সপরিবার আত্মহত্যার অসুখ ছড়াচ্ছে কেন?
৬ মার্চ ২০২৫
বিপুল অংকের আর্থিক দেনা মাথার উপর। দেনা শোধ করার কোনো পথ নেই। তাই অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। এ কাজে তারা সঙ্গী করছেন নিজের শিশু সন্তানকে। ট্যাংরার পর একই ধরনের ঘটনা সামনে এল দক্ষিণ কলকাতার কসবায়।
কসবার ঘটনা
গত মঙ্গলবার সকালে হালতুর রথতলার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় একই পরিবারের তিনজনের মৃতদেহ। স্বামী, স্ত্রী ও তাদের শিশু পুত্রের দেহ। শিশুটির বয়স মাত্র আড়াই বছর।
যাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, তাদের নাম সোমনাথ রায় (৪০), তাঁর স্ত্রী সুমিত্রা (৩৫) ও তাদের ছেলে রুদ্রনীল। সোমনাথ পেশায় অটোচালক ছিলেন। সোমনাথ ও সুমিত্রার দেহ ঝুলন্ত অবস্থায় ঘরের মধ্যে মেলে। সোমনাথের বুকের মধ্যে চাদরে বাঁধা অবস্থায় ছিল রুদ্রনীলের দেহ। অনুমান করা হচ্ছে, ছেলেকে খুন করে আত্মঘাতী হয়েছেন বাবা-মা। ঘরের দেওয়ালে পাওয়া গিয়েছে সুইসাইড নোট।
স্থানীয় সূত্রের খবর, রুদ্রনীলের চিকিৎসার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে হয়েছিল সোমনাথকে। এ জন্য বাজারে তার বিপুল টাকার দেনা হয়ে যায়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তিনি ঋণ নেন। কিন্তু অটো চালিয়ে সেই ঋণ শোধ করতে পারছিলেন না। ধার শোধের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তাগাদা দিতে তার বাড়িতে আসেন। টাকা শোধ করার কোন পথ না থাকায় সোমনাথ সপরিবার আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে অনুমান করা হচ্ছে।
আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে খুব একটা সাহায্য সোমনাথ পাননি। নিজের মামা-মামির কাছেও হাত পেতেছিলেন। সূত্রের খবর, দেওয়ালে লেখা সুইসাইড নোটে এই মামা-মামির ভূমিকার কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের হুমকির কথা। পুলিশ মামা-মামিকে গ্রেপ্তার করেছে। ১০ লক্ষ টাকা ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়া এক মধ্যস্বত্বভোগীকেও পুলিশ পাকড়াও করেছে। মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মামলার রুজু করেছে পুলিশ।
একের পর এক ঘটনা
সাম্প্রতিক অতীতে একের পর এক ঘটনা ঘটেছে। কলকাতা-সহ জেলার প্রতিটি ঘটনায় প্রিয়জনকে নিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার নমুনা দেখা গিয়েছে।
১৯ ফেব্রুয়ারি: দেনার দায়ে ডুবে গিয়েছিল ট্যাংরার দে পরিবার। সকলে মিলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু তাতে সকলের মৃত্যু হয়নি। পরিবারের দুই মহিলা সদস্যকে খুন করে দুই গৃহকর্তা আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেন।
২৮ ফেব্রুয়ারি: মা-মেয়ের মৃতদেহ উদ্ধার হয় মধ্যমগ্রামে। আর্থিক সংকটের জেরে এই পরিণতি। পুলিশের অনুমান, মেয়েকে খুন করে আত্মঘাতী হন মা।
১ মার্চ: বেহালার শকুন্তলা পার্কে উদ্ধার হয় বাবা-মেয়ের ঝুলন্ত দেহ। মেয়ে অটিজমে আক্রান্ত ছিল। তার চিকিৎসা নিয়ে উদ্বেগ ছিল বাবার। শেষমেষ মেয়েটিকে নিয়ে আত্মঘাতী হন বাবা।
৩ মার্চ: আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাটে এক পরিবারের তিনজনের দেহ উদ্ধার হয়। এর মধ্যে একটি শিশু, বাকি দুজন যুবক ও প্রৌঢ়া। এরা জলদাপাড়ার মাহুত পরিবারের তিন সদস্য।
'সুইসাইড সংক্রমণ'
আত্মহত্যা শুধু কোন ব্যক্তির সংকট নয়। এটা এখন একটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এভাবেই ব্যাখ্যা করছেন। একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনাকে মনস্তত্ত্ববিদ্যার পরিভাষায় বলা হয় 'সুইসাইড কন্টাজিওন' বা 'আত্মহত্যার সংক্রমণ'।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বা চিকিৎসা মনোবিদ ডা. প্রশান্তকুমার রায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটাকে বলা হয় সুইসাইড কন্টাজিওন। অর্থাৎ যখন একটি ঘটনা হয়, সেটা খুব বেশি প্রচার পেতে শুরু করে, আলোচনা হয়, তখন যারা সমস্যার মধ্যে আছেন, তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি করে দেখা দেয়। মেট্রোর আত্মহত্যা নিয়ে যখন লেখালেখি হয়, তখন দেখা যায়, পরপর কয়েকটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে একই পদ্ধতিতে। অর্থাৎ একাধিক মানুষ আত্মহত্যায় প্ররোচিত হন। অভিনয়ে জগতেও এটা দেখা যায়। একটা সময়ে কলকাতায় একজন অভিনেত্রী আত্মঘাতী হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে এ রকম আরো দু'-একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছিল।"
তিনি বলেন, "সংবাদমাধ্যমে বিষয়গুলি নিয়ে খুবই আলোচনা হয়। কিন্তু এই সংক্রান্ত গাইডলাইন মানা হয় না। এ ধরনের খবরে আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের জন্য হেল্পলাইন নম্বর উল্লেখ করার কথা বলা হয়। আমাদের মিডিয়াতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। এছাড়া সংবাদমাধ্যমের কাছে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছিল, কীভাবে আত্মহত্যা হয়েছে, তার বিবরণ না লেখাই কাম্য। শুধু খবরটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু আমাদের সংবাদমাধ্যমে আত্মহত্যার পদ্ধতি বিশদে লেখা হচ্ছে। একটা জায়গায় দেখলাম ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হওয়ায় খবরে বড় করে দড়ির ছবি দিয়েছে। এই ছবির প্রভাব আরো ব্যাপক।"
সপরিবার আত্মহত্যাকে কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের সমস্যা বলে মনে করেন না সমাজতত্ত্বের বিশেষজ্ঞরা। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান সুহৃতা সাহা ডিডাব্লিউকে বলেন, "আত্মহত্যা করে এই পলায়নপ্রবণতা একদমই ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। আমাদের জীবনযাত্রা এখন ক্যাপিটালিজমের চোটে পাল্টে গেছে। চাকচিক্যপূর্ণ জীবনের দিকে একটা ঝোঁক এসেছে। আমরা কতটা আয় ও কতটা ব্যয় করব, সেই জায়গাটা গুলিয়ে ফেলছি। এতে অনেকটা লোন নিয়ে নিচ্ছি। ট্যাংরা-সহ একাধিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট একটা সাধারণ ব্যাপার। সেই সংকট অর্থনীতির সঙ্গে যেমন যুক্ত, তেমনই নিজের ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের সঙ্গেও অনেক ক্ষেত্রে জড়িত। চাহিদার সঙ্গে সামর্থ্যের তাল না মেলানোর জন্যই এসব বাড়ছে।"
আত্মহত্যা নিয়ে আরো বেশি সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করেন প্রশান্তকুমার রায়।
তার বক্তব্য, "মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদরোগ বা ক্যান্সার নিয়ে যে আলোচনা আমাদের সমাজে হয়, সেটা আত্মহত্যা নিয়ে হয় না। অথচ আত্মহত্যা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ। এ নিয়ে বিশদ আলোচনার সদিচ্ছা আমাদের নেই।"