ভারতে নিয়ম অনুযায়ী সূর্যাস্তের পর ময়নাতদন্ত করা যায় না। আরজি কর কাণ্ডে সে নিয়ম মানা হয়নি বলে আগেই অভিযোগ উঠেছিল। এবার সামনে এলো, তিলোত্তমার ময়নাতদন্ত নিয়ে এবার আরো কিছু গরমিল সামনে এসেছে। সূত্র জানিয়েছে, ময়নাতদন্ত ঘিরে আরজি করে যে বোর্ড গঠন করা হয়েছিল রাতারাতি, সেখানে একজন সদস্য ২০২১ সালের একটি মেমো দেখিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেনো রাতে ময়না তদন্ত করা হবে? কেন দেহটি একদিন মর্গে রেখে পরদিন সকালে ময়নাতদন্তে পাঠানো হবে না?
যে মেমোটি তিনি দেখিয়েছিলেন, তা ২০২১ সালে স্বাস্থ্য দপ্তরের জারি করা একটি নির্দেশিকা। সেখানে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে বিকেল চারটের পর ময়নাতদন্ত করা যাবে না।
আরজি কর কাণ্ডের পর হাসপাতালের সুপার একটি বোর্ড তৈরি করেন রাতারাতি। সেই বোর্ডেরই একজন সদস্য এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। অথচ তার আপত্তিকে গ্রাহ্যই করা হয়নি। ওই দিন সন্ধ্যাতেই মৃতদেহ ময়নাতদন্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, ময়নাতদন্তে পাঠানোর জন্য যে চালান দেওয়ার কথা, সেই চালান ইস্যু করা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আগেই প্রশ্ন তুলেছে। আগামী শুনানিতে রাজ্যকে সেই চালান দেখাতে বলা হয়েছে।
বেঁধে দেয়া সময় শেষেও জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলনে
মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফিরতে বলেছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু সেই সময় আন্দোলনেই দেখা গেল তাদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কাজে যোগ না দিয়ে প্রতিবাদে
সুপ্রিম কোর্টের দেয়া সময় পেরিয়ে গেল। কাজে যোগ দিলেন না জুনিয়র ডাক্তাররা। বিকেল পাঁচটায় তাদের দেখা গেল স্বাস্থ্যভবনের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভ দেখাতে। বিধাননগরে স্বাস্থ্যভবনের রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে তারা বসে পড়ে স্লোগান দিতে থাকেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতীকী মস্তিষ্ক
লালবাজার অভিযানে জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে ছিল প্রতীকী মেরুদণ্ড। এবার স্বাস্থ্যভবন অভিযানে তাদের হাতে দেখা গেল প্রতীকী মস্তিষ্ক। জুনিয়র ডাক্তাররা জানিয়েছেন, এই মস্তিষ্ক তারা স্বাস্থ্যসচিবকে দেবেন। তারা বলবেন, চিকিৎসকদের আন্দোলন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আরজি কর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা এবং স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম দূর করায় মাথাটা কাজে লাগাতে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ছিল ঝাঁটাও
জুনিয়র চিকিৎসকদের হাতে ছিল ঝাঁটা। ঝাঁটা যাবতীয় অনিয়ম, দুর্নীতি, অন্যায় ঝেঁটিয়ে বিদায় করার প্রতীক। অন্যায়ের সাফাই অভিযানে নেমেছেন বলে জানিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ছয়টি দাবি
জুনিয়র ডাক্তাররা ছয়টি দাবি নিয়ে এই অভিযান করেছেন। তাদের দাবির মধ্যে আছে, রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য অধিকর্তা, পুলিশ কমিশনারকে ইস্তফা দিতে হবে। অপরাধের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের শাস্তি দিতে হবে। যারা তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে চেয়েছিল, তাদের শাস্তি দিতে হবে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সব হাসপাতালে ভয়মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দাবি পূরণ না হলে
আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, তাদের দাবিপূরণ হলেই তারা কাজে ফিরে যাবেন। না হলে ওখানেই অবস্থান করবেন। তারা বলেন, বল এখন রাজ্য সরকারের কোর্টে। তারা দাবি মেনে নিক, ব্যবস্থা নিক, জুনিয়র ডাক্তাররাও কাজে ফিরবেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
জুনিয়র ডাক্তারদের মিছিল
বিধাননগরের করুণাময়ী থেকে স্বাস্থ্যভবন পর্যন্ত মিছিল করে যান জুনিয়র ডাক্তাররা। প্রচুর জুনিয়র ডাক্তার মিছিল করে স্বাস্থ্যভবনের একশ মিটার দূরে পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়েন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
পিছিয়ে গেল পুলিশ
পুলিশ আগে স্বাস্থ্যভবন থেকে অনেকটা দূরে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তাররা জানিয়ে দেন, তারা স্বাস্থ্যভবনের কাছে যেতে চান। যেমন, তারা লালবাজারের কাছে যেতে চেয়েছিলেন। ২২ ঘণ্টা পরে সেই দাবি মানা হয়েছিল। এবার আগে থেকেই তাদের দাবি মানার অনুরোধ করা হয়। পুলিশ সেই দাবি মেনে নেয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান
একদিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, একমাস হয়ে গেছে, এবার সকলে পুজোয় ফিরুন- উৎসবে ফিরুন। মুখ্যমন্ত্রীর এই অনুরোধ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তারা বলেছেন, বিচার না পাওয়া পর্যন্ত তারা উৎসবে ফিরবেন না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সন্দীপ ঘোষ সিবিআই হেফাজত থেকে জেলে
মঙ্গলবার সন্দীপ ঘোষ-সহ চারজনকে আর তাদের হেফাজতে চাইলো না সিবিআই। ২৩ তারিখ পর্যন্ত তাদের জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। সিবিআইয়ের আইনজীবী মঙ্গলবার বলেন, তাদের আটদিনের জেরা শেষ হয়েছে। এবার তারা ডিজিটাল তথ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করতে চান। বিচারক বলেন, ''এখন থেকেই কি সিবিআই ঠিক করতে চাইছে, ভবিষ্যতে আমরা কী রায় দেবো? এটা আমি হতে দেবো না। তখন কী পরিস্থিতি হবে, সেই অনুযায়ী নির্দেশ দেবো।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
সন্দীপদের বিরুদ্ধে নারী আইনজীবীরা
সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন নারী আইনজীবীরা। সন্দীপ ঘোষকে যখন কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রহরায় পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন তারা স্লোগান দিতে থাকেন। তারা অভিযোগ করেন, পুলিশ তাদের ধাক্কা দিয়ে আদালত থেকে বের করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে স্লোগান দেন নারী আইনজীবীরা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ময়নাতদন্ত নিয়ে চা়ঞ্চল্যকর তথ্য
আরজি করে ধর্ষিতা ও খুন হওয়া চিকিৎসকের দেহের ময়নাতদন্ত করার ক্ষেত্রে আপত্তি তুলেছিলেন ফরেনসিক বিভাগের অধ্যাপক রিনা দাস। তিনি ছিলেন ময়না তদন্তের ক্ষেত্রে তিন সদস্যের দলের একজন। তিনি স্বাস্থ্য দপ্তরের একটি নির্দেশের কথা তুলে লিখিতভাবে বলেছিলেন, বিকেল চারটের পর ময়নতদন্ত করতে গেলে পুলিশের অনুমতি দরকার। তার অল্প সময়ের মধ্যে টালা থানার অনুমতি এসে যায়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
11 ছবি1 | 11
ডয়চে ভেলের হাতে যে তথ্য এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ওই দিন টালা থানার এক সাব ইনস্পেক্টর আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ফরেন্সিক মেডিসিনের প্রধানকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়েছে, বিশেষ কারণে ওই দিন রাতেই ময়নাতদন্ত করা প্রয়োজন। ওই চিঠি ফরোয়ার্ড করেছিলেন টালা থানার ওসি। আরজি করের কর্মকর্তারাও চাইছিলেন রাতের মধ্যেই ময়নাতদন্ত হোক।
বস্তুত, এই ঘটনায় টালা থানার ভূমিকা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠছে। মৃতার বাবা-মা প্রশ্ন তুলেছেন, তারা চাওয়া সত্ত্বেও কেন মেয়ের দেহ একদিন সংরক্ষণ করা হলো না। আরজি করের মর্গেই দেহ সংরক্ষণ করা যেত বলে দাবি উঠছে। কিন্তু পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা করতে চায়নি বলে অভিযোগ।
টালা থানার ওই চিঠি সামনে আসায় তদন্ত নতুন মোড় পাবে বলে মনে করছেন আইনজীবী অরিন্দম দাস। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''এক এক করে বেশ কিছু নথি বাইরে আসছে। এই নথিগুলি আদালতে গুরুত্ব পাবে বলেই মনে করছি। প্রতিটি নথি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, প্রাথমিক তদন্তে কিছু বিষয় ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।''
আরজি কর ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তীর দুঃখ, ক্ষোভ
13:26
মর্গের পরিস্থিতি
এদিকে আরজি কর মর্গের একাধিক অনিয়ম নিয়ে বুধবার একটি তদন্তমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আনন্দবাজার পত্রিকা। সাংবাদিক শান্তনু ঘোষের সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, যে সিভিক ভল্যান্টিয়ার সঞ্জয় রাইকে ইতিমধ্যেই এই ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আরজি করের মর্গে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সঞ্জয় নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত বলেও মনে করছে সিবিআই। অর্থাৎ, শবের সঙ্গে সহবাসের প্রবণতা ছিল তার। আরজি করের মর্গে ঢুকে সে সে কাজ করতো বলে মনে করছে সিবিআই। তার ফোন থেকে বেশ কিছু নথি উদ্ধার হয়েছে বলে দাবি করেছে সিবিআই। একইসঙ্গে আশঙ্কা, আরজি করের মর্গ থেকে বেওয়ারিশ মৃতদেহ এবং দেহাংশ বিক্রি করা হতো। রেজিস্টারের সঙ্গে মর্গে রাখা দেহের সংখ্যার গরমিল আছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাবেক আইপিএস অফিসার সন্ধি মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''এমন যদি সত্যিই হয়ে থাকে, সিবিআইয়ের তদন্তে যদি এই তথ্য উঠে আসে, তাহলে তার দায় কেবলমাত্র সঞ্জয় রাইয়ের উপর চাপিয়ে দিলে চলবে না। একজন সিভিক ভল্যান্টিয়ারের পক্ষে একা এই কাজ করা সম্ভব নয়। এর পিছনে বড় চক্র থাকতে বাধ্য। সেই চক্রের মাথাদের গ্রেপ্তার করতে হবে।''
আইনজীবী অরিন্দম দাস ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''আরজি কর কাণ্ড কেবল একটি ধর্ষণ এবং খুনের মামলা নয়। এরসঙ্গে আরো অনেক কিছু জড়িত বলেই মনে হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট যে পথে মামলাটিকে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে অন্য মামলাগুলিও মূল মামলার নথি হয়ে উঠতে পারে বলে মনে হচ্ছে।'' অর্থাৎ, বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনিয়মের সঙ্গে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার যোগসূত্র আছে কি না, তা তদন্তে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন অরিন্দম।