‘হার্ট অফ এশিয়া' শীর্ষ সম্মেলনে সন্ত্রাস দমনে আরো সক্রিয় ভূমিকা নিতে পাকিস্তানকে নিশানা করেছে ভারত-আফগানিস্তানসহ ৪০টি দেশের মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা৷ সে সময় উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা সাতাজ আজিজ৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের অমৃতসরে দু'দিনের ষষ্ঠ ‘হার্ট অফ এশিয়া' শীর্ষ সম্মেলনের শীর্ষবিন্দু ছিল সন্ত্রাস৷ সম্মেলন শেষে প্রকাশিত অমৃতসর ঘোষণাপত্রে এই অঞ্চলের, বিশেষ করে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলির কার্যকলাপে গভীর উদ্বেগ প্রকাস করা হয়৷ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে আছে তালিবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট, লস্কর-ই-তৈয়বা, জয়স-ই-মহম্মদ৷ এই প্রথম এলইটি এবং জেইএমকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ সম্মেলনে যোগদানকারী ৪০টি দেশের মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা এক বাক্যে সন্ত্রাসীদের আর্থিক সাহায্য, আশ্রয়দান, রসদ জোগানোসহ সব রকমের মদত দেওয়া বন্ধ করার দাবি জানান৷ বলা হয়, এই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার পক্ষে সন্ত্রাস এক বিরাট হুমকি৷ সন্ত্রাসের লাগাতার শিকার আফগানিস্তানকে সাহায্য করতে বিশ্বের দেশগুলির প্রতি আহ্বান জানানো হয়৷
সম্মেলনে এ বিষয়ে পাকিস্তানকে সরাসরি নিশানা করেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি৷ অভিযোগ করেন, তালিবানসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিয়ে এবং পাকিস্তানের মাটিতে নিরাপদ ঘাঁটি গাড়তে সাহায্য কোরে পাকিস্তান তাঁর দেশের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে৷ আফগানিস্তানকে দেওয়া পাকিস্তানের ৫০ কোটি ডলার সাহায্যদানকে কটাক্ষ করে আফগান প্রেসিডন্ট বলেন, পাকিস্তান এই অর্থ সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্যয় করলে আরও ভালো হতো৷ তালিবানের মতো সন্ত্রাসবাদীরা পাকিস্তানে নিরাপদ আশ্রয় না পেলে এক মাসের বেশি টিকতে পারতো না৷
একই সুরের প্রতিধ্বনি করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর বক্তব্যে বলেন, বিশ্ব সমাজ যদি সন্ত্রাস ইস্যুতে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে সন্ত্রাসীদের সাহস বাড়বে, তাদের তত্পরতা বাড়বে৷ সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি যদি প্রয়োগ করা না হয়, তাহলে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি বিঘ্নিত হবে৷ যৌথভাবে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি৷
সম্মেলনে উপস্থিত পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ সন্ত্রাস ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, পাকিস্তানকে আসামির কাঠগোড়ায় দাঁড় করানোর ভারত ও আফগানিস্তানের প্রচেষ্টা নেহাতই অতি সরলীকরণ৷ আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই জটিল৷ সহিংসতা বেড়ে চলার জন্য একটা দেশকে দায়ী করা যায় না৷ এরজন্য দরকার বস্তুনিষ্ঠ এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি৷ ভারতের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তে উত্তেজনা সত্ত্বেও তিনি ভারতে এসেছেন ‘হার্ট অফ এশিয়া' সম্মেলনে এই বার্তাই দিতে যে, এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পাকিস্তান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ এ বিষয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে সমর্থন পায় পাকিস্তান৷ রাশিয়া মনে করে, আফগান প্রেসিডেন্টের অভিযোগ অস্বীকার না করেও বলা যায় ‘হার্ট অফ এশিয়া' সম্মেলন এ নিয়ে আলোচনার উপযুক্ত স্থান নয়৷
সম্মেলনে সারতাজ আজিজের উপস্থিতি এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে দেখে কূটনৈতিক মহলে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা আবার শুরু করার এক প্রাথমিক উদ্যোগ বলে মনে করা হয়৷ কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র দ্ব্যর্থহীনভাবে তা অস্বীকার করেন৷ বলেন, নৈশভোজের পর এক সৌজন্যমূলক সাক্ষাত ছাড়া আর কিছুই না৷ দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে কোনো কথাই হয়নি৷ এমনকি নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সারতাজ আজিজকে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে যেতে দেওয়া হয়নি৷ এ জন্য দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়৷
ভারত, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ছাবাহার পরিবহণ বন্দর সংক্রান্ত ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরকে সম্মেলনে স্বাগত জানানো হয়৷ বলা হয়, মধ্য এশিয়া তথা বিশ্ব বাণিজ্যে এই পরিবহন করিডর এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হবে৷
পাকিস্তান: অগুনতি সন্ত্রাসী হামলার একটি দশক
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সঙ্গীদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে যোগ দেয়ার পর, চড়া মূল্য দিতে হয়েছে পাকিস্তানকে৷ উগ্রপন্থিদের হাতে দেশটির কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে ইতিমধ্যেই৷ ছবিঘরে দেখুন সেই মর্মান্তিক কাহিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/A Majeed
২০০৭ – সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাবর্তনের দিন করাচিতে হামলা
২০০৭ সালের ১৮ অক্টোবর করাচিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর গাড়িবহরে জোড়া বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ সে সময় দীর্ঘ আট বছর পর দেশে ফিরছিলেন তিনি৷ হামলায় বেনজির বেঁচে গেলেও, প্রাণ হারায় ১৩৯ ব্যক্তি৷ কিন্তু এর মাত্র দু’মাস পর, ২৭ ডিসেম্বর, রাওয়ালপিন্ডিতে অপর এক হামলায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Khawer
২০০৮ – ওয়াহ বোমা হামলা
ওয়াহ-তে অবস্থিত ‘পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিস’-এ জোড়া আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারায় ৬৪ ব্যক্তি৷ ২০০৮ সালের ২১ আগস্টের সেই হামলাই এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো সামরিক স্থাপনায় সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘তাহরিক-ই-তালেবান’ (টিটিপি) সে সময় ঐ হামলার দায় স্বীকার করেছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Khan
২০০৮ – রাজধানীর হোটেলে সন্ত্রাসী হামলা
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত মারিয়ট হোটেলে বিস্ফোরকভর্তি ট্রাক দিয়ে হামলা চালানো হয়৷ ২০০৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের সেই হামলায় প্রাণ হারায় কমপক্ষে ৬০ ব্যক্তি, আহত ২০০৷ হতাহতদের মধ্যে ২০ জন বিদেশিও ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Matthys
২০০৯ – পেশোয়ারে হামলা
পাকিস্তানের পেশোয়ারে নারী ও শিশুদের বাজার হিসেবে পরিচিত ‘মিনা বাজারে’ একটি গাড়ি বোমা হামলায় ১২৫ ব্যক্তি নিহত ও ২০০ ব্যক্তি আহত হয়৷ পাকিস্তান সরকার এই হামলার পেছনে তালেবান জড়িত বলে দাবি করলেও, জঙ্গি গোষ্ঠী তালেবান এবং আল-কায়দা – উভয়েই সেই হামলার দায় অস্বীকার করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A Majeed
২০১০ – ভলিবল ম্যাচে আত্মঘাতী হানা
পাকিস্তানের বানুর একটি গ্রামে ভলিবল খেলা চলাকালে আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ হারায় ১০১ ব্যক্তি৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Azam
২০১১ – চারসাদার পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হামলা
পাকিস্তানের খাইবার পাকতুনখার চারসাদা জেয়া একটি পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে জোড়া বোমা হামলায় ৯৮ ব্যক্তি নিহত ও ১৪০ জন আহত হয়৷ ২০১১ সালে ১৩ মে ক্যাডেটরা যখন প্রশক্ষিণ শেষে দশদিনের ছুটিতে নিজ নিজ বাড়ি যাওয়ার পথে বাসে উঠছিল, তখন হামলার ঘটনাটি ঘটে৷ বলা হয়ে থাকে, ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতেই নাকি ঐ হামলা চালায় তালেবান৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Ahmed
২০১৩ – পেশোয়ারে চার্চে বোমা হামলা
২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পেশোয়ারের ‘অল সেইন্ট চার্চে’ জোড়া আত্মঘাতী হামলায় ৮২ ব্যক্তি প্রাণ হারায়৷ ‘তাহরিক-ই-তালেবান’ বা টিটিপি সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠী জুনদাল্লাহ সেই হামলার দায় স্বীকর করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Khan
২০১৪ – পেশোয়ারে স্কুলে হত্যাযজ্ঞ
২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর টিটিপি-র সাতজন বন্দুকধারী পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে হামলা চালায়৷ তারা ১৫৪ ব্যক্তিকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ১৩২টি শিশু ছিল৷ পাকিস্তানের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা৷
ছবি: AFP/Getty Images/A Majeed
২০১৫ – করাচিতে বাসে হামলা
২০১৫ সালের ১৩ মে আটজন বন্দুকধারী করাচিতে একটি বাসে হামলা চালিয়ে ৪৬ ব্যক্তিকে হত্যা করে৷ নিহতদের সবাই শিয়া মুসলমান ছিল৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করে জুনদাল্লাহ বা ‘আল্লাহ-র সেনা’ নামের জঙ্গি গোষ্ঠী৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
২০১৬ – হাসপাতালে বোমা হামলা
চলতি বছরের ৮ আগস্ট পাকিস্তানের কোয়েটায় সরকারি হাসপাতালে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং গুলিতে ৭০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়৷ নিহতদের অধিকাংশই আইনজীবী, যাঁরা অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত বেলুচিস্তান বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিলাল আনওয়ার কাসির মরদেহ নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন৷