প্রকাশ করেন ও তুরস্কের সঙ্গে সংহতি জ্ঞাপন করেন৷ জার্মানি সর্বাধিক প্রচারিত ও জনপ্রিয় ট্যাবলেয়ড ‘বিল্ড পত্রিকা তাদের সংহতি জানায় জার্মান ও তুর্কি ভাষায়: ‘‘আমরা ইস্তানবুলে হতাহতদের কথা স্মরণ করছি৷''
কোথা থেকে অর্থ পাচ্ছে আইএস?
পেট্রোলিয়াম বিক্রি থেকে শুরু করে ব্যাংক ডাকাতি, অধিকৃত এলাকায় কর চাপানো এবং প্রাচীন সামগ্রী বিক্রি করে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট প্রায় ২০০ কোটি ডলার একত্র করেছে৷ তাতে তাদের আরও ২ বছর চলে যাবার কথা৷
ছবি: picture alliance/abaca
বেআইনি তেল বিক্রি
বেআইনি ভাবে পেট্রোলিয়াম বিক্রি আইএস-এর আয়ের প্রধান উৎস৷ সিরিয়া ও ইরাকে বেশ কিছু বড় তৈলকূপ আপাতত তাদের দখলে৷ মূলত তুরস্কের মধ্য দিয়েই তারা চোরাচালানের কাজ চালিয়ে থাকে৷ মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, কালোবাজারে তেল বিক্রি করে আইএস-এর মাসে প্রায় ৪ কোটি ডলার আয় হয়৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
ব্যাংক ডাকাতি
সিরিয়া ও ইরাকে কোনো এলাকা দখলের পর আইএস সবার আগে ব্যাংকগুলি কবজা করে ফেলে৷ মার্কিন প্রশাসনের ধারণা, এভাবে তারা ৫০ থেকে ১০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছে৷ শুধু মোসুল শহর দখল করেই তারা নাকি ৬২ কোটি ডলার লুট করেছিল৷ বছরে প্রায় ৫০,০০০ জিহাদি কর্মীর বেতন দিতে এই অর্থ যথেষ্ট৷
ছবি: Getty Images/S. Platt
কর আদায় ও চাঁদাবাজি
আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকার প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষকে ৫ থেকে ১৩ শতাংশ আয়কর দিতে হয়৷ জার্মান সরকারের সূত্র অনুযায়ী, আইএস অ-মুসলিমদের কাছ থেকে জিজিয়া করও আদায় করে৷ তাছাড়া চাঁদাবাজিও তাদের আয়ের আরেকটি উৎস৷
ছবি: DW/Andreas Stahl
প্রাচীন সামগ্রী বিক্রি
‘জিহাদিরা’ আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ধ্বংস করতে অভ্যস্ত৷ তবে বেশি দামি অ্যান্টিক সম্পদ সযত্নে সরিয়ে ফেলে কালোবাজারে বিক্রি করে তারা৷ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছ থেকেও অমূল্য সম্পদ কেড়ে নিয়ে বিক্রি করতে পিছপা হয় না এই গোষ্ঠী৷ তবে বিক্রিমূল্যের সঠিক অঙ্ক জানা নেই৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
মুক্তিপণ ও প্রচারণা
মানুষজনকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় আইএস-এর দু-মুখী চাল৷ একদিকে এটা আয়ের একটা উৎস, অন্যদিকে এর মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রচারণার কাজও হয়ে যায়৷ কিছু ‘মূল্যবান’ জিম্মির শিরশ্ছেদ করে সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে প্রচারণার ক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য পায় আইএস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
সহানুভূতি দেখাতে চাঁদা
আইএস-এর প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ মানুষ গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে রয়েছে৷ তারা এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তহবিলে আর্থিক অবদান রাখে৷ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সূত্র অনুযায়ী সৌদি আরবে ২০১০ সাল থেকে ৮৬০ জন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসের কাজে আর্থিক সাহায্য দেবার অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ সেখানে ১০০ জনের শাস্তি হয়েছে৷