সন্দেশখালি-তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে দিল সুপ্রিম কোর্ট
৯ জুলাই ২০২৪লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলির মধ্যে ছিল সন্দেশখালি। রেশন দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে হইচই শুরু হয় সুন্দরবন লাগোয়া এই এলাকাকে ঘিরে। তারপর জমি গ্রাস থেকে নারী নির্যাতন, সব অভিযোগের তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।
কঠোর সুপ্রিম কোর্ট
রেশন দুর্নীতিকে সামনে রেখে ইডি অভিযান চালিয়েছিল সন্দেশখালিতে। গত ৫ জানুয়ারির এই অভিযানে কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিক ও সিআরপি জওয়ানরা আক্রান্ত হন। এরপর এলাকার তৃণমূলের দাপুটে নেতা শেখ শাহজাহান ও তার দলবলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ সামনে আসে।
স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে আর্জি জানায় রাজ্য সরকার। গোড়াতেই সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন করেছিল, একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তে কেন আপত্তি রাজ্য সরকারের? তখনকার মতো শুনানি স্থগিত হয়ে যায়।
গ্রীষ্মের ছুটির পর সোমবার সুপ্রিম কোর্টের কাজ শুরু হয়। প্রথম দিনই সন্দেশখালি মামলার শুনানি ছিল বিচারপতি বি আর গাভাই ও বিচারপতি কে ভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চে। এই বেঞ্চ রাজ্যের উদ্দেশে সেই পুরনো প্রশ্নই ছুঁড়ে দেয়।
বিচারপতিরা প্রশ্ন করেন, একজনকে বাঁচাতে রাজ্য সরকার কেন এত আগ্রহী? তাকে গ্রেপ্তার করতে দীর্ঘদিন কেন সময় লেগেছিল, তা নিয়েও বিস্ময় প্রকাশ করেছে আদালত। ৫৫ দিন পর শাহজাহানকে এলাকা থেকেই গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
সোমবার রাজ্য সরকারের পক্ষে সওয়াল করেন কংগ্রেস নেতা, আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভী। তার বক্তব্য, ইডি আধিকারিকদের উপর হামলা সংক্রান্ত মামলা সিবিআইয়ের হাতে দেয়া যেত। কিন্তু রেশন দুর্নীতি সহ নারী নির্যাতন, জমি দখল, লুটপাট ইত্যাদি যাবতীয় মামলা সিবিআইকে দেয়া হয়েছে, যদিও রাজ্য সরকার দ্রুত তদন্ত চালাচ্ছিল।
রাজ্যের এই বক্তব্য খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। তাদের নির্দেশ, রেশন দুর্নীতি সহ ৪৩টি মামলারই তদন্ত করবে সিবিআই। গণবন্টনে অনিয়মের অভিযোগে ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের সাবেক খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, তার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমান ও বনগাঁ পুরসভার সাবেক চেয়ারম্যান শংকর আঢ্য।
রাজ্যের ধাক্কা আদালতে
সাম্প্রতিক অতীতে একের পর এক মামলায় রাজ্য সরকার হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে ধাক্কা খেয়েছে। বারবার দেখা গিয়েছে, নিম্ন আদালতের নির্দেশ শীর্ষ আদালত বহাল রেখেছে। নিয়োগ দুর্নীতির মামলাকে বাদ দিলে একাধিক অভিযোগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে দরবার করে রেহাই পায়নি রাজ্য সরকার।
সেই ধারাতেই যুক্ত হয়েছে রেশন দুর্নীতি ও সন্দেশখালি মামলা। ইডি আধিকারিকদের উপর হামলার ঘটনায় হাইকোর্ট আগেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আর্জি জানায় রাজ্য। কিন্তু শীর্ষ আদালত নিম্ন আদালতের নির্দেশ পরিবর্তন করেনি।
একই ঘটনা ঘটল জমি দখল বা নারী নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগের ক্ষেত্রেও। রাজ্য সরকারের সওয়াল ছিল, জমি গ্রাসের ক্ষেত্রে প্রশাসনের যোগসাজশের কথা বলে রাজ্য সরকারকে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস দেখা গিয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থেই কেন্দ্রীয় সংস্থা এ কাজ করেছে বলে দাবি রাজ্যের।
তারা বলে, শাহজাহানের কাণ্ডকারখানা সামনে আসার পর রাজ্য পুলিশ প্রশাসন সন্দেশখালিতে শিবির বসিয়ে অভিযোগ সংগ্রহ করেছে। দ্রুত অভিযোগের প্রতিকার করেছে বহু গ্রামবাসীর। তা সত্ত্বেও কেন সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়া হল, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যের আইনজীবীরা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, জমি দখল, লুটপাটের শয়ে শয়ে অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন এতদিন পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি? স্থানীয়দের একাংশের দাবি, জমি কেড়ে নেওয়া থেকে মজুরি থেকে বঞ্চিত করা কিংবা নারীদের যৌন নির্যাতন, এসবই চলত শাহজাহানের বিশ্বস্ত সঙ্গী শিবু হাজরা, উত্তম সর্দারদের তত্ত্বাবধানে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে থানায় গেলে পুলিশ অভিযোগ নিত না বলে দাবি গ্রামবাসীর।
এই পরিস্থিতিতে শুধু পুলিশের হাতে রেশন কেলেঙ্কারি থেকে নারী নির্যাতনের তদন্তের ভার থাকলে তারা কতটা পক্ষপাতহীন ভাবে কাজ করতে পারতেন, এই সওয়াল শোনা গিয়েছে আদালতে।
তৃণমূলের অবস্থান
সন্দেশখালি নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। বিধানসভায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, শেখ শাহজাহানকে টার্গেট করে ইডি সন্দেশখালিতে ঢুকেছে। এরপর তারা সেখানকার আদিবাসী ও সংখ্যালঘু মানুষদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দেয়।
তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময় মন্তব্য করেন, ইডির উপর হামলার ঘটনা যেদিন ঘটে, তখন এলাকায় শেখ শাহজাহানকে দেখা যায়নি। পরে এই তৃণমূল নেতাকে সাসপেন্ড করেন শীর্ষ নেতৃত্ব।
ইতিমধ্যে বিজেপির স্থানীয় নেতা গঙ্গাধর কয়ালের একাধিক ভিডিও ভাইরাল হয়। এই ভিডিওর সত্যাসত্য ডিডাব্লিউ যাচাই করেনি। স্টিং ভিডিওকে হাতিয়ার করে তৃণমূল প্রশ্ন তোলে, সন্দেশখালির নারী নির্যাতনের অভিযোগ পরিকল্পিতভাবে সাজিয়েছে বিজেপি। ভাইরাল ভিডিওতে গঙ্গাধরের বক্তব্যে সে কথাই উঠে এসেছে বলে দাবি শাসক দলের। এ নিয়ে তুমুল কাদা ছোড়াছুড়ির মধ্যে শাহজাহানের বিরুদ্ধে দলের সাসপেনশন সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
সিবিআইয়ে নজর
রাজ্য সরকার চাইছিল, পুলিশি তদন্তই চলুক সন্দেশখালি নিয়ে। এতে সায় দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। বিজেপি রাজ্য সভাপতি ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে থাপ্পড় মেরেছে। এবার সিবিআইকে দিয়েই সন্দেশখালি মামলার তদন্ত করাতে হবে। অপরাধীদের আড়াল করতে ওরা শীর্ষ আদালতে গিয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের নেতারা আর বাঁচতে পারবে না।"
তৃণমূল মুখপাত্র শান্তনু সেনের বক্তব্য, "তৃণমূল সরকার দলমত না দেখে ব্যবস্থা নেয়। অপরাধীকে আড়াল করতে চায় না। তাই ক্ষমতায় আসার পরেই কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। শেখ শাহজাহানের ক্ষেত্রেও আদালতের স্পষ্ট নির্দেশ পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।"
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, "তৃণমূলের কাজই হচ্ছে জনগণের টাকা খরচ করে যে কোনো অভিযোগকে ধামাচাপা দেয়া। রেশন দুর্নীতি ও সন্দেশখালি মামলাকে ধামাচাপা দিতে তারা শীর্ষ আদালতে গিয়েছিল। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট মামলা সিবিআইকে দিয়ে ঠিক করেছে।"
কিন্তু এতে কি দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত হবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, "সিবিআইয়ের সাকসেস রেট ভালো নয়। এর আগেও তারা সারদা, নারদ সহ বিভিন্ন মামলার তদন্ত করেছে। তদন্তের কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। তারা শিক্ষা দুর্নীতির তদন্ত করছে দীর্ঘদিন ধরে। রেশন দুর্নীতির ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট তাদের দায়িত্ব দিয়েছে মানেই সুবিচার মিলবে, এটা ভাবার কারণ নেই। সন্দেশখালির মামলার ক্ষেত্রেও যদি দ্রুত তদন্ত না হয়, তা হলে দেশের মানুষ আর এই ধরনের সংস্থার উপর ভরসা রাখতে পারবে না।"